আশির দশকের কথা। সেই সময়টায় দেশি পোশাক বা হস্তশিল্পের কাজটা এখনকার মতো এত প্রসারিত ছিল না। বলতে গেলে আমিসহ আরও কয়েকজন ডিজাইনারের হাত ধরেই দেশি পোশাক পরার প্রচলনটা শুরু হয় আমাদের মাঝে। তখন শুধু দেশে তৈরি কাপড় নিয়েই নয়, পোশাকের প্যাটার্ন নিয়েও চলতে থাকে নিরীক্ষণ। সেই থেকে সুতির পাশাপাশি কাজ শুরু করি সিল্ক আর মসলিন নিয়ে।
সূক্ষ্ম কাজে ফুটে ওঠে পোশাকের আভিজাত্যআমাদের দেশে তৈরি মসলিনের বুনন এতটাই সূক্ষ্ম ছিল যে ছোট একটা আংটির ভেতর দিয়ে নাকি অনায়াসেই ঢুকিয়ে দেওয়া যেত সেই কাপড়। কিন্তু মসলিনের সেই ঐতিহ্য আর গৌরব এখন আর নেই। সেই সময়কার বেশির ভাগ তাঁতিই এই পেশা ছেড়ে চলে যাওয়ায় সেই মানের মসলিন এবং সিল্কের কাপড় এখন আর তৈরি হয় না আমাদের দেশে। এখন দেশের ১০ শতাংশ সিল্ক উৎপাদিত হয় রাজশাহী ও টাঙ্গাইেল, বাকিটা আসে চীন থেকে। এর কারণ রেশম উৎপাদনে পার হতে হয় তিনটি ধাপ। প্রথম ধাপে তুঁত চাষ, দ্বিতীয় ধাপে রেশম গুটি লালন পালন, তৃতীয় ধাপে সুতা কাটা। এরপর হ্যান্ডলুম বা পাওয়ার লুমে প্রস্তুত করা হয় রেশম কাপড়।
সিল্ক উৎপাদনে যে রেশম সুতার ব্যবহার করা হয়, তার উৎপাদন থেকে শুরু করে কাপড় বুননের প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপই বেশ ব্যয়বহুল আর কষ্টসাধ্য। একটা সময় চীন থেকে খুব কম দামে আসতে থাকে রেশম সুতা। এদিকে তুঁতগাছের যত্নে প্রয়োজন হয় প্রচুর পানি। পদ্মা নদীর পানি কমে যাওয়ায় রাজশাহীর অনেক অঞ্চলেই তখন বন্ধ হয়ে যায় রেশমের চাষ। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন কমতে শুরু করলে তখন আবার বেড়ে যায় আমদানি করা সুতার দাম। বিকল্প হিসেবে এখন তাই তুলনামূলক কম দামে সরাসরি বিদেশ থেকে সিল্কের কাপড় আনছেন অনেকেই। যার প্রভাব পড়ছে দেশি পোশাকশিল্পের বাজারে।
উৎপাদন খরচটা তো বাড়তির দিকে আছেই। এ ছাড়া দেখা যায় এরপরে ডিজাইন, প্রসেসিং—সবকিছু মিলিয়ে একটা শাড়ি বা পোশাকের খরচটা বেশ বেড়ে যায়। যার ফলে সিল্ক আর মসলিনের কাপড়ের ব্যবহার সবার মাঝে এখনো এতটা সহজলভ্য হতে পারেনি। তাই বলে হতাশ হবারও কোনো কারণ নেই। আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে এখনো এসব শাড়ির কদর এতটুকুও কমেনি। এখনো টাঙ্গাইলে হাত তাঁতে (হ্যান্ডলুম) তৈরি করা হয় রেশম কাপড় আর যান্ত্রিক তাঁতে রাজশাহীতে তৈরি হচ্ছে রেশমের কাপড়। তবে গুণগত মানের দিক থেকে রাজশাহীর সিল্কের মান অনেক ভালো। এর কারণটা হলো, যন্ত্রে বুননের কারণে এখানকার কাপড় খুব পাতলা হয়, যা পরতে বেশ আরামদায়ক। এ ছাড়া এখন একরঙা মসলিন শাড়িতে নকশি কাঁথার কাজ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। শাড়ির পাড়ে থাকছে ভরাট চুমকির কাজ। এ ছাড়া স্ক্রিনপ্রিন্ট, এমব্রয়ডারির কাজে কাপড়ের নকশায় আনা হচ্ছে বৈচিত্র্য।
বিয়ের পোশাক কেনার ক্ষেত্রে এখনো বেশির ভাগ মানুষেরই বিদেশি কাপড়ের প্রতি ঝোঁকটা বেশি দেখা যায়। বিয়ের অনুষ্ঠানে বর-কনের পোশাকের জন্য বাজেটটা যাঁদের একটু বেশি থাকে, তাঁরা যদি দেশের সিল্ক ও মসলিনের কাপড়ে বিয়ের পোশাকটা তৈরি করেন, তাহলে যেমন নিজের জন্যও গর্বের ব্যাপার হবে, তেমনি সিল্ক ও মসলিন খাত হয়ে উঠবে আরও সম্ভাবনাময়। ডিজাইনারদের প্রতিও একটা অনুরোধ থাকবে, সিল্ক ও মসলিনের কাপড় দিয়ে বর-কনের জন্য যদি বৈচিত্র্যময় বিয়ের পোশাকের আয়োজন করা হয়, তাহলে আবারও বিশ্ববাজারে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে সিল্ক ও মসলিনের নাম।