প্রাচীন নগরী পেট্রাঃ পাথরের বুক কুঁদে তৈরি এক বিস্ময়কর রহস্য

Author Topic: প্রাচীন নগরী পেট্রাঃ পাথরের বুক কুঁদে তৈরি এক বিস্ময়কর রহস্য  (Read 1457 times)

Offline sadia.ameen

  • Sr. Member
  • ****
  • Posts: 266
  • Test
    • View Profile


প্রাচীন সময়ে মানুষ যে আমাদের মত ঘরবাড়ি তৈরি করে বাস করতো না সেটা আমরা জানিই। বইপত্রে আমরা জেনেছি “পাহাড়ের গুহায় এবং গাছের ওপরে” মানুষ আশ্রয় নিত। পরে তারা ঘরবাড়ি তৈরি করতে শুরু করে। জর্ডানের পেট্রা অনেকটা তার মাঝামাঝি একটা জায়গা, যেখানে মানুষ আর প্রকৃতি একে অপরের হাত ধরে টিকে ছিলো যুগ যুগ ধরে। পাথর কুঁদে পাহাড়ের মাঝে মানুষ তৈরি করে অলঙ্কৃত গুহা আর সেখানেই গড়ে তোলে সমৃদ্ধ এক সভ্যতা। প্রাচীন স্থাপত্যবিদ্যার এর চাইতে উৎকর্ষ নিদর্শন আর দেখা যায় না।

গ্রিক ভাষায় পেট্রার নাম হলো Πέτρα বা “পাথর” আর আরবিতে আল-বাত্রা। প্রাচীন পেট্রা নগরী অবস্থিত দক্ষিণ জর্ডানের বেলেপাথরে তৈরি খাড়াই পাহাড়ের গায়ে। আরব্য যাযাবর নাবাতিয়ান জাতির মানুষের তৈরি করা মন্দির, সমাধি, হল, বেদি অ্যাকুয়াডাক্ট রয়েছে এখানে। ২০ হাজার নাবাতিয়ানের এই শহরে ছিলো পানির সংকট। এ কারণেই তারা পাথর কেটে তৈরি করে পানি সরবরাহের এই প্রক্রিয়া অ্যাকুয়াডাক্ট। প্রাচ্যের মশলা বাণিজ্যের চলাচলের অন্যতম পথ ছিলো পেট্রার মধ্য দিয়ে। এখনও এই শহরের দেয়ালে দেয়ালে সেই সভ্যতার নিশ্বাস মেখে রয়েছে।

খ্রিষ্টের জন্মের কয়েক শতাব্দী পূর্বে , মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে পত্তন হয় এই শহরের। বাণিজ্য, কৃষি, প্রযুক্তি এবং পাথর কেটে স্থাপত্য তৈরিতে বিশেষ পারদর্শিতা ছিলো তাদের। তার পরে ১৮০০ এর শুরুর দিকে এক সুইস অভিযাত্রী আবিষ্কার করে এই প্রাচীন নগরী। ডেড সি এবং রেড সি এর মাঝে এই নগরীকে অনে সময় রোজ সিটিও বলা হয়, কারণ যে পাথর থেকে এই শহর কেটে তৈরি করা হয়েছিলো, তার রংটাও লালচে। বাইবেলে এই নগরীর বর্ণনা রয়েছে, সেখানে একে উল্লেখ করা হয় “পাথরের মাঝে ফাটল” বলে। শহরের প্রবেশমুখ হলো দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী একটি ফাটল যাকে ‘সিক” বলে ডাকা হয় এখন। পেট্রার সবচাইতে উল্লেখযোগ্য স্থাপনা হলো "ফারাওর গুপ্তধন” নামের একটি স্মৃতিসৌধ।

এত সমৃদ্ধ একটি সভ্যতা হারিয়ে গেলো কেন? জানা যায়, ৩৬৩ সালের দিকে একটি বড় ধরণের ভূমিকম্প হয় এই অঞ্চলে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পেট্রার স্থাপনাগুলো। অনেকগুলো স্থাপনা ভেঙ্গে যায় এবং এই শহরের টিকে থাকার জন্য জরুরি পানি সরবরাহ প্রক্রিয়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর পরবর্তীতে লুটেরাদের আক্রমনে এর অনেক মূল্যবান ধনসম্পদ হারিয়ে যায়।

পেট্রার রহস্যের কিছুটা আভাস পাওয়া যায় এর ধোঁয়াটে ইতিহাসের মাঝে। Indiana Jones and the Last Crusade সিনেমায় সেই রোমাঞ্চ তুলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে বটে, কিন্তু তার মাঝে সঠিক তথ্য তেমন নেই। একটি পাত্র আকৃতির কাঠামো তৈরি করা আছে এর প্রবেশমুখ “সিক” এর ওপরে। এতে রয়েছে অসংখ্য গুলির চিহ্ন। পেট্রার ভেতরে বাস করা কতিপয় বেদুইনের মতে, স্থানীয় মানুষ মনে করত এই পাত্র আসলে একটি গুপ্তধন রাখার স্থান এবং এটা ভেঙে ফেলার উদ্দেশ্যে তারা এর ওপর গুলিবর্ষণ করে। কিন্তু এই পাত্র আকৃতির কাঠামো আসলে নিরেট পাথরে তৈরি, সে ব্যাপারটা বুঝতে অনেক সময় লেগে যায় তাদের। আর পেট্রার ভেতরে রয়েছে অনেক অনেক সমাধি। এগুলোর প্রতিটির পেছনেই থাকতে পারে চমকপ্রদ কোনও কাহিনী। রোমান সাম্রাজ্যের পেটে ঢুকে যাওয়ার আগ পর্যন্ত নাবাতিয়ানরা অনেক প্রভাবশালী ছিলো। শুধু বানিজ্যই নয়, বরং প্রযুক্তিগত দিক দিয়েও। পানি সরবরাহ, সংরক্ষণ, সেচ ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায়। নাবাতিয়ান এবং রোমান-গ্রিক ধাঁচের স্থাপত্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুরো এলাকায়।

এই পানি সরবরাহের প্রযুক্তি নিয়েই মূলত ধাধায় পড়ে গেছেন গবেষকেরা। বছরে মাত্র ছয় ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হতো যে অঞ্চলে, সেখানে এত মানুষের চাহিদা মেটানোর মতো উন্নত প্রযুক্তি এলো কোথা থেকে? শুধু তাই নয়, নাবাতিয়ানদের স্থাপত্যবিদ্যা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেন। তারা মুলত যাযাবর শ্রেণীর মানুষ ছিলো। সারাজীবন যারা তাঁবু খাটিয়ে বাস করে অভ্যস্ত, তাদের পক্ষে কি আসলেই এত উন্নত মানের পাথর খোদাই করা এমনকি তার মধ্য থেকে অনেকটা আধুনিক ধাঁচের একটি পরিকল্পিত শহর বের করে ফেলা সম্ভব? কোনও সঠিক উত্তর পাওয়া যায় না এই প্রশ্নের। তার ওপর এই সভ্যতার মানুষেরা নিজেদের ব্যাপারে কখনো কোনও লিখিত তথ্য রেখে যায়নি। তারা যে লেখা-পড়া করতে সক্ষম ছিলো, তার প্রমাণ পাওয় যায় দেয়ালে আঁকা বিভিন্ন গ্রাফিতিতে। কিন্তু অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার মানুষেরা নিজেদের উৎকর্ষের কাহিনী যেভাবে লিপিবদ্ধ করে রেখে গেছে, নাবাতিয়ানরা সেটা করে নি। তার কারণ কি? এটা জানা না গেলেও, তারা যে গোপনীয়তা পছন্দ করত, সেটা বোঝাই যায়। এর একটি বড় উদাহরন হলো তাদের বাসস্থান। এত জায়গা থাকতে তারা পাহাড়ের গায়ে এমন দুর্গম একটি স্থানে আস্তানা গাড়ে। এ নগরী যখন সক্রিয় ছিলো তখনও নিজেদের বানিজ্য এবং প্রযুক্তির সব তথ্য তারা গোপন করেই রাখত। এখন আমরা অনেক কিছুই হয়তো ধারণা করে নিতে পারি। কিন্তু সত্যি এটাই যে পেট্রার অনেক রহস্য হয়তো বিলুপ্ত হয়ে গেছে নাবাতিয়ানদের সাথে সাথেই।

আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এই নগরীর মাত্র ১৫ শতাংশ এখন পর্যন্ত এসেছে প্রত্নতাত্বিকদের গবেষণার আওতায়। বাকিটা রয়ে গেছে অজানা। পেট্রার ভূগর্ভের অনেক নিদর্শন এখন আছে মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। হয়তো সেগুলোই পেট্রার ইতিহাস জানতে সাহায্য করবে একদিন।