গেরোটা কোনোভাবেই কাটানো গেল না। সেই ১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীরের পতন ঘটলেও বেকেনবাওয়ারের দেশের রক্ষণপ্রাচীরে চিড় ধরাতে পারল না ‘ফুটবল-ঈশ্বরের’ দেশের পদাতিকেরা। নব্বইয়ে ফাইনালে, ২০০৬ সালে কোয়ার্টার ফাইনালে, ২০১০ সালেও শেষ আটে জার্মানদের কাছে ভূপাতিত আর্জেন্টাইনরা।
রণাঙ্গন প্রস্তুত৷ আক্রমণে শোয়েনস্টেইগাররা। ৮৯ মিনিটে নীল-সাদাদের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিলেন মিরোস্লাভ ক্লোসা। ৪-০। মাঝমাঠ থেকে হেঁটে আসছেন পরাজিত বীর। পথে একটু দাঁড়ালেন। কোমরে রাখলেন দুহাত। এরপর দুহাতে হাঁটুতে ভর করে নুয়ে বসলেন কিছুক্ষণ৷ সজল চোখ। সব প্রাণশক্তি যেন উধাও। অবিশ্বাস্য। ফুটবল-জাদুকরকে এভাবে মুষড়ে পড়তে দেখে গ্যালারিও যেন স্তব্ধ। ‘সব হারানো’ মেসির ওই দৃশ্যটা দলীয় প্রতীকই হয়ে রইল মাচেরানোদের ২০১০ দক্ষিণ আফ্রিকা মিশনের।
বাঁশিতে শেষ ফুঁ রেফারির। আস্তে আস্তে মাথা নুইয়ে ড্রেসিংরুমের পথ ধরলেন মেসি। বিধ্বস্ত। হতবাক। ভাষাহীন। এমন অবস্থায় দলের কাউকে কখনো দেখেননি আর্জেন্টিনার ফিটনেস কোচ ফার্নান্দো সিনোরিনি, ‘তারা লাখ লাখ ডলার উপার্জন করে। কিসের অভাব? কিন্তু তারাই ড্রেসিংরুমে কান্না জুড়ে দিয়েছে। কান্নার রোল। পরাজয়ে তারা কতটা মুষড়ে পড়েছে, এটা তারই প্রমাণ।’
একরাশ হতাশা নিয়ে আবারও বুয়েনস এইরেসের বিমান ধরল তেভেজ, আগুয়েরা, ডি মারিয়ারা। মেসির বিদায়টা যেন সবচেয়ে বেদনাদায়ক। শূন্য হাতে ফেরাল তাঁকে আফ্রিকা। কোনো গোল নেই৷ যেন আকাশ থেকে নক্ষত্রের পতন।
অথচ ক্লাবের হয়ে কতই না উজ্জ্বল। ২০০৯-১০ মৌসুমে ৪৭টি গোল। আগের যেকোনো মৌসুমের চেয়ে বেশি৷ লা লিগা, প্রিমিয়ার লিগ, সিরি ‘আ’, বুন্দেসলিয়া—কোথাও কারও এমন সাফল্য নেই। সাফল্যের মুকুটে আছে ব্যালন ডি’অর ট্রফিও। কাতালানদের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে ১০০ গোল করার রেকর্ডও তাঁর অধিকারে।
ক্লাবে এমন দাপুটে সাফল্য বিশ্বকাপেও মঞ্চস্থ হবে—এমন প্রত্যাশা ছিল পক্ষ-বিপক্ষ সবার। বার্সার জার্সি গায়ে কী অসাধারণ পারফরম্যান্স! ফুটবল-জাদুকরে মুগ্ধ কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রোও, ‘বজ্রের মতো গতি। অবিশ্বাস্য গতিতে বল নিয়ে ছোটে ও৷ যেন বিস্ফোরক৷ মাথা ও পা দুটোই সমান চলে।’
গ্রুপপর্বে নাইজেরিয়ার িবপক্ষে কষ্টার্জিত ১-০ গোলের জয়। পরের ম্যাচেই দক্ষিণ কোরিয়া বিধ্বস্ত। ৪ গোল। গ্রিসের সঙ্গে ব্যবধানটাও ২-০। শেষ ষোলোয় মেক্সিকো বাধা। কিন্তু ৩-১ গোলে জিতে সেই বাধা টপকে মাথা উঁচু করেই কোয়ার্টার ফাইনালে ম্যারাডোনার শিষ্যরা। এবার প্রতিপক্ষ–সেই জার্মানি। প্রকাশ্যে না বললেও ক্লোসাদের মুখোমুখি হতে চাননি ডেমিচেলিসরা৷ পেশিই যাঁদের মারণাস্ত্র, তাঁদের সঙ্গে লড়ে সাধ্য কার? আবারও শক্তির কাছে শিল্পের হার৷ আর্জেন্টিনাও পরাস্ত৷ ৪-০ গোলের লজ্জা৷
বিশ্বকাপে হতাশাজনক পারফরম্যান্সের কারণে ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিতেও ভাটা৷ নাইজেরিয়ার সঙ্গে প্রথম ম্যাচের পর থেকেই তাঁর ইমেজে একটু একটু করে টান৷ সবার চোখে যিনি ছিলেন অতিমানব, সুপারম্যান৷ জার্মানির সঙ্গে ম্যাচের পর সেই মানুষগুলোই বিশ্বাস করতে শুরু করল, মেসি আর দশজন সাধারণ ফুটবলারের মতোই৷ এর বেশি কিছু নন৷
জার্মানির সঙ্গে ম্যাচের পর ম্যারাডানা বললেন, ‘আমার জীবনের কঠিনতম মুহূর্ত৷ সত্যিকারের এক আঘাত৷’ কিন্তু মেসি কিছুই বললেন না৷ তবে কয়েক দিন পর তাঁর বরাত দিয়ে একটি ব্লগে বলা হয়, ‘আমার ভীষণ খারাপ লাগছে৷ আমি বাড়ি যেতে চাই৷ আমরা খারাপ খেলেছি৷ আমরা সবার প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছি৷ আমাদের আবার নতুন করে শুরু করতে হবে৷’
নিঃশ্বাস-দূরত্বে আরেকটি বিশ্বকাপ৷ দুবার হোঁচট খাওয়া মেসি এবার নিশ্চয়ই চাইবেন জার্মান গেরোটা খুলে ফেলতে৷
সূত্র: বিভিন্ন সময়ে প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন, একাধিক ওয়েবসাইট ও লুকা কাইয়োলির বই মেসি৷