মহান আল্লাহর মহানিদর্শন। পৃথিবীতে যত আশ্চর্যজনক সৃষ্টি রয়েছে তার অন্যতম। পবিত্র কাবার দ্বারপ্রান্তে অবস্থিত জমজম। আল্লাহ তায়ালার কুদরতে এর পানি কখনো নিঃশেষ হয় না। হজরত ইব্রাহিম আ: আল্লাহর নির্দেশে বিবি হাজেরা ও ছেলে ইসমাইলকে মক্কার বিজন এলাকায় রেখে যাওয়ার পর যখন তাদের সামান্য খাবার নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল এবং দুগ্ধপোষ্য শিশু ইসমাইল আ: তৃষ্ণায় ছটফট করছিলেন, তখন হাজেরা আ: ব্যাকুল হয়ে সাফা-মারওয়ায় ছোটাছুটি করছিলেন। আল্লাহ তার এ ব্যাকুলতা দেখে জিব্রাঈল আ:-কে পাঠিয়ে দেন এবং জিব্রাঈল আ: স্বীয় পাখার আঘাতে ইসমাইল আ:-এর পায়ের নিচ থেকে এ কুদরতি ঝরনা নিঃসরণ করেন। হাজেরা আ: ফিরে এসে যখন দেখলেন-শিশু ইসমাঈল শুয়ে আছে, আর তার পাশ দিয়ে পানির ফোয়ারা ছুটে চলেছে; তখন তিনি চার দিকে বাঁধ দিয়ে আটকাতে লাগলেন। ধারণা করা হয়, বিবি হাজেরা আ: যদি ওই দিন পানি না আটকাতেন তাহলে পুরো দুনিয়া সয়লাব হয়ে যেত।
এটা প্রায় চার হাজার বছর আগের কথা। কিন্তু এর কয়েক শতাব্দী পর হঠাৎ করে কূপের পানি বন্ধ হয়ে যায়। তখন কাবার তত্ত্বাবধানে ছিল জারহাম গোত্র। তারা শেষ দিকে এসে কাবার সম্মানের কথা ভুলে যায় এবং তার প্রতি নানা বেয়াদবি ও অন্যায় আচরণ করতে থাকে। তাদের এহেন গর্হিত কাজ সহ্য না করতে পেরে ‘খোজায়া’ গোত্রের লোকেরা জারহামদের ওপর আক্রমণ চালায় এবং হেরেম থেকে তাদের বের করে দেয়। যাওয়ার সময় তারা কূপটিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে যায়। সেই থেকে প্রায় পাঁচ শ’ বছর জমজম কূপটি অজ্ঞাত অবস্থায় পড়ে থাকে। কেউ তার সন্ধান দিতে পারেনি। খ্রিষ্টীয় চার শতাব্দীতে এসে রাসূলুল্লাহ সা:-এর পিতামহ হজরত আবদুল মুত্তালিব কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া সেই কূপ পুনরুদ্ধার করেন। এটি তাঁর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এক রাতে তিনি কাবার আঙ্গিনায় শায়িত অবস্থায় স্বপ্নে দেখেন যে, একজন লোক তাকে প্রথম রাতে ‘তাইবা’, দ্বিতীয় রাতে ‘বাররা’ এবং তৃতীয় রাতে ‘মজনুনা’ খনন করার নির্দেশ দিয়ে অন্তর্হিত হয়ে গেলেন। ওইগুলো কী জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর পেলেন না। এই তিনটি শব্দই জমজম কূপের নাম। ‘তাইবা’ অর্থাৎ পবিত্র, ‘বাররা’ অর্থাৎ নেক, আর ‘মজনুনা’ অর্থাৎ সংরতি। এরপর চতুর্থ রাতে আবার ওই ব্যক্তি এসে তাকে জমজম কূপ খননের নির্দেশ দিলেন। আবদুল মুত্তালিব জিজ্ঞেস করলেনÑতা কী? উত্তর এলো-‘যার পানি কখনো নিঃশেষ হয় না, যার তলদেশ পাওয়া যায় না, যা হাজীদের পানি সরবরাহ করে, রক্ত ও গোময়ের মধ্যে, শুষ্ক বধারী কাকের ঠোকরের কাছে, নামল বন্তীর পার্শ্বে।’ এ নির্দেশ পেয়ে তিনি ঘুম থেকে জেগে একমাত্র ছেলে হারেসকে সাথে নিয়ে স্বপ্নে নির্দেশিত স্থানে গেলেন। খননকার্য শুরু করলেন। প্রথমে কূপটির সামান্য চিহ্ন পরিলতি হলো। এ সময় কুরাইশরা দাবি জানাল, এটা তাদের পূর্বপুরুষ হজরত ইসমাইল আ:-এর কূপ; এতে তাদের অধিকার রয়েছে; খনন কাজে তাদেরও শরিক করতে হবে। পরে অবশ্য আপসে তারা এ কাজের জন্য আবদুল মুত্তালিবকেই যোগ্য মনে করেন। আবদুল মুত্তালিব কূপ খননকালে তার মধ্যে ‘নাজেদ’ নামক একটি মূর্তি পরিত্যক্ত অবস্থায় পান। মূর্তিটি জমজম কূপ থেকে সরিয়ে ফেললে পানিপ্রবাহ আবার শুরু হয়। এ মূর্তিটি রেখে গিয়েছিল জারহাম গোত্রের লোকেরা। তাদের এ নাফরমানির দরুন আল্লাহ জমজমের পানি বন্ধ রেখেছিলেন। আবদুল মুত্তালিবের সময় কূপের গভীরতা ছিল মাত্র ১৪ ফুট। খলিফা মামুনুর রশীদের আমলে আবার তা খনন করা হয়। এ সময় পানির নিঃসরণ খুব বেড়ে গিয়েছিল। এমনকি কূপের বাইরে উপচে পড়া শুরু করেছিল। দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী পর সৌদি সরকার আধুনিক মেশিনের সাহায্যে কূপকে পুনঃখনন করেন। দু’জন ডুবুরি কূপের তলদেশে গিয়ে পরীা-নিরীা করে দেখেন, সেখানে রঙ- বেরঙের মাটির স্তর জমাট বেঁধে আছে, আর অবিরাম নির্গত পানিকে পরিশোধন করছে। তারা আল্লাহর এ কুদরত দেখে বিস্মিত হয়ে যান। বর্তমানে জমজম কূপের গভীরতা ৫১ ফুট। হাজীদের সুবিধার্থে ইদানীং কাবার সম্মুখে কূপের অদূরে নারী-পুরুষের জন্য পৃথক দু’টি স্থান তৈরি করা হয়েছে। দৈনিক অগণিত আল্লাহর মেহমান লাখ লাখ হাজী কাতার বেঁধে সেখান থেকে তৃপ্তি পুরে পানি পান করছেন।