লাহোর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ ও স্বাধীনতাত্তর বাংলার রাজনীতি

Author Topic: লাহোর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ ও স্বাধীনতাত্তর বাংলার রাজনীতি  (Read 1760 times)

Offline Mohammad Nazrul Islam

  • Full Member
  • ***
  • Posts: 184
  • Test
    • View Profile
মুজিব নগর সরকারের শপথ গ্রহনঃ
10 এপ্রিল আগরতলা বৈঠকের সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেয়া হয়। খবরটি প্রচারে তখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ভারতীয় সংবাদসংস্থা পিটিআই’র আগরতলা প্রতিনিধি অনিল ভট্টাচার্যের। তার আগরতলার বাসভবনটি তখন ভারতে আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সামরিক নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের কাছে একরকম প্রেসক্লাব হয়ে গিয়েছিল! আগরতলা বৈঠকে সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হলেও কৌশলগত কারনে শপথ অনুষ্ঠানের দিন ও স্থানটি গোপন রাখা হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, চুয়াডাঙ্গা শহরে প্রবাসী সরকারের শপথ হবে। কিন্তু চুয়াডাঙ্গার তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা ডাঃ আসাবুল হক (হ্যাবা ডাক্তার) কথাচ্ছলে এক বিদেশী সাংবাদিককে তথ্যটি জানিয়ে দিলে তাৎক্ষনীক ভাবেই পাকিস্তানি বাহিনী চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয়। এরপর সিদ্ধান্ত হয় মেহেরপুরের বৈদ্যেরনাথতলার স্থানটির। চুয়াডাঙ্গা আওয়ামী লীগ নেতা এ্যাডভোকেট ইউনুস আলীসহ আরও কয়েকজন অনুষ্ঠানের আয়োজন প্রস্তুতির দায়িত্ব পান। অনুষ্ঠান আয়োজন নিয়ে পদে পদে দেখা দেয় নানান বিপত্তি! শপথ গ্রহন অনুষ্ঠানে আগত জনসাধারনের সিংভাগই ছিল এতিম ও অসহায় লোকজন। গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে জোগাড় করা হয় চেয়ার! এই চেয়ার গুলোর কোনটির ছিল হাতল; কোনটির ভাঙ্গা পা! যেগুলোর পা ভাঙ্গা সেগুলোর নিচে ইটের সাপোর্ট কোন মতে দাড়া করে রাখা হয়। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের ‘গার্ড অব অনার’ দিতে জোগাড় করা হয় কয়েকজন ‘আনসার’ ও ‘গ্রাম’ পুলিশের সদস্য! কিন্তু নতুন দেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইতে জানেন এমন কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না! পরিশেষে জানা যায় সীমান্তের ওপারে কৃষ্ণনগরে একটি মেয়ে আছে যে আমার সোনার বাংলা গাইতে জানে।
অতএব লোক পাঠিয়ে কৃষ্ণনগর স্কুলের ক্লাস এইটের ছাত্রী মেয়েটিকে তার অভিভাবক সহ নিয়ে আসা হয়। এভাবে অনুষ্ঠান সাজাতে অনেক জোড়াতালির ব্যবস্থা করা হয়। ১৬ এপ্রিল বিকেলে কলকাতা প্রেসক্লাবে যান ‘ব্যারিষ্টার আমির উল ইসলাম’। সাংবাদিকদের বলেন 17 এপ্রিল সকালে বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষ্ঠান হবে। সাংবাদিকরা যারা যেতে চান তারা যেন ভোরবেলা প্রেসক্লাবে থাকেন। এখান থেকে গাড়িতে করে তাদের অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু কোথায় অনুষ্ঠান, কিসের অনুষ্ঠান সে জবাব না দিয়েই ঝড়ের বেগে সেখান থেকে বেরিয়ে চলে যান ব্যারিষ্টার আমির উল ইসলাম! কিন্তু খবরটি কলকাতার মিডিয়া পাড়ায় মূহুর্তে চাউর হয়ে যেতে সময় লাগেনি! সকালে যদি আবার গাড়ি মিস হয় সে আশংকায় অনেকে রাত কাটান প্রেসক্লাবে!
17 এপ্রিল সকাল যথারীতি প্রেসক্লাবে আসেন ব্যারিষ্টার আমির উল ইসলাম। তার সঙ্গে আরও কয়েকটি গাড়ি। কোথায় যাচ্ছি কেন যাচ্ছি এমন একশ প্রশ্ন সবার। কিন্তু আমির উল ইসলাম এর কিছুরই জবাব না দিয়ে সবাইকে গাড়িতে উঠতে অনুরোধ করেন। যে কয়েকটি গাড়ি এসেছে সাংবাদিক তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। কিন্তু কারও এ নিয়ে কথা তোলার সময় নেই। যে যেভাবে পেরেছেন গাদাগাদি করে চড়েন গাড়িতে! গাড়ির বহর চলতে থাকে বাংলাদেশ সীমান্তের উদ্দেশে।
এদিকে মেহেরপুরের বৈদ্যরনাথ তলায় চলে আরেকটি পর্ব। বিদেশি সাংবাদিকরা আসার আধাঘন্টা আগে সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দিন সহ নেতৃবৃন্দ সেখানে পৌঁছেন। অনুষ্ঠানস্থলের কিছুদূর একটি ঝোপের মতো এলাকায় একটি ইপিআর ক্যাম্প। নেতৃবৃন্দকে সেই ইপিআর ক্যাম্পে নিয়ে বসিয়ে রাখা হয়। সে কারনে বিদেশি সাংবাদিকরা অনুষ্ঠানস্থলে এসে দেখেন বাংলাদেশের নেতারা বাংলাদেশের ভিতর থেকে অনুষ্ঠানস্থলে আসছেন! অনুষ্ঠান শেষে নেতারা আবার হেঁটে হেঁটে চলে যান সেই ইপিআর ক্যাম্প! বিদেশি সাংবাদিকরা দেখেন বাংলাদেশের নেতারা আবার চলে যাচ্ছেন বাংলাদেশের ভিতরে! বিদেশি সাংবাদিকরা চলে যাবার আধাঘন্টা পর শপথ নেয়া নেতারারাও আবার চলে যান ভারতে। এ ব্যাপারে অনুষ্ঠান সংগঠকদের অন্যতম এ্যাডভোকেট ইউনুস আলী এই প্রতিবেদককে বলেছেন, যুদ্ধে অনেক কৌশলগত অবস্থান নিতে হয়। তখন বিদেশি সাংবাদিকদের আস্থা অর্জনে কৌশলগত অভিনয়টি করা হয়েছে! শপথ নেয়া প্রবাসী সরকারের নেতারা ভারতে চলে যাবার আধাঘন্টার মধ্যে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী পৌঁছে যায় মুজিবনগরে! তারা ক্রোধে লন্ডভন্ড করে দেয় গোটা এলাকা। কিন্তু তার আগেই বিশ্ব জেনে গেছে নতুন এক দেশ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার খবর।
পাকিস্তানীদের বিরোদ্ধে মুক্তিযুদ্ধাদের সার্বিক সাহায্য করার জন্য ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী অস্থায়ীভাবে ছয়টি সেক্টর গঠন করে। এই সেক্টর গুলো হচ্চে যথা- 1. আলফা যার হেডকোয়াটার ছিল পশ্চিমবঙ্গের মুরথি 2. ব্রাভো সেক্টর যার হেডকোয়াটার রায়গঞ্জ, 3. চার্লি হেডকোয়াটা বিহারের চাকুলিয়ায়, 4. ডেল্টা হেডকোয়াটার ডেউটামুরা. 5. ইকো আসামের মাসিপুর এবং 6.ফক্রটর্ট যার হেডকোয়াটার মেঘালয়ের তুরাতে স্থাপন করা হয়।
প্রবাসী সরকারের তত্বাবধানে সর্বপ্রথম 1971 সালে 28 সেপ্টেম্বর বিমান বাহিনী গঠিত হয়। ‍অত্যন্ত সংর্কীন পরিসরে মাত্র দুইটি ফ্রাইটার এবং দুটি হেলিক্পটার নিয়ে তাদের পত চলা শুরু হয়। পদ্মা এবং পলাশ নামের দুইটি গান বোট ও 44 জন ফ্রান্স ফেরত বাঙ্গালী কমান্ডো নেভল সেনা নিয়ে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ নাগাদ গঠিত হয় নৌবাহিনী। সর্ব স্তরের দেশ প্রমিক বাঙ্গালী জনসাধানকে নিয়ে ভারতের সার্বিক সহযোগিতায় 21 নভেম্বর গঠিত হয় সশস্ত্রবাহিনী। সীমান্তবর্তী এলাকায় স্থাপন করা হয় সশস্ত্র ট্রেনিং সেন্টার ও পূর্নবাসন কেন্দ্র। একথা সত্য যে, এই সংর্কীন পরিসরে সশস্ত্র বাহিনী গঠিত হলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যে ব্যাপকহারে মুক্তিপাগল জনগন এতে যোগদান করতে থাকে এবং বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত ও প্রতিকূল অবস্থাকে ডিঙ্গিয়ে সীমান্তবর্তী ট্রেনিংসেন্টার গুলোতে ট্রেনিং নিয়ে বাংলার মুক্তির সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে। মুক্তি  ‍যুদ্ধে প্রায় 20 থেকে 25 লক্ষ লোক অংশ গ্রহন করে যার পাচঁভাগের চার ভাগই ছিল কৃষক বা কৃষক পরিবার সংশ্লিষ্ট। 1971 সালের 21 শে নভেম্বর প্রবাসী সরকারের উদ্দ্যোগে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী। 1971 সালের 6ই নভেম্বর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ভাষনে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্ধিরা গান্ধী বলেন ‘The cry Independence asose after sheik mujib was arrested and not before himself, so for as I know has not asked for Independence ever now. সমাজতান্ত্রিক ও পুজিঁবাদী দ্বন্দের কারনে পূর্বও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে এই ঘুর্নিভূত রাজনৈতিক অবস্থায় আমেরিকা পররাষ্ট্র বিষয়ে ‘এক আমেরিকা বহুনীতি গ্রহন করেন। প্রেসিডেন্ট নিক্রনের নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্ঠা হেনরি কিসিঞ্জার চীনকে বুঝাতে সক্ষম হন যে, দক্ষিন এশিয়ায় সোভিয়েত প্রভাব বাড়তে দেওয়া হবে না। আবার পাকিস্তানকে আশস্ত করে যে, পূর্বপাকিস্তানের উপর তারা নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করতে পারলে আমেরিকার কোন আপত্তি নাই। ভারতের সাথে আলোচনায় তিনি বলেন ‘পুর্বপাকিস্তান স্বাধীন হলে তাদের কোন লাভ হবে না; বরং বামপন্থিরা জয়ী হলে অচিরেই তারা ভারতে প্রবেশ করবে। তা সত্যেও 1971 সালের 9 আগষ্ট ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন 20 বছর মেয়াদী মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষর করে।  ‍চুক্তির 9 নম্বর অনুচ্ছেদ ছিল ‘দুই পক্ষের কেউ আক্রান্ত হলে অথবা আক্রান্ত হবার আশংঙ্খা দেখা দিলে সেই আশংঙ্খা নিশ্চিহৃ করার উদ্দেশ্যে উভয় পক্ষ অতিসত্বর আলোচনা করে সম্মিলিত ভাবে নিজেদের শক্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। এই চুক্তির আন্তর্জাতিক মূল্যমান, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অনূকূল যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রস্তুস্তি পর্বের অগ্রগতি বিচার-বিশ্লেষণ করে ইন্দিরা গান্ধী অক্টোবর মাসের শুরুর দিকে এই মর্মে উপসংহারে উপনিত হন যে, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য আসন্ন শুষ্ক মৌসুমের প্রারম্ভে ভারতীয় সেনাবাহিনী সর্র্বাত্মক যুদ্ধ চালালে তা হবে যথোপযুক্ত সময়। তাই আসন্ন সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্য নিজ রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্ব প্রস্তস্তি সর্ম্পূন করে বিশ্বজনমত গঠনের লক্ষ্যে 24 অক্টোবর 19 দিনের এক লম্বা সফরে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিম ইউরোপে যান। (একথা সত্য যে, মার্কিন প্রশাসনের কিছু সিনেটর ও কংগ্রেসম্যান বাঙ্গালীদের পক্ষ নিয়ে পাম্চিম পাকিস্তানে অথনৈতিক ও সামরিক সাহায্য না পাঠাতে হাউসে গালাঘার আমেন্ডমেন্ট আইন পাশ করান কিন্তু প্রেসিডেন্ট নিকসন ও হেনরি কিসিহ্জারের বিরোধীতায় তা ব্যর্থ হয়ে যায়) স্বদেশে ফিরে এসে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী 15 নভেম্বর কংগ্রেস দলের কার্যকারী সভায় ঘোষনা করেন ‘Bangladesh has come to stay, there is no power on the earth which can alter this position(the financial times november 16, 1971) এ সময় আন্তজার্তিক অঙ্গনে রাজনৈতিক সর্ম্পকের সমীকরনে নতুন মাত্র যোগ হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন নিজ নিজ স্বার্থর কারনে পরস্পরের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এই দুই শক্তিধর রাষ্ট্রের সর্ম্পক উন্নয়নে মধ্যস্থতা করে পাকিস্তান। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ থেকে তাইওয়াকে বহিস্কার করে তদস্থলে 23 বছরের মার্কিন বিরোধীতার আবসান ঘটিয়ে 25 অক্টোবর জাতিসংঘের উভয় পরিষদে গনচীনকে সদস্য করা হয়। এ ঘটনার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়, পাকিস্তান সংহতি রক্ষায় বাংলাদেশের চীন ও আমেরিকা এক যোগে কাজ করবে। আরব বিশ্বও সর্ববৃহৎ মুসলিমরাষ্ট্র পাকিস্তান ভাগ হয়ে যাওয়ার ব্যাপার মেনে নিতে চাননি। নভেম্বরের শেষ নাগাদ বাংলাদেশের অভ্যন্তরের যুদ্ধ পরিস্থিতি ভারতের সর্বাত্মক অনুকূলে হয়। একই সময়ে আর্ন্তজাতিক অঙ্গনের রাজনৈতিক চাপে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ার আগেই দ্রুত যুদ্ধাভিযানের প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহনে ভারত উভয় সংকটে পড়ে। ঠিক এই সময় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধা এবং সীমান্তে ভারতীয় ও বাংলাদেশী বাহিনীর মিলিত ও ক্রমবর্ধিত চাপে মিত্র রাষ্ট্র (আমেরিকা ও চীনের) হস্তক্ষেপের আশ্বাসে 3 ডিসেম্বরে ভারতের সাথে যুদ্ধ ঘোষনা করে। ফলে আক্রমনকারী অপবাদ থেকে ভাতর রক্ষা পায়। মাকির্ন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিষয়ক উদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার পাকিস্তান রক্ষায় বহুমূখী তৎপরতা শুরু করেন। তিনি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে ভারতকে আগ্রাসী রাষ্ট্র হিসাবে চিহিৃত করে চূড়ান্ত বিজয়ের আগেই যুদ্ধবিরতি কার্যকরের মাধ্যমে পাকিস্তানের পরাজয় ঠেকিয়ে রেখে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন নস্যাৎ-এর চেষ্ঠা করে। একই সঙ্গে প্রয়োজন হলে দক্ষিন উপকূল থেকে সপ্তম নৌবহরের মাধ্যমে সরাসরি হস্তক্ষেপে করা এবং চীনের দ্বারা ভারতের উত্তর সীমান্তে আক্রমন চালানো চেষ্টা চলায়। 3 ডিসেম্বর সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তান রক্ষায় হেনরি কিসিঞ্জার দুইটি সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। এক. বাংলাদেশে পাকিস্তানী বাহিনীর পরাজয়ের আগেই যুদ্ধ বিরতি এবং সৈন্য প্রত্যাহারে জাতিসংঘকে কাজে লাগান। দুই. 1959 সালে পাকিস্তান-মার্কিন প্রতিরক্ষা চুক্তির অজুহাতে সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য বাংলাদেশের উপকূলে সপ্তম নৌবহর মোতায়ন করা। সপ্তম নৌবহর ব্যবহারে মার্কিনীরা পাকিস্তানকে দুইটি শর্তের কথা উল্লেখ করেন।  1. পুনার্ঙ্গ যুদ্ধ শুরু হবার পর কমপক্ষে তিন সাপ্তাহ নিজ শক্তিতে পাকিস্তানকে ঠিকে থাকতে হবে। 2. উত্তর সীমান্তে চীনের যুগপৎ আক্রমন চালাতে হবে। 3রা ডিসেম্বর ভারতের সাথে পাকিস্তানের যুদ্ধ ঘোষনার সাথে সাথে বাংলাদেশে-ভারতের যৌথ বাহিনীর অভিযান করে এবং বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগন সর্বত্র ভাবেই যৌথবাহিনীর সহযোগিতায় বিপুলভাবে এগিয়ে আসে। ফলে যৌথ বাহিনী অসামান্য গতি অর্জনে সক্ষম হয়। এদিকে 4 এবং 5 ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতি এবং ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারে জন্য পর পর দুটি প্রস্তাব উস্থাপন করলে দুটি প্রস্তাবেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো প্রদান করে। 6 ডিসেম্বর ভারত আনুষ্টনিক ভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। 7 ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর কাছে পাকিস্তানের শক্তিশালী ঘাটি যশোরের পতন হয়। ওয়াশিংটনে হেনরি কিসিঞ্জিার চীনকে উত্তর সীমান্ত আক্রমন এবং সপ্তম নৌবহর ব্যবহারে জন্য ‘চীনা কতৃপক্ষ ও মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের সঙ্গে অনবরত দেন-দরবার করতে থাকে। 8 ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের সাধারন পরিষদের অধিবেশনে 104/11 ভোটে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাস করিয়ে নিলেও সোবিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত এই প্রস্তাবের ভ্রুক্ষেপ না করে বাংলাদেশের দ্রুত বিজয় অর্জনে মনযোগ দেন। 9 ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট নিক্রন ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম উপকূলে অবস্থিত সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরে অবস্থান নেওয়ার নিদের্শ দেন। বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনীর পতনরোধে নৌ, বিমান,ও স্থল তৎপরতার সম্ভাব্য মিশন দেওয়া হয়। (সপ্তম নৌববহরের টাস্কফোর্সে পাঁচহাজার সৈন্যসহ 75টি জঙ্গী বিমান, পাঁচটি হেলিকপ্টার, মিসাইল ও ডেষ্ট্রয়ারসহ 25টি অ্যাসল্ট হেলিকপ্টার সংযোক্ত করা হয়। 10 ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নকে জানিয়ে দেন ‘ভারত যুদ্ধবিরতিতে সম্মত না হলে সপ্তম নৌবহর নিয়োগসহ শক্তি প্রযোগ করা হবে। এই হুমকীর মোকাবেলায় সোভিয়েত ইউনিয়ন পাঁচটি সাবমেরিনসহ 16টি নৌযুদ্ধ জাহাজ বঙ্গোপসাগর ও তার আসে-পাশে মোতায়ন করে। ফলে বিশ্বজোড়ে হৈচৈই পড়ে যায় যে যুদ্ধ আর্ন্তজাতিক রুপ পরিগ্রহ করছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতারা প্রায় নিরুত্তাপ হয়ে পড়েন। কিন্তু অদম্য সাহস ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে এই সংকট মুহুর্তে শান্ত ও ধীর থেকে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী তিনটি সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। প্রথমতঃ সপ্তম নৌবহরের মিশন ব্যর্থ করার জন্য ভারতীয় নৌবাহিনীর সর্বচ্চ ব্যবহার দ্বিতীয়তঃ ঢাকা অভিমুখে যৌথবাহিনীর অভিযানের গতি বৃদ্ধি। তৃতীয়তঃ সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক সাহায্য নিশ্চিত করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে জাতি সংঘের মাধ্যমে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ থেকে ভারতকে বিছিন্ন করার চেষ্ঠা করে। তারা প্রতিরক্ষা চুক্তির ব্যধবাধকতা দেখিয়ে সপ্তম নৌবহর পাকিস্তানের পক্ষে নিয়োগের চেষ্ঠা করে। সর্বপরি সামরিক হস্তক্ষেপে চীনকে সম্মত করতে চেষ্ঠা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র 12ই ডিসেম্বরের মধ্যে যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে ভারতে হুমকি প্রদান করলে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নকে কাজে লাগিয়ে মার্কিনীদের কাছে থেকে সুকৌশলে কিছুটা সময় বের করে আনে। ইতিমধ্যে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়ে দেয় যে, তারা সরাসরি যুদ্ধে অংশ গ্রহনে বিরোধী তবে তারা জাতিসংঘে পাকিস্তানের পক্ষে সব রকম সাহায্য সহযোগিতা দিবে। 13 ডিসেম্বর চীন-যুক্তরাষ্ট্র মিলে নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব উপস্থাপন করলে তৃতীয়বারের মত সোভিয়েত ইউনিয়ন তাতে ভেটো প্রদান করে। ইতিমধ্যে সপ্তম নৌবহর নোঙ্গর করার সম্ভাব্য চট্রগ্রাম উপকূলের সকল জায়গা ভারতীয় নৌ, বিমান, ও স্থল বাহিনী দখল করে নিলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রধান কমান্ডার জেনারেল আব্দুল্লাহ নিয়াজী অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে পৌছানোর আগেই 16ই ডিসেম্বর বিকালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে নিয়াজী নিঃশর্ত ভাবে মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসর্মপন করে।
