বৈষম্যের পরও আইসিটি খাতে নারীদের সম্ভাবনা যথেষ্ট। বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশে এ সুযোগের সম্ভাবনা আরও বেশি। কারণ অর্থনীতিতে তুলনামূলক পিছিয়ে থাকা দেশের নারীরা আইসিটি খাতের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার গুরুত্ব বুঝতে পারছেন এবং এ খাতেই কর্মজীবন ও পেশাজীবন গড়ার কথা ভাবছেন।
এক দশক আগেও আইসিটি বা তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে একচেটিয়া বিচরণ ছিল পুরুষদের। মূল কারণ এ খাতের শিক্ষা, সেবা ও ব্যবসায় যারা নিয়োজিত ছিলেন, তাদের বেশিরভাগই ছিলেন পুরুষ। কিন্তু এখন আর সে অবস্থা নেই। ধীরে ধীরে হলেও এ চিত্র পাল্টেছে। বাংলাদেশের নারীরা এগিয়ে এসেছেন তথ্যপ্রযুক্তিতে। যদিও পোশাক শিল্প, ক্ষুদ্রঋণ, চিকিত্সাসেবা, শিক্ষকতা, গবেষণা, ব্যাংকিংসহ অন্যান্য খাতে নারীর পদচারণা তুলনামূলকভাবে অনেক বেড়েছে। এমনিতেই বাংলাদেশে মোট কর্মসংস্থানের মাত্র শতকরা ৪ ভাগ তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত। সেখানে নারীর অবস্থান তো খুঁজে না পাওয়ারই কথা। আশার কথা— নারীরা এ খাতে অংশগ্রহণে কম হলেও যোগ্যতায় পিছিয়ে নেই। তবে যেটুকু হয়েছে প্রায় সবটুকুই বেসরকারি খাতে। কম্পিউটার কৌশল, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলের মতো বিষয়গুলো নারীদের তেমন অংশগ্রহণ এখনও চোখে পড়ার মতো নয়।
এতসব বৈষম্যের পরও আইসিটি খাতে নারীদের সম্ভাবনা যথেষ্ট। বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশে এ সুযোগের সম্ভাবনা আরও বেশি। কারণ অর্থনীতিতে তুলনামূলক পিছিয়ে থাকা দেশের নারীরা আইসিটি খাতের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার গুরুত্ব বুঝতে পারছেন এবং এ খাতেই কর্মজীবন ও পেশাজীবন গড়ার কথা ভাবছেন।
বেসিস আউটসোর্সিং অ্যাওয়ার্ড ২০১৪, এবারের সেরা নারী ফ্রিল্যান্সার হিসেবে সম্মাননা পেলেন সুলতানা পারভীন, সায়মা মুহিব ও মাহফুজা সেলিম। তরুণ ফ্রিল্যান্সারদের কাজের স্বীকৃতি দিতে সম্প্রতি চতুর্থবারের মতো সম্মাননা দিয়েছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড সার্ভিসেস (বেসিস)। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, জেলা পর্যায়ে ও নারী বিভাগে দেয়া হয়েছে মোট ১০০টি আউটসোর্সিং অ্যাওয়ার্ড।
দুনিয়ার প্রায় সব দেশেই কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে প্রচুর কর্মসংস্থান। পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোতেও উচ্চ প্রযুক্তির দক্ষ কর্মীর যথেষ্ট অভাব। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার হিসাবেও দেখা যায়, দিন দিন বিশ্ব আইসিটির বাজারের পরিমাণ বেড়েই যাচ্ছে। ফলে সৃষ্টি হবে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ। হয়তো আইসিটিতে পুরুষদের তুলনায় নারীরা পিছিয়ে আছে। কিন্তু ইন্টারনেট ব্যবহারে মোটেই পিছিয়ে নেই। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৬ থেকে ৫৪ বছর বয়সী ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নারী ও পুরুষদের সংখ্যা প্রায় সমান। কাজেই আইসিটি খাতে ওয়েবভিত্তিক অনেক কাজ আছে যেগুলো ঘরে বসেই করা যায়। যেহেতু ইন্টারনেট ব্যবহারে পিছিয়ে নেই, তাই এ ধরনের কাজ করার সুযোগ নারীদেরই বেশি।
তথ্যপ্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো ও নারী সচেতনতার জন্য বেশকিছু পদক্ষেপও নিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় মহিলা সংস্থার একটি প্রকল্প ছিল ‘জেলাভিত্তিক মহিলা কম্পিউটার প্রশিক্ষণ’। ১৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল ১৫ হাজার শিক্ষিত মহিলাদের তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার মাধ্যমে কর্মসংস্থান এবং যোগাযোগ প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা। তিন বছর মেয়াদি এ প্রকল্প ছিল ২০০৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত।
জাতীয় মহিলা সংস্থার একটি প্রকল্প ‘তথ্য আপা’। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন প্রকল্প এটি। প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য— নারীর ক্ষমতায়নে তাকে তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করা। তথ্য ও জ্ঞানের রাজ্যে নারীর সহজ প্রবেশ নিশ্চিত করবে তথ্যপ্রযুক্তির হালনাগাদ ব্যবহার। প্রকল্পের প্রধান লক্ষ্য একটি ডিজিটাল তথ্যভাণ্ডার সৃষ্টি, যেখানে সর্বস্তরের নারীর প্রবেশ ও তথ্য পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত হবে।
জানা গেছে, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে আইসিটিতে নারীদের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর জন্য কাজ করেছে ডিনেট। এ প্রতিষ্ঠানটির তথ্যকল্যাণী বা ইনফোলেডি প্রকল্প ব্যাপক সাড়াও ফেলেছে। সাইকেল চালিয়ে একজন তরুণী মানুষের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। সঙ্গে ল্যাপটপ বা নেটবুক। ইন্টারনেটের মাধ্যমে তিনি কখনও স্বাস্থ্যসেবা দেন, আবার কখনও গ্রামের মেয়েদের বা স্কুলের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের কম্পিউটার ব্যবহার শেখান। এদের নাম ‘ইনফো-লেডি’ বা ‘তথ্যকল্যাণী’। তথ্যকল্যাণীরা তথ্য প্রযুক্তিভিত্তিক সেবাকে নিয়ে যাচ্ছেন সরাসরি গ্রামীণ জনগণের দরজায়।
নানা বাধা পেরিয়েও দেশের আইসিটি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা নারীর সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নিয়োজিত নারীরা নিজেদের অবস্থা সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলছেন। বাংলাদেশেও গড়ে উঠছে এমন সংগঠন। তেমনি একটি ‘বাংলাদেশ উইমেন ইন টেকনোলজি’ বা বিডব্লিউআইটি। সংগঠনটির নারীরা কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশের আইসিটি খাতের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশে প্রযুক্তি খাতে পেশাগতভাবে জড়িত নারীদের এখন পর্যন্ত প্রধান সংগঠন এটি। সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য আইটি খাতের সঙ্গে জড়িত নারীদের একত্রিত করে তাদের পরিচিতির ব্যবস্থা করা। সঙ্গে সঙ্গে তাদের জন্য নতুন নতুন সুযোগ তৈরি করা। সংগঠনটি তরুণীদের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে এবং এই শিল্পে উদ্যোগী হতে উত্সাহিত করে থাকে। নারী উদ্যোক্তা এবং পেশাজীবীদের আইসিটিতে সাফল্য অর্জনের জন্য নেতৃত্ব গুণাবলিসহ অন্যান্য দক্ষতা বাড়ানোর সর্বাত্মক চেষ্টাও করা হয় এই সংগঠনটির পক্ষ থেকে। কাজেই যে নারীরা বাংলাদেশের আইসিটি খাতের সঙ্গে যুক্ত তারা খুব সহজেই বিডব্লিউআইটির সদস্য হতে পারেন।
সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কোনো জোরালো ভূমিকা নেই। এই খাতে নারীরা যে পিছিয়ে পড়ছে এজন্য যে পরিমাণ জন সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন তা যাচ্ছে না। দেখা যায় দেশে কারিগরি জ্ঞান প্রশিক্ষণ দেয় যেসব প্রতিষ্ঠান আছে সেখানে পুরুষের সমানতালে নারীরা আসছে না। এর জন্য সরকারপক্ষ কিংবা বিভিন্ন এনজিও নারী উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে অনেক সংস্থা বাংলাদেশে আছে। তারা নারীদের তথ্য প্রযুক্তি খাতে নারীদেরকে পুরুষের পাশাপাশি এগিয়ে আসার জন্য কাজ একেবারেই কম। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অল্প শিক্ষিত নারীরা স্বল্প কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়ে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্টসহ বিভিন্ন কাজে সাফল্য আনছে। নারীর পূর্ণ ক্ষমতায়ন প্রযুক্তি জ্ঞান ছাড়া সম্ভব হবে না। এর জন্য আইসিটি খাতে নারীদেরকে এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে আইন করে হলেও আইসিটিতে নারীদের এগিয়ে আসতে নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশের জনসংখ্যা অর্ধেক নারী। এই বিশাল জনশক্তিকে প্রযুক্তির জ্ঞানে জ্ঞানী করতে পারলে তারা আমাদের বোঝা হবে না তারা হবে দেশের সম্পদ। আমাদের দেশে অনেক নারী ঘর থেকে বের হতে চায় না। তাদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিয়ে ইন্টারনেটের নিজের ঘরে বসে আউটসোর্সিং ফ্রিল্যান্সিং করে দেশি-বিদেশি প্রচুর মুদ্রা অর্জন করতে পারবে। স্বল্প শিক্ষিত নারীদের সামান্য প্রশিক্ষণ দিতে পারলে ভালো একটি সফলতা পাওয়া যাবে।
আমাদের দেশে গ্রামগঞ্জের পিছিয়ে পড়া অল্প শিক্ষিত নারীদের আইসিটি খাতে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাদের হাতকে কাজে লাগাতে হবে। তাহলে আগামীতে আমাদের অর্থনীতিতে জাতীয় উন্নয়নে নারীর সাফল্য পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাবে। জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির বাড়বে। নারীদের উন্নয়ন করতে হলে এখনই আইসিটি খাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। নারীদের বাদ দিয়ে আইসিটি খাতে উন্নয়ন আনা যাবে না। আর বর্তমানে যুগে আইসিটি খাতের উন্নয়ন ছাড়া পৃথিবীর স্বল্প উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পিছিয়ে পরবে। আইসিটি খাতে একজন নারী যদি তার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারেন তবে সামাজিক ধ্যান-ধারণা, ধর্মীয় গোঁড়ামি অনেকাংশে কমে আসবে। ঘরে বসেই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে। নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে হলে তথ্য প্রযুক্তি খাতে নারীর অংশগ্রহণ জরুরি। সাম্প্রতিক সময়ে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অনেক পরিবর্তন ঘটছে। তরুণ সমাজ এখন সামজিক সাইটের মাধ্যমে তথ্যের আদান-প্রদান করছে। তবে এত কিছুর পরেও এখানে একটি ‘জেন্ডার ডিভাইড’ রয়ে গেছে। এই প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হলে গ্রামগঞ্জের আইসিটি খাতে নারীদেরকে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণসহ যাবতীয় উদ্যোগ সরকারের নিতে হবে।
(একে/নভেম্বর ১৯, ২০১৪) - See more at:
http://www.dailybartoman.com/details.php?id=32249#sthash.jFQ8LAkT.RGKy5JCx.dpufSource:http://www.dailybartoman.com/details.php?id=32249