বাবা মারা যাওয়ার পর এক বছর। বাবার মৃত্যুর দিনটি বড়ই বেদনার নিশাদের জন্য। সাত বছরের নিশাদের স্মৃতিজুড়ে কেবলই তার বাবা। তাই, ঘুম থেকে উঠেই বাবাকে ভালো থাকার বার্তা জানিয়ে চিঠি লিখেছে। হুমায়ূনপুত্র বাবার প্রতি চিঠিতে লিখেছে, আই লাভ ইউ বাবা। পুষপস্তবকের সঙ্গে জড়িয়ে এই চিঠি খানাও বাবার কবরে রাখে নিশাদ। শুধু কি নিশাদ একা? গতকাল হুমায়ূন ভক্তরাও এভাবে হৃদয়ের সবটুকু ভালবাসা দিয়ে স্মরণ করেছেন প্রিয়
লেখককে। নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালিত হয়েছে নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। পরিবারের লোকজনের পাশাপাশি প্রিয় লেখককে স্মরণ করছেন, তাঁর ভক্ত অনুরাগীরা। সকালে গাজীপুরের শাল গজারি বেষ্টিত পিরুজালী গ্র্রামের নুহাশ পল্লীতে হুমায়ূন আহমেদের সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান লেখকের ভক্তরা। কবর জিয়ারত, ফাতেহা পাঠ, কোরআনখানিসহ নানা অনুষ্ঠান ও সর্বস্তরের মানুষের ফুলেল শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় স্মরণ করা হয় হুমায়ূন আহমেদকে। দিনটি উপলক্ষে নুহাশ পল্লীতে দোয়া ও ইফতারের আয়োজন করেন মরহুমের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন। হুমায়ুন আহমেদ নেই। কিন্তু তার সৃষ্টি অমর হয়ে আছে ভক্তদের মাঝে। তাইতো, হুমায়ুন আহমেদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার সৃষ্ট চরিত্রগুলো হুমায়ুনের চারপাশে ঘিরে ছিলেন। হিমুরা যান হলুদ পাঞ্জাবি আর রুপারা নীল শাড়ি পরে প্রিয় লেখকের সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে। শুক্রবার সকাল থেকেই হুমায়ুন ভক্তরা দলে দলে আসতে থাকেন নুহাশ পল্লীতে। অনেকে হলুদ পাঞ্জাবি পরে হিমু বেশে কবর জিয়ারত করেন, ফুলেল শুদ্ধা জানান অন্তর থেকে। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান বরেণ্য লেখক, প্রকাশক, অভিনেতাসহ বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ। সকাল সাড়ে ১১টায় ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন হুমায়ুন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন। তার সঙ্গে দুই শিশুপুত্র নিশাদ ও নিনিদসহ নুহাশ পল্লীর কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন। শাওন কবরের পাশে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন এবং ফাতেহা পাঠ করে মরহুমের আত্মার শান্তি কামনা করে মোনাজাত করেন। দিনে কয়েকবার লোকজনের সঙ্গে তিনি ছুটে যান তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি যেখানে ঘুমিয়ে আছেন, সেখানে। কবর জিয়ারত শেষে শাওন সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, হুমায়ুন আহমেদ সব সময় আনন্দের অনুষ্ঠান করতে পছন্দ করতেন, দুঃখের কোন অনুষ্ঠান করতেন না। এজন্য তার মৃত্যুবার্ষিকীতে আনুষ্ঠানিক কোন অনুষ্ঠান থাকছে না। হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকতে তার পিতার মৃত্যুবার্ষিকীতে অনাড়ম্বর একটি মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করতেন। উনি জুমা দিনের আয়োজনকে পছন্দ করতেন। উনি যেটা পছন্দ করতেন সেভাবেই নুহাশ পল্লীতে ৪-৫শ’ এতিমদের সঙ্গে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। একটি বছর শুধুমাত্র হিসাব করার দিন মাত্র। ২০১২ সালের ১৯শে জুলাইয়ের পর প্রতিটি মুহূর্ত একই রকম খারাপ। আজকের দিনটা আলাদা কোন