হাদিসে এসেছে সমস্ত হালাল জিনিসের মধ্যে মহান আল্লাহর নিকট তালাক সর্বাপেক্ষা ঘৃণ্য। স্বামী স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক যদি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, একত্রে বসবাস করা উভয়ের পক্ষেই বা যে কোন এক পক্ষের সম্ভব হয় না, সেক্ষেত্রে তারা নির্দিষ্ট উপায়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে। কাবিননামার ১৮ নম্বর ঘরে স্ত্রীর তালাক প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া আছে।
১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইনে অত্যন্ত— সুষ্পষ্টভাবে বলা হয়েছে কি কি কারণে একজন স্ত্রী আদালতে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারবে।
কারনগুলো হলো
১. চার বৎসর পর্যন্ত স্বামী নিরুদ্দেশ থাকলে।
২. দুই বৎসর স্বামী স্ত্রীর খোরপোষ দিতে ব্যর্থ হলে।
৩. স্বামীর সাত বৎসর কিংবা তার চেয়েও বেশী কারাদন্ড হলে।
৪. স্বামী কোন যুক্তিসংগত কারণ ব্যতীত তিন বছর যাবৎ দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে।
৫. বিয়ের সময় পুরষত্বহীন থাকলে এবং তা মামলা দায়ের করা পর্যন্ত বজায় থাকলে।
৬. স্বামী দুই বৎসর ধরে পাগল থাকলে অথবা কুষ্ঠ ব্যাধিতে বা মারাত্মক যৌন ব্যধিতে আক্রান্ত থাকলে।
৭. বিবাহ অস্বীকার করলে। কোন মেয়ের বাবা বা অভিভাবক যদি ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে মেয়ের বিয়ে দেন, তা হলে মেয়েটি ১৯ বছর হওয়ার আগে বিয়ে অস্বীকার করে বিয়ে ভেঙ্গে দিতে পারে, তবে যদি মেয়েটির স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য সর্ম্পক (সহবাস) স্থাপিত না হয়ে থাকে তখনি কোন বিয়ে অস্বীকার করে আদালতে বিচ্ছেদের ডিক্রি চাইতে পারে।
৮. স্বামী ১৯৬১ সনের মুসলিম পারিবারিক আইনের বিধান লংঘন করে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করলে।
৯. স্বামীর নিষ্ঠুরতার কারণে।
উপরে যে কোন এক বা একাধিক কারণে স্ত্রী আদালতে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারে। অভিযোগ প্রমাণের দায়িত্ব স্ত্রীর। প্রমাণিত হলে স্ত্রী বিচ্ছেদের পক্ষে ডিক্রি পেতে পারে, আদালত বিচ্ছেদের ডিক্রি দেবার পর সাত দিনের মধ্যে একটি সত্যায়িত কপি আদালতের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যানের কাছে পাঠাবে। ১৯৬১ সনের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ অনুযায়ী চেয়ারম্যান নোটিশকে তালাক সংক্রান্ত নোটিশ হিসেবে গণ্য করে আইনানুযায়ী পদক্ষেপ নিবে এবং চেয়ারম্যান যেদিন নোটিশ পাবে সে দিন থেকে ঠিক নব্বই দিন পর তালাক চূড়ান্তভাবে কার্যকর হবে।
স্বামীর আদালত স্বীকৃত নিষ্ঠুর ব্যবহার সমূহ
ক) অভ্যাসগতভাবে স্ত্রীকে আঘাত করলে বা নিষ্ঠুর আচরণ করলে, উক্ত আচরণ দৈহিক পীড়নের পর্যায়ে না পড়লেও, তার জীবন শোচনীয় করে তুলেছে এমন হলে।
খ) স্বামী খারাপ মেয়ের সাথে জীবনযাপন করলে।
গ) স্ত্রীকে অনৈতিক জীবনযাপনে বাধ্য করলে।
ঘ) স্ত্রীর সম্পত্তি নষ্ট করলে।
ঙ) স্ত্রীকে ধর্মপালনে বাধা দিলে।
চ) একাধিক স্ত্রী থাকলে সকলের সাথে সমান ব্যবহার না করলে।
ছ) এছাড়া অন্য যে কোন কারণে (যে সকল কারণে মুসলিম আইনে বিয়ের চুক্তি ভঙ্গ করা হয়)।
কিন্তু আইন অনুযায়ী স্বামী বা স্ত্রী যে কেউ একে অপরকে তালাক দিতে চাইলে তাকে যে কোন পদ্ধতির তালাক ঘোষণার পর যথাশীঘ্রই সম্ভব স্থানীয় ইউপি/পৌর/সিটি মেয়রকে লিখিতভাবে তালাকের নোটিশ দিতে হবে এবং তালাক গ্রহীতাকে উক্ত নোটিশের নকল প্রদান করতে হবে। চেয়ারম্যান/মেয়র নোটিশ প্রাপ্তির তারিখ হতে নব্বই দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো তালাক বলবৎ হবে না। কারন নোটিশ প্রাপ্তির ত্রিশ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান/মেয়র সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের মধ্যে আপোষ বা সমঝোতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সালিশী পরিষদ গঠন করবে এবং উক্ত সালিশী পরিষদ এ জাতীয় সমঝোতার (পূনর্মিলনের) জন্য প্রয়োাজনীয় সকল ব্যবস্থাই অবলম্বন করবে।
সাধারণত আইন অনুযায়ী তালাকের নোটিশ প্রেরণের পর ইদ্দতকাল পর্যন্ত, অর্থাৎ ৯০ দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হয় না। এ সময় অন্যত্র বিয়ে করার ক্ষেত্রে আইনে নিষেধ আছে। আইনের প্রশ্ন হচ্ছে, পারিবারিক আদালতে দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার মামলায় অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন চলে কি- না। মকবুল মাজেদ বনাম সুফিয়া খাতুন মামলায় (৪০ ডিএলআর ৩০৫, এইচসিডি) মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের সিদ্ধান্ত এরকম যে, ১৯৮৫ সালে লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জের সহকারী জজ আদালতে একটি মামলা হয়। পারিবারিক আদালতের অধ্যাদেশে করা সর্বপ্রথম মামলাটিতে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি উত্থাপিত হয়। এতে স্বামী তাঁর স্ত্রীর দ্বিতীয় বিয়ের ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা প্রার্থনা করে। আদালত নিষেধাজ্ঞার আবেদন অগ্রাহ্য করেন। পরে জেলা জজ আদালতে আপিল করা হলে আপিল নামঞ্জুর হয়। পরে হাইকোর্ট বিভাগে রিভিশন করা হয়। হাইকোর্ট বিভাগ তার রায়ে বলেন, ‘পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশে ২০ ধারা অনুযায়ী দেওয়ানি কার্যবিধির ধারা প্রয়োগ যোগ্য নয়। আদালত আদেশ দিলেন, ‘ইদ্দতকাল পর্যন্ত অর্থাৎ ৯০ দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত স্ত্রী অন্যত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হইতে পারিবে না এ মর্মে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর।'