শেখ মুজিবের শাসনকালঃ
দেশ স্বাধীনের পর 1971 সালের 22 ডিসেম্বর ‘অস্থায়ী মজিব নগরস্থ’ সরকার ঢাকায় এসে শাসন ক্ষমতা দখল করেন। এর কয়েক দিন আগে 18 ডিসেম্বর 1971 তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মন্ত্রসভার `প্রথম বৈঠকে’ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন বাহিনী ও ভূতপূর্ব ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর সদস্যদের নিয়ে একটি ‘জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী” গঠন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়৤ 1972 সালের 8 জানুয়ারী শেখ মজিবর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে 10 জানুয়ারী স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন।  ১৯৭২-এর ২৪ জানুয়ারি তারিখে একটি ‘জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী’ গঠন ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার একটি আদেশ জারী করেন কিন্তু এরই মধ্যে পিলখানা গোলোযোগ এর কারণে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর সদস্যদের বাদ দিয়ে বিশেষ বাহিনী গঠন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়৤ এই অবস্থায় ১৯৭২ সালের ৮ মার্চ তারিখে জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠনের সরকারী আদেশ জারী করা হয়৤ এ. এন. এম নুরুজ্জামনকে এই বাহিনীর পরিচালক নিয়োগ প্রদান করা হয়। তৎপর কালবিলম্ব না করে শেখ মুজিব শাসনক্ষমতা স্ব-হস্তে ধারন করে একটি যুদ্ধবিধস্ত দেশকে পূর্নগঠনের কাজে হাত দেন। প্রথমেই তিনি অত্যন্ত সাফল্যের সাথে 1972 সালে স্বাধীন দেশের জন্য একটি ‘সংবিধান’ রচনা করেন। 1971 সালের 10ই এপ্রিলের ‘ঘোষনা পত্র’ অনুয়ায়ী তিনি দেশে ‘রাষ্ট্রপতিশাসিত’ শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন; পরবর্তীতে 1972 সালের ‘অস্থায়ী সংবিধান আদেশ’ দ্বারা দেশে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত উদ্যোগে 1972 সালের 12মার্চ ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করে। তিনি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ভারতসহ বিভিন্ন বন্ধুরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সাহায্য-সহযোগিতায় দেশের বিধ্বস্ত ও ধবংশ প্রাপ্ত রাস্তা-ঘাট, সেতু-কালর্ভাটও বিমাবন্দর পনূনির্মান করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ সহায়তায় চট্রগ্রাম নৌবন্দরে পাকিস্তানীদের পুতে রাখা মাইন অপসারনসহ নৌ-বন্দরটি পূননির্মান করেন। পাকিস্তানামলে প্রতিষ্ঠিত বহু ব্যাংক-বীমা জাতীয়করন করে একটি অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের পথ সুগম করেন। বঙ্গবন্ধু 25 বিঘা পযর্ন্ত জামির খাজনা মওকুফ এবং 100 বিঘার উপরে জমিওয়ালাদের জমি ভুমিহীনদের মাঝে বিতরন করেন। তিনি ঋনে জড়জড়িত কৃষকদের ঋন মওকুফের জন্য ‘খাইখালাসী’ আইন পাস করেন। এতদ্ব সত্যেও বিদেশ থেকে প্রেরনকৃত বিপুল পরিমান সাহায্য সময়মত সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হলে তা দুস্কৃতিকারীদের হাতে চলে গেলে 1972 সালেই দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। স্বাধীনতাত্তর দেশ শাসনের প্রকৃতি ও পরিধি নিয়ে ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন ‘ছাত্রলীগের‘ নেতাদের মধ্যে মতবিরোধের সৃষ্টি হয়। তৎকালীন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী এবং ঢাকসুর জি.এস রুহুল কুদ্দুস বঙ্গবন্ধু শেখ  মুজিব কর্তৃক গঠনকৃত ‘সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার’ সমর্থন করলেও ঢাকসুর ভিপি আ.স.ম আব্দুর রব এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারন সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রত্যাখান করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বামপন্থিদের নিয়ে ‘একটি বিপ্লবী’ সরকার গঠনের দাবি তুলেন। বাংলার রাজনীতির রহস্যময় নেতা সিরাজুল আলম খান তাদের ছায়া হিসাবে কাজ করেন। কিন্তু শেখ মজিবুর রহমান বিপ্লবী সরকার গঠনের ধারনা নাকুচ করে দিলে সিরাজুল আলমের আর্শীবাদ এবং পূষ্ঠপোষকতায় আ.স.ম আব্দুর রব ও শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বে 1972 সালের 31 অক্টোবর ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’ নামে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিরোধী রাজেনৈতিক দল (জাসদ) গঠিত হয়। বিরোধী দল হিসাবে তৎকালীন সময় ‘জাসদ’ এক যুগযুগান্ত্রকারী ভূমিকা পালন করে।
1972 সালে স্বাধীন দেশের জন্য একটি ‘সবসম্মত সংবিধান রচনা হবার পর সংবিধানের আলোকে সরকার পরিচালনার জন্য একটি ‘সর্বজনীন ভোটাধীকারের ভিত্তিতে নির্বাচনের প্রয়োজন দেখা দেয়। তাছাড়া বিরোধী রাজনৈতিক দল হিসাবে ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’ (জাসদ) এই সময়টিতে বিভিন্ন প্রকার রাজনৈতিক কর্মসূচী দিয়ে নবপ্রতিষ্ঠিত সরকারকে ব্যতি-ব্যাস্ত করে রাখে। 1972 সালের ডিসেম্বর মাসে ভাসানীর নেতৃত্বে দেশে গনতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘সাতদলীয় সংগ্রাম কমিটি’ গঠিত হয়। এতে আওয়ামীলীগ বিরোধী ন্যাপ (ভাসানী), বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, বাংলা জাতীয় লীগ, শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদীদল, বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টি (লেনিনবাদী), বাংলার কমিউনিষ্ট পার্টি, বাংলাদেশ সোসালিষ্ট পার্টি একযৌথ ইস্তেহারে শেখ মুজিবকে পদত্যাগ করে সর্বদলীয় সরকার গঠন, মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান, বিরোধী দলীয় নেতাদের মুক্তি এবং দেশের সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ এড়াতে ব্যাপকখাদ্য আমদানীর আহব্বান জানানো হয়। দেশের এই দুর্যোগপূর্ন মুর্হুতে ব্যাপকহারে স্বার্থবাদী, দুনীর্তিবাদ, মজুতদার, কালোবাজারী, চোরাকারবারীর উৎত্থান ঘটে। সমাজে একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসীর উদ্ভব ঘটে, তারা একের পর এক পুলিশ ফাড়িঁ আক্রমন, ব্যাংক লুট, ও ধনী জোতদাদের খামার লুন্ঠন করতে থাকে। সর্বোপুরী শ্রেনীশক্রু খতমের নাম করে রাজনৈতিক হত্যাকান্ডে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এদিকে সোভিয়েতপন্থি কিছু কমিউনিষ্ট নেতা শেখ মুজিবকে একদলীয় শাসন প্রবর্তনের জন্য চাপ সৃষ্টি করে কিন্তু আজীবন জনগনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল প্রধানমন্ত্রী শেখ মজিবুর রহমান 1973 সালের 7মাচ স্বাধীন বাংলাদেশের ‘প্রথম জাতীয় সংসদ’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষনা দেন। 7ই মার্চ 1973 সালে অনুষ্ঠিত  নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ব্যাপক ভোটে জয় লাভ করে। মোট 300টি আসনের মধ্যে তারা 293টি আসন লাভ করে। একপরিসংখ্যানে দেখা যায় 11জন জাতীয় সংসদ সদস্য অবাধে ভোটবিহীনভাবে জয় লাভ করে এই নির্বাচনে মোট ভোট সংগৃহীত হয়েছিল 54.9% এবং 14টি রাজনৈতিক দল এতে অংশ গ্রহন করে। মোট সংসদ সদস্য প্রাথী -1075জন। এই নির্বাচনের উল্লেখ্য যোগ্য আলোচনার বিষয় ছিল স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে আতাউর রহমানের জয় লাভ। কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিকনেতৃবৃন্দ এই নির্বাচনেও ভোটকারচুপির অভিযোগ করেন। (75’উত্তর একস্বাক্ষাৎকারে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলেন ’73 সালের নির্বাচনে 291টি আসনের স্থলে 191টি আসন পেলে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হারাতে হতো না; এবং বঙ্গবন্ধুও নিহত হতেন না”)
1973 সালের নির্বাচনের ফলাফলঃ
দলের নাম   ভোট   শতকরা হার   আসন
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ   13,798,717   73%   293
জাতীয় আওয়ামী পার্টি (মুজাফ্ফর)   1,569,299   8%   0
জাতীয় সমাজতান্ত্রীক দল (জাসদ)   1,229,110   7%   05
জাতীয় আওয়ামীলীগ পাটি (ভাসানী)   1,002,771   5%   0
স্বতন্ত্র   199,673   1%   01
বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টি   989,884   4%   01
অবৈধ/খালি ভোট   477,875   2%   
   19,329,683   100%   300
         
         
   

নির্বাচনে জয় লাভের পরপরই শেখ মজিবুর রহমান 1973 সালের 15ই জুলাই সংবিধানের প্রথম সংশোধনী এনে ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে গনহত্যা এবং যুদ্ধপরাধে লিপ্ত পাকিস্তানী সৈন্য ও অন্যান্যদের বিচারেরর আওতায় আনয়নের লক্ষে ‘ঘাতক দালাল আইন’ পাশ করেন। প্রথম সংশোধনীর দুইমাসের মাথায় তিনি দ্বিতীয় সংশোধনী এনে ‘দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষনার বিধান’ চালু করেন। বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দের দাবি মূলতঃ তাদের দমনের জন্যই শেখ মুজিব সরকার রাষ্ট্রের সমুদ্বয় ক্ষমতা স্ব-হস্তে ধারন করেন। শেখ মজিবের এই রুপ সিদ্ধান্তের ফলে ভাসানী ন্যাপের কিছুচীনাপন্থি নেতা এবং বামপন্থিরা ‘শেখ মজিব ও রুশ-ভারতবিরোধী’ বক্তব্য নিয়ে 1973 সালের 3 ডিসেম্বর ‘জাতীয় গনমুক্তি ইউনিয়ন গঠন করেন। যার সভাপতি ছিলেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ এবং সাধারন সম্পাদক ছিলেন শ্রমিক নেতা সিরাজুল আলম খান। 1973 সালের 24 ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি পদ থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চোধুরী পদত্যাগ করেন। তিনি তার পদত্যাগপত্রে শেখ মুজিবকে লেখেন ‘আপনার সাথে আলোচনার পর এবং জরুরী জাতীয় স্বার্থের তাগিদে আমি গনপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিপদ থেকে পদত্যাগ করছি। যাতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে 1971 সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যেভাবে বাংলাদেশের সেবা করতে প্রয়াসী ছিলাম; তেমনী আবার করতে পারি। অনেক কঠিন সমস্যা আজ জাতির সম্মূখে। একই রকম উদ্বিপনা সাধনায় ও কঠোর শ্রমে আপনার নেতৃত্বে জাতি যেন এসবেরও সমাধান করতে পারে; পরমকরুনাময় আল্লাহর দরবারে এই আমাদের ঐকান্তিক প্রাথর্না’। শেখ মুজিবুর রহমান তার পদত্যাগে মর্মাহত হন এবং বলেন ‘আমি অনেক ভেবেছি আমাকে অনেকেই এইকথা বলেছেন; আমার উপর তো রাগ করে অনেকেই বিদেশ চলে গেছেন; কিছু লোক আমাদের দেশের শত্রুতা করছে, থানা জ্বালিয়ে দিচ্ছে, লুটপাট করছে; এদের আমি কি ভাবে নিয়ন্ত্রন করব! তাই সিদ্ধান্ত নিযেছি বর্তমানে যে সরকার ব্যবস্থা আছে তাকে বাদদেব এবং ঐক্যমতের সরকার করে বহুদলীয় ব্যবস্থায় চলে যাব। এমতব্যস্থায় 1974 সালের মাঝামাঝি সময়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল “জাসদ’ সশ্রস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে শেখ মুজিব সরকার উৎখাতের ঘোষনা দিয়ে ‘গনবাহিনী নামে একটি বিপ্লবী সশ্রস্ত্র সংগঠন গড়ে তুলেন। বিরোধী দলের লাগামহীন আন্দোলন, সন্ত্রাস, লুটতরাজ, ভয়াবহবন্যা ওখাদ্যাভাব কারনে 1974 সালের 15 জানুয়ারী আওয়ামীলগের কাউন্সিলের উদ্বোধনী ভাষনে বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিবুর রহমান বলেন ‘যদি আজ জনগন আমাদের ভাল না বাসে; বাংলার জনগন যদি আজ আপনাদের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে; সে জন্য বাংলার জনগন দায়ী হবে না; দায়ী হবেন আপনারা; দেশ শাসন করতে হলে নিঃর্স্বাথ কর্মীর প্রয়োজন। হাওয়া কথায় চলে না। আত্মসমালোচনা করতে হয়। আত্মসমালোচনা করতে না পারলে নিজেকে চিনতে পারবে না। আত্ম শুদ্ধি কর; দেশের মঙ্গল করতে পারবা। তিনি দলের নেতৃত্ব ছাড়ার ঘোষনা দিয়ে বলে ছিলেন ‘কোন দিন স্বার্থে অন্ধ হয়ে তোমাদের ডাক দেই নাই। কোন লোভের বশবর্তী হয়ে কোন শয়তানের কাছে মাথানত করি নাই। বিশ্বাস করি; তোমরা আমার কথা শুনবা।
এর কিছুদিন পরই তিনি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী এনে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষে রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবষ্থার প্রবর্তনসহ ‘বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বা বাকশাল Bangladesh Krishak Sramik Awami League (BAKSHAL) নামে একটি ‘জাতীয় দল’ গঠনের ঘোষনা দেন। 1975 সালের 24শে ফ্রেরুয়ারী আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি একত্রিত হয়ে গঠিত হয় “বাকশাল”। তৎকালীন সময়ে তরুন ব্যারিষ্টার এবং আওয়ামীলীগের উদিয়মান এমপি মইনুল হোসেন সংসদে ‘বাকশালের’ তীব্র বিরোধীতা করে অসীম দুঃসাহস অপরাজেয় যৌবনের স্পর্ধায় শিড়দাড়া উচু করে সংসদে মন্ত্রের মত বলেন ‘গনতন্ত্রের প্রস্ফুটিত পুস্পপল্লবকে নির্দয়ভাবে দলিত-মথিত করে কর্তৃত্ববাদী একদলীয় শাসনের প্রতি আমার কোন আস্থা নাই। সংসদ সদস্যপদ আমার কাছে বড় নয়; যে বিশ্বাস নিয়ে জনগনের ভালবাসার ফুল কুড়াতে কুড়াতে আমি আইন সভায় এসেছি; সেই বিশ্বাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না বলেই ক্ষমতার কাছে নয় ; আমি ফিরে গেলাম জনগনের ভালবাসার কাছে (সেই অবস্থায় ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেন সংসদ থেকে পদত্যাগ করে গনতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসে নন্দিত নায়ক হয়েছিলেন) মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল (অব) এমএজি ওসমানীও একই কারনে পদত্যাগ করেন।
1975 সালের 19 জুন নবগঠিত দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক বাংলাদেশের সকল মহুকুমাগুলোর সমাপ্তি ঘোষনা করে 60টি জেলায় রুপান্তর করা হয় এবং প্রত্যেক জেলায় দলীয় বিবেচনায় একজন করে ‘জেলাপ্রশাসক’ নিয়োগ করা হয়। (টাংগাইল জেলার জেলাপ্রশাসক নির্বাচিত হয়েছিলেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী)
শেখ মুজিবের একদলীয় সরকার (বাকশার), ও শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে তৎকালীন সময়ে স্বদেশী এবং বিদেশী পত্রিকাগুলোতে ব্যাপক ঝড় উঠে।
1973 সালের 17 আগষ্ট দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম ছিল, “নিরাপত্তার আকুতি গ্রাম-বাংলার ঘরে ঘরে”। মূল খবরটি ছিল এরূপঃ “সমগ্র দেশে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতির ফলে এবং মানুষের জান-মাল ও ইজ্জতের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার অভাবে গ্রাম-গঞ্জ ও শহরবাসীর মনে হতাশার মাত্রা দিন দিন বাড়িয়াই চলিয়াছে এবং আইন রক্ষাকারী সংস্থার প্রতি মানুষের আস্থা লোপ পাইতেছে। অবস্থা এমন দাঁড়াইয়াছে যে, চুরি-ডাকাতি, লুঠ-তরাজ তো আছেই, রাজনৈতিক, সামাজিক ও বৈষয়িক কারণে শত্রুতামূলক হত্যাকান্ডের ভয়ে মানুষ বাড়ীঘর ছাড়িয়া অন্যত্র আশ্রয় লইতেছে। যাহারা বিত্তশালী তাহারা শহরের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ীতে এমনকি শহরের আবাসিক হোটেগুলিতে পর্যন্ত আসিয়া উঠিতেছেন। যাঁহাদের শহরে বাস করিবার সঙ্গতি নাই, তাহার বনে-জঙ্গলে অথবা এখানে-ওখানে রাত্রি কাটাইতেছেন”।
1973 সালে দৈনিক ইত্তেফাকের কিছু খবরের শিরোনাম ছিলঃ “ঝিনাইদহে এক সপ্তাহে আটটি গুপ্তহত্যা”(01/07/73 ); “ঢাকা-আরিচা সড়কঃ সূর্য ডুবিলেই ডাকাতের ভয়” (02/07/73) “বরিশালে থানা অস্ত্রশালা লুটঃ ৪ ব্যক্তি নিহত” (04/07/73); “পুলিশ ফাঁড়ি আক্রান্তঃ সমুদয় অস্ত্রশস্ত্র লুট” (12/07/73); “লৌহজং থানা ও ব্যাঙ্ক লুট”(28/07/73); “দুর্বৃত্তের ফ্রি স্টাইল” (01/08/73); “পুলিশ ফাঁড়ি ও বাজার লুটঃ লঞ্চ ও ট্রেনে ডাকাতি”(03/08/73); “এবার পাইকারীহারে ছিনতাইঃ সন্ধা হইলেই শ্মশান”(11/08/73);“চট্টগ্রামে ব্যাংক ডাকাতি,লালদীঘিতে গ্রেনেড চার্জে 18 জন আহত, পাথরঘাটায় রেঞ্জার অফিসের অস্ত্র লুট” (15/08/73); “খুন ডাকাতি রাহাজানিঃ নোয়াখালীর নিত্যকার ঘটনা,জনমনে ভীতি” (16/08/73); “20 মাসে জামালপুরে 1618টি ডাকাতি ও হত্যাকান্ড” (17/11/73); “আরও একটি পুলিশক্যাম্প লুটঃ সুবেদরসহ ৩ জন পুলিশ অপহৃত” (13/07/73);“যশোরে বাজার লুটঃ দুর্বৃত্তের গুলীতে 20 জন আহত” (18/08/74); “রাজশাহীতে ব্যাংক লুট”  “চালের অভাবঃ পেটের জ্বালায় ছেলেমেয়ে বিক্রি”-(গণকন্ঠ আগষ্ট 23, 1972) “লাইসেন্স-পারমিটের জমজমাট ব্যবসা; যাঁতাকলে পড়ে মানুষ খাবি খাচ্ছে; সিরাজগঞ্জ, ফেণী, ভৈরব, ইশ্বরগঞ্জ ও নাচোলে তীব্র খাদ্যাভাব, অনাহারী মানুষের আহাজারীঃ শুধু একটি কথা, খাবার দাও”- (গণকণ্ঠ আগস্ট 29, 1972) “গরীব মানুষ খাদ্য পায় নাঃ টাউটরা মজা লুটছে; গুণবতীতে চাল আটা নিয়ে হরিলুটের কারবার”-(গণকন্ঠ সেপ্টেম্বর 19, 1972) “একদিকে মানুষ অনাহারে দিন যাপন করিতেছেঃ অপরদিকে সরকারি গুদামের গম কালোবাজারে বিক্রয় হইতেছে”-(ইত্তেফাক এপ্রিল 7, 1973); “এখানে ওখানে ডোবায় পুকুরে লাশ।”(সোনার বাংলা এপ্রিল 15, 1973); “চালের অভাবঃ পেটের জ্বালায় ছেলেমেয়ে বিক্রি; হবিগঞ্জে হাহাকারঃ অনাহারে এ পর্যন্ত ৯ জনের মৃত্যু”-(গণকন্ঠ মে 3, 1973); “কোন এলাকায় মানুষ আটা গুলিয়া ও শাক-পাতা সিদ্ধ করিয়া জঠর জ্বালা নিবারণ করিতেছে”-(ইত্তেফাক মে 3,1973); “অনাহারে দশজনের মৃত্যুঃ বিভিন্নস্থানে আর্ত মানবতার হাহাকার; শুধু একটি ধ্বনিঃ ভাত দাও”-(গণকন্ঠ মে 10,1973); “লতাপতা, গাছের শিকড়, বাঁশ ও বেতের কচি ডগা, শামুক, ব্যাঙার ছাতা, কচু-ঘেচু পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের প্রধান খাদ্যে পরিণতঃ গ্রামাঞ্চলে লেংটা মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি”-(ইত্তফাক মে 10, 1973); “পটুয়াখালীর চিঠিঃ অনাহারে একজনের মৃত্যু;সংসার চালাতে না পেরে আত্মহত্যা”-(গণকন্ঠ মে 10,1973) “ওরা খাদ্যভাবে জর্জরিতঃ বস্ত্রাভাবে বাহির হইতে পারে না”-(ইত্তেফাক মে 30, 1973) “আত্মহত্যা ও ইজ্জত বিক্রির করুণ কাহিনী”-(গণকন্ঠ জুন 1, 1973) “স্বাধীন বাংলার আরেক রূপঃ জামাই বেড়াতে এলে অর্ধ-উলঙ্গ শ্বাশুরী দরজা বন্ধ করে দেয়”- (সোনার বাংলা জুলাই 15, 1973) “গ্রামবাংলায় হাহাকার, কচু-ঘেচুই বর্তমানে প্রধান খাদ্য”-(ইত্তেফাক এপ্রিল,1974); “দুঃখিনী বাংলাকে বাঁচাও”-(ইত্তেফাক আগষ্ট 4, 1974); “জামালপুরে অনাহারে 150 জনের মৃত্যুর খবর”-(ইত্তেফাক আগষ্ট 13, 1974) “10 দিনে জামালপুর ও ঈশ্বরদীতে অনাহার ও অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে 71 জনের মৃত্যু”-(গণকন্ঠ আগস্ট 27,1974)
1974 সালের 30 শে মার্চ গার্ডিয়ান পত্রিকা শেখ মুজিবের শাসনামল সর্ম্পকে লিখে, “আলীমুদ্দিন ক্ষুধার্ত। সে ছেঁড়া ছাতা মেরামত করে। বলল, যেদিন বেশী কাজ মেলে, সেদিন এক বেলা ভাত খাই। যেদিন তেমন কাজ পাই না সেদিন ভাতের বদলে চাপাতি খাই। আর এমন অনেক দিন যায় যেদিন কিছুই খেতে পাই না।” তার দিকে এক নজর তাকালে বুঝা যায় সে সত্য কথাই বলছে। সবুজ লুঙ্গির নীচে তার পা দু'টিতে মাংস আছে বলে মনে হয় না।
ঢাকার ৪০ মাইল উত্তরে মহকুমা শহর মানিকগঞ্জ। ১৫ হাজার লোকের বসতি। তাদের মধ্যে আলীমুদ্দিনের মত আরো অনেকে আছে। কোথাও একজন মোটা মানুষ চোখে পড়ে না। কালু বিশ্বাস বলল, “আমাদের মেয়েরা লজ্জায় বের হয় না-তারা নগ্ন।” আলীমুদ্দিনের কাহিনী গোটা মানিকগঞ্জের কাহিনী। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের কাহিনী,শত শত শহর বন্দরের কাহিনী। এ পর্যন্ত বিদেশ থেকে 50 লাখ টনেরও বেশী খাদ্যশস্য বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু যাদের জন্য পাঠানো হয়েছে তারা পায়নি।”
1974 সালের 27 সেপ্টম্বর তারিখে লন্ডনের নিউ স্টেট্সম্যান পত্রিকা লিখে-

“বাংলাদেশ আজ বিপদজনক ভাবে অরাজকতার মুখোমুখি। লাখ লাখ লোক ক্ষুধার্ত। অনেকে না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে। .. ক্ষুধার্ত মানুষের ভীড়ে ঢাকায় দম বন্ধ হয়ে আসে--। বাংলাদেশ আজ দেউলিয়া। গত আঠার মাসে চালের দাম চারগুণ বেড়েছে। সরকারি কর্মচারিদের মাইনের সবটুকু চলে যায় খাদ্য-সামগ্রী কিনতে। আর গরীবরা থাকে অনাহারে। কিন্তু বিপদ যতই ঘনিয়ে আসছে শেখ মুজিব ততই মনগড়া জগতে আশ্রয় নিচ্ছেন। ভাবছেন, দেশের লোক এখনও তাঁকে ভালবাসে; সমস্ত মুসিবতের জন্য পাকিস্তানই দায়ী। আরো ভাবছেন, বাইরের দুনিয়ী তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসবে এবং বাংলাদেশ উদ্ধার পাবে। নিছক দিবাস্বপ্ন.. দেশ যখন বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে, তখনও তিনি দিনের অর্ধেক ভাগ আওয়ামী লীগের চাঁইদের সাথে ঘরোয়া আলাপে কাটাচ্ছেন। তিনি আজ আত্মম্ভরিতার মধ্যে কয়েদী হয়ে চাটুকার ও পরগাছা পরিবেষ্টিত হয়ে আছেন। সদ্য ফুলে-ফেঁপে ওঠা তরুণ বাঙালীরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের শরাবখানায় ভীড় জমায়। তারা বেশ ভালই আছে। এরাই ছিল মুক্তিযোদ্ধা- বাংলাদেশের বীর বাহিনী। এরাই হচ্ছে আওয়ামী লীগের বাছাই করা পোষ্য। আওয়ামী লীগের ওপর তলায় যারা আছেন তারা আরো জঘন্য।  শুনতে রূঢ় হলেও কিসিঞ্জার ঠিকই বলেছেনঃ “বাংলাদেশ একটা আন্তর্জাতিক ভিক্ষার ঝুলি।”
1974 সালে 2রা অক্টোবর, লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় ‘জেকুইস লেসলী লিখেন,

“একজন মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, আর অসহায় দুষ্টিতে তার মরণ-যন্ত্রণাকাতর চর্মসার শিশুটির দিকে তাকিয়ে আছে। বিশ্বাস হতে চায় না, তাই কথাটি বোঝাবার জন্য জোর দিয়ে মাথা নেড়ে একজন ইউরোপীয়ান বললেন, সকালে তিনি অফিসে যাচ্ছিলেন,এমন সময় এক ভিখারি এসে হাজির। কোলে তার মৃত শিশু। ..বহু বিদেশি পর্যবেক্ষক মনে করেন বর্তমান দুর্ভিক্ষের জন্য বর্তমান সরকারই দায়ী। “দুর্ভিক্ষ বন্যার ফল ততটা নয়, যতটা মজুতদারী চোরাচালানের ফল”-বললেন স্থানীয় একজন অর্থনীতিবিদ। প্রতি বছর যে চাউল চোরাচালন হয়ে (ভারতে) যায় তার পরিমাণ 10 লাখ টন।”
1975 সালের 27জানুয়ারী লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রামে পিটার গিল লিখেন ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মজিবুর রহমান তার দেশে পার্লামেন্টারী গনতন্ত্রের শেষ চিহৃটুকু লাথি মেরে ফেলে দিয়েছেন। গত শনিবার (25-01-1975) ঢাকায় পার্লামেন্টের একঘন্টার অধিবেশনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোড়ে শেখ মুজিবকে প্রেসিডেন্ট ঘোষনা করেছে এবং একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য তাকে ক্ষমতা অপর্ন করেছে । অনেকটা নিঃশব্দে গনতন্ত্রের কবর দেয়া হয়েছে। এতে আরও উল্লেখ করা হয়, বাকশালের সাফাই গেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব এমপিদের বলেছেন ‘পার্লামেন্টারী গনতন্ত্র ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের অবদান। তিনি দেশের স্বাধীন আদালতকে ঔপনিবেশিক ও দ্রুত বিচার ব্যাহতকারী বলে অভিযুক্ত করেন’।
এতে আরও বলা হয় প্রেসিডেন্ট এখন খেয়াল খুশিমতো বিচারকদের বরখাস্ত করতে পারবেন। নাগরিক অধিকার যদি বিন্দুমাত্রও প্রয়োগ হয়-তা প্রয়োগ করবে নতুন পার্লামেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত স্পেশাল আদালত। এক্রিকিউটিভ অর্ডারের মাধ্যমে একটি ‘জাতীয় পার্টি’ প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন শাসনতন্ত্র মুজিবকে ক্ষমতা দিয়েছে। এটাই হবে দেশের একমাত্র বৈধপার্টি। যদি কোন এমপি যোগদান করতে নারাজ হন অথবা এর বিরুদ্ধে ভোট দেন তা হলে তার সদস্যপদ নাকচ হয়ে যাবে। সারাদেশে কবরের নিস্তদ্বতা। আতাউর রহমান খান থেকে শুরু করে বিরুধী দলের 8জন সদস্যের প্রায় সবাই সুবোধ বালকের মতো বাকশালে যোগ দিয়েছে। সামরিক-বেসামরিক সরকারী চাকুরে থেকে শুরু করে সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবি সকলেই লাইন ধরেছে বাকশাল অফিসের সামনে।   
1975 সালের 1লা ফ্রেরুয়ারী নয়াদিল্লির ‘টেষ্টসম্যান উইকলীতে ভারতের বিখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিষ্ট কুলদীপ নায়ার ‘শাসন ব্যবস্তা পরিবর্তন শিরোনামে’ লেখেন ‘শেখ মজিবুর রহমান জেনারেল ইয়াহিয়া স্বেচ্ছাচারী শাসনের বিরোধে সংগ্রাম করেছিলেন। কিন্তু আজ তিনি নিজেই রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছেন। ক্ষমতা দখল করতে গিয়ে তিনি নিয়মানুবর্তিতা, সমাজবিরোধীদল, বৈদেশিক চক্রান্ত প্রভূতি শব্দ ব্যবহার করে চলেছেন। যা একসময় পাকিস্তানী সামরিকচক্রও ব্যবহার করত। আর্শ্চয্য, বাংলাদেশ জন্মের আগে যে জনসাধারন এতো দুর্ভোগ সহ্য করেছে, তাদের কোন মতামত নেওয়া হয়নি। এমন কি আওয়ামী লীগ পালামেন্টারী পার্টিকেও কিছু জানতে দেওয়া হয়নি----। আগ থেকে সবকিছু জানিয়ে দিলে পার্টির ভেতর থেকে বিরোধীতা আসতো সম্ভবত, মুজিব সেটাই আশংঙ্খা করেছিলেন। অন্যথায় এ ধরনের ব্যাপক শাসনতান্ত্রিক সংশোধন প্রস্তাব একঘন্টার মধ্যে পার্লামেন্টে পাস হতো না এবং প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ উল্লাহও পার্লামেন্ট ভবনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে তা সই করতেন না। এই পটভুমিকায় কি করে মিসেস ইন্ধিরা গান্ধী এক মূর্হুত বিলম্ব না করে শেখ সাহেবকে খোশ আমদেদ্ জানালেন তা বুঝা মূশকিল। কূটনৈতিক শিষ্টাচার যাই হোক না কেন, বাংলাদেশের প্রতিটি কাজেই ভারতের সমথন করার কোন দরকার পড়ে কি?
1975 সালের 17আগষ্ট লন্ডনের সানডে টাইমস্-এ এন্থনী ম্যাসকারেনহাস ‘কিসে ভুল হল’ শিরোনামে এক লেখায় শেখ মুজিবুর রহমানের করুন পরিনামের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন ‘তার বিপর্যয়ের রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় প্রধানতঃ তিনটি উপকরন মিশে আছে। এন্থনীর ব্যাখ্যায় তিনটি উপকরনের মধ্যে দ্বিতীয়টিতে তিনি উল্লেখ করেছেন ‘মুজিব পতনের দ্বিতীয় প্রধান কারন হচ্ছে 1972 সালের রচিত বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্মের মর্যাদা থেকে সরিয়ে দেওয়া। ইসলামের মর্যাদার এই অবমাননা অনিশ্চয়তাসূচক প্রমানিত হয়েছে---।এই পটভূমিতে মুজিবের অনুসৃত ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাংলাদেশের জনগনের বৃহত্তম অংশকে আহত করেছে।
একথা সত্য যে, স্বাধীনতাত্তর বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা বিচার-বিশ্লেষন ও গবেষনার দাবি রাখে। তৎকালীন সময়ের উল্লেখযোগ্য সংবাদপত্র ‘ইত্তেফক’ পত্রিকাটি ব্যারিষ্টার মইনুল হকের, এবং ‘গনকন্ঠ’ জাসদের নিয়ন্ত্রনে ছিল। যারা সরাসরি শেখ মুজিব সরকার বিরোধী ছিলেন। আর বিদেশী পশ্চিমাপন্থি পত্রিকাগুলোও ঘটনা অতিরঞ্জিত করে বহি:বিশ্বে প্রকাশ করে। ফলে সাবির্ক দিক থেকেই মুজিব সরকার একটি সংকটাপূন অবস্থার স্বীকার হন। একথা নিঃসন্দেহে প্রানাধীকযোগ্য যে, শেখ মুজিব সরকারের মন্ত্রীসভা অত্যন্ত যোগ্য ও মেধাবী হলেও, মন্ত্রীদের মধ্যে নীতি ও আদর্শগত পাথর্ক্য ছিল লক্ষনীয়। অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মদ দেশে পূর্ন‘সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থ’ প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিলেন। অপরদিকে শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম ‘মিশ্র ব্যবস্থা’ এবং খোন্দকার মোস্তাক আহম্মদ ‘পুরোপুরি পুজিঁবাদী এবং উদারনৈতিক শাসন’ ব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিলেন। শেখ মজিবুর রহমান হঠাৎ করেই তাজউদ্দিনসহ তার মন্ত্রীপরিষদের 6জন সদস্যকে বহিস্কার করলে আওয়ামী লীগের অন্ত:দলীয় কোন্দল চরম আকার ধারন করে। ফলে এই সুযোগের সৎব্যবহার করে, কিছু স্বদেশী স্বাধীনতা বিরোধীচক্র। একথা সত্য যে, প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন অবস্থায়ই খোন্দকার মোস্তাক আহম্মদের সাথে পুজিঁবাদী বিশ্ব, (বিশেষ করে শেখ মুজিববিরোধী) আমেরিকার সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হয়। সময় ও সুযোগে তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ভিতরই ‘শেখ মজিবুর রহমান বিরোধী’ একটি শক্তিশালী উপদলের সৃষ্টি হয় যা আন্তজার্তিক সমথর্নে পরিপক্কতা লাভ করে। শেখ মুজিব একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতায় ‘প্রেসিডেন্ট অর্ডার নং 8 ও 9 ঘোষনার মাধ্যমে বেশ কিছু প্রভাবশালী আমলা এবং সেনাবিাহিনী থেকে মেজর ডালিম, মেজর নূর, ও মেজর শাহরিয়ারকে চাকুরিচুত্য করলে তারা গোপনে সরকারের বিরোদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে। সর্বোপুরি দেশের আইন-শৃংখলার চরম আবনতি, ভয়াবহ দুভির্ক্ষ ও বন্যায় সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়লে শেখ মুজিবের আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তায় ধস নামে। এই সুযোগে বিপদগামী সেনাবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র অংশ বিদ্রোহী হয়ে 1975 সালের 15ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্ব-পরিবারে হত্যা করে। তার সাথেসাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলের আবসান ঘটে।