দিন না। আমার ছেলে যখন আমাকে প্রশ্ন করে বাবা কি এতগুলো ফুল নিতে আসবে, তখন আমার কোন জবাব থাকে না। তাই হুমায়ূনশূন্য প্রতিটা রাত প্রতিটি মুহূর্তের অনুভূতি- যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। হুমায়ূন আহমেদের মা ও স্বজনরা অনুষ্ঠানে নেই কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে শাওন বলেন, তাদের দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসেন হুমায়ূনের পারিবারিক বন্ধু ও প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম। এ সময় তার সঙ্গে লেখক শাকুর মজিদ, অনন্যা প্রকাশনীর মনিরুল হক, কাকলী প্রকাশনীর নাসির আহম্মেদ, সময় প্রকাশনীর ফরিদ আহম্মেদ, মাওলা ব্রাদার্স, প্রতীক, অবসর, বাংলা প্রকাশ, অন্বেষাসহ ১৫টি প্রকাশনীর লেখক ও প্রকাশকগণ উপস্থিত ছিলেন। তারা হুমায়ূনের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকার পর মোনাজাতে অংশ নেন। মোনাজাত শেষে মাজহারুল ইসলাম বলেন, সৃজনশীল মানুষদের মৃত্যু নেই। তারা তাদের কর্মের মাধ্যমে বেঁচে থাকেন। হুমায়ূন আহমেদ ও তার সৃষ্টিশীল কাজের মধ্যে বেঁেচ থাকবেন।
দুপুরে শাওন আবারও তার মা ও অন্যান্য অতিথিদের সঙ্গে কবর জেয়ারত করতে আসেন। তাদের সঙ্গে ছিল শিশুপুত্র নিশাদ ও নিনিদ। নিশাদ কবরের কাছে বসে গভীর মমতায় কবরের ওপর হাত বুলাতে থাকে। এসময় এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। পরে অবুঝ মনের দু’টো হাত তুলে প্রার্থনা করে সবার সঙ্গে। প্রার্থনা শেষে সাংবাদিকদের নিশাদ জানায়, সে তার বাবাকে নিয়ে ছবি এঁেকছে এবং চিঠি লিখেছে। চিঠিতে কি লিখেছ- এমন প্রশ্নের জবাবে নিশাদ বলে ‘আই লাভ ইউ বাবা’।
শাওনের পিতা প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলী জানান, স্বামীর মৃত্যুর পর পরিবারের হাল ধরতে শাওন নাটক পরিচালনার পাশাপাশি আর্কিটেকচারের কাজও করছেন। তিন বন্ধুর সঙ্গে গুলশানে ডটস লিমিটেড নামে একটি ফার্মও খুলেছেন ৮-৯ মাস আগে। বইয়ের রয়্যালিটি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাঙালি একটি মেয়ের স্বামী মারা গেলে কেউ সহজভাবে নেয় না। তাকে বহু বাধা বিপত্তি অতিক্রম করতে হয়। লেখকের একেক বই একেক জনের নামে স্বত্ব দেয়া আছে। রয়্যালিটি পেতে তাই উভয়পক্ষকে একটি সমঝোতায় বসতে হবে।
কবরকে ঘিরে তৈরি করা কমপ্লেক্সের ব্যাপারে নুহাশ পল্লীর ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম বুলবুল জানান, হুমায়ূন আহমেদের কবরকে ঘিরে একটি কমপ্লেক্স তৈরি করা হয়েছে। এতে মূল কবর মার্বেল পাথর দিয়ে পাকা করার কাজ শেষ হয়েছে, যাতে ১৬ ফুট লম্বা ও ১২ ফুট প্রশস্ত সাদা মার্বেল পাথর বসানো হয়েছে। স্বামীর কবর জিয়ারত ও বাঁধাইয়ের কাজ তদারকির জন্য বুধবার মধ্য রাতেই নিশাদ ও নিনিদকে সঙ্গে নিয়ে নুহাশ পল্লীতে এসে অবস্থান করেন শাওন। ইতিমধ্যে কমপ্লেক্সে কাঁচ ও লাইটের কাজ শেষ করা হয়েছে। কবরের চারপাশে গ্লাস ও লাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। গ্লাসের ওপর খোদাই করে হুমায়ূনের সাহিত্য কর্মের নানা দিক ফুটিয়ে তোলা হবে। কবরের চারপাশে চত্বর তৈরি করে কবর স্থান জেয়ারতের জন্য আলাদা দুটি প্রবেশ পথ রাখা হয়েছে। যারা শুধু কবর জেয়ারতের জন্য নুহাশ পল্লীতে আসবেন তারা মূল গেটের পশ্চিম পাশ দিয়ে কবর স্থানে যেতে পারবেন। আর নুহাশ পল্লী পুরোটা দেখতে চাইলে দর্শনার্থীদের একটি নির্দিষ্ট ফি প্রদান করতে হবে।