‘তিনি আলোর মিনার নূর মদিনার জান্নাতি বুলবুল'/তিনি যষ্টি মুকুল বৃষ্টি বকুল বৃষ্টি ভেজা ফুল/নিখিলের চির সুন্দর সৃষ্টি মুহাম্মদ রাসুল...’।
পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) রোববার (৪ জানুয়ারি)। বারোই রবিউল আউয়ালের এ দিনটি বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্ম ও ওফাত দিবস। এ দিনেই জন্ম নিয়েছিলেন মানব জাতির শিরোমণি বিশ্বনবী(সা.)। আবার এই দিনেই তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।
গোটা জগতের মুসলমানদের আবেগ-অনুরাগ আর উচ্ছ্বাসে একাকার হওয়া প্রাণ-মন আকুল করা দিন ঈদে মিলাদুন্নবী। বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে বাংলাদেশেও উত্সবের রোশনাই ঘেরা নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে মুসলিম উম্মাহর পবিত্রতম এ দিনটি উদযাপিত হবে।
আজ থেকে প্রায় সাড়ে ১৪শ’ বছর আগে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের এ দিনে সুবহে সাদেকের সময় আরবের মরু প্রান্তরে মক্কা নগরীর সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে মা আমেনার কোল আলো করে তিনি আসেন এই ধরায়। জন্মের আগেই পিতৃহারা হন এবং জন্মের অল্পকাল পরই হারান মাকেও। অনেক দুঃখ-কষ্ট আর অসীম প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে চাচা আবু তালিবের আশ্রয়ে বড় হয়ে ওঠেন।
সে সময় গোটা আরব অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। তারা আল্লাহকে ভুলে গিয়ে নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। আরবের সর্বত্র দেখা দিয়েছিল অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা। তখন মানুষ হানাহানি ও কাটাকাটিতে লিপ্ত ছিল। এ যুগকে বলা হতো ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’। এই অন্ধকার যুগ থেকে মানবকূলের মুক্তিসহ তাদের আলোর পথ দেখাতেই মহান আল্লাহ রাসুলুল্লাহকে (সা.) প্রেরণ করেন এই ধরাধামে।
মহানবী অতি অল্প বয়সেই আল্লাহর প্রেম অনুরক্ত হয়ে পড়েন এবং প্রায়ই তিনি হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকতেন। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে তিনি মহান রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে নবুওয়তের মহান দায়িত্ব লাভ করেন। আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভ করেন।
নবুয়ত লাভের পর থেকে অসভ্য বর্বর ও পথহারা মানব জাতিকে সত্যের সংবাদ দিতে মহানবী তাদের কাছে তুলে ধরেন মহান রাব্বুল আলামিনের তাওহিদের বাণী। কিন্তু অসভ্য-বর্বর আরব জাতি তার দাওয়াত গ্রহণ না করে রাসুলের (সা.) ওপর নির্যাতন শুরু করে। বিভিন্নমুখী চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র করতে থাকে একের পর এক। আল্লাহর সাহায্যের ওপর ভরসা করে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন বাজি রেখে সংগ্রাম চালিয়ে যান তিনি। ধীরে ধীরে সত্যান্বেষী মানুষ তার সাথী হতে থাকে। অন্যদিকে কাফেরদের ষড়যন্ত্রও প্রবল আকার ধারণ করে। এমনকি একপর্যায়ে তারা রাসুলকে (সা.) হত্যার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
রাসুল (সা.) তখন আল্লাহর নির্দেশে জন্মভূমি ত্যাগ করে মদিনায় হিযরত করেন। মদিনায় তিনি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করেন এবং ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদিনা সনদ নামে একটি লিখিত সংবিধান প্রণয়ন করেন।
মদিনা সনদ বিশ্বের প্রথম লিখিত সংবিধান হিসাবে খ্যাত। এ সংবিধানে ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমানসহ সকলের অধিকার স্বীকৃত হয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনগণের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সার্বজনীন ঘোষণা রয়েছে এতে।
২৩ বছর শ্রম সাধনায় অবশেষে রাসুলে পাক (সা.) দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বিজয় অর্জন করেন। মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে তা পূর্ণতা লাভ করে। বিদায় হজের ভাষণে মানবজাতিকে তিনি আল্লাহর বাণী শুনিয়েছেন এভাবে- ‘আজ থেকে তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন তথা জীবন ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণ করে দেওয়া হলো। তোমাদের জন্য দ্বীন তথা জীবন ব্যবস্থা হিসাবে একমাত্র ইসলামকে মনোনীত করা হয়েছে’।
মহান আল্লাহ সমগ্র বিশ্বজগতের রহমত হিসেবে হযরত মুহাম্মদকে (সা.) এ জগতে প্রেরণ করেন। সর্বশেষ মহাগ্রন্থ পবিত্র কোরআন তার কাছে অবতীর্ণ করে জগতে তাওহিদ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব অর্পণ করেন। নিজ যোগ্যতা, মহানুভবতা, সহনশীলতা, কঠোর পরিশ্রম, নিষ্ঠা ও সীমাহীন দুঃখ কষ্টের বিনিময়ে তিনি এ মহান দায়িত্ব পালনে সফল হন।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইতিহাসের অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব।
অন্য ধর্মাবলম্বীরাও তাকে মানবজাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কারক ব্যক্তিত্ব হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। মহানবী তার অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব, অনুপম আচরণ, সৃষ্টির প্রতি অগাধ প্রেম ও ভালবাসা, অতুলনীয় বিশ্বস্ততা, অপরিমেয় দয়া ও ক্ষমাগুণের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হিসেবে অভিসিক্ত হয়েছেন। সুতরাং ধর্মীয় ও পার্থিব জীবনে মহানবীর শিক্ষা সমগ্র মানবজাতির জন্যই অনুসরণীয়।
প্রতি বছর বারই রবিউল আউয়ালকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসাবে পালন করে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব। পবিত্র কোরআন শরিফে বর্ণিত আছে, ‘মহানবীকে সৃষ্টি না করলে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পৃথিবীই সৃষ্টি করতেন না’। এসব কারণে এবং তৎকালীন আরব জাহানের বাস্তবতায় ঈদে মিলাদুন্নবীর গুরুত্ব ও তাৎপর্য তাই অনেক বেশি।
পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ। বাণীতে তারা মুসলমান ভাই-বোনদের প্রতি শুভেচ্ছা জানান এবং রাসুল (সা.)-এর আদর্শ নিজেদের জীবনে প্রতিফলন ঘটাতে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। মহানবী (সা.)-এর জীবনাদর্শ অনুসরণ করে সমগ্র মুসলিম জাহানকে ভ্রাতৃত্ববোধ ও মানবকল্যাণে ব্রতী হওয়ারও আহবান জানান তারা।
রোববার পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা জমায়েত হয়ে নবীজীর জীবন ও জীবনী আলোচনা করবেন এবং কাসিদা পড়বেন। মিষ্টি-খাবার তৈরি করে বিতরণ করবেন। রাসুল প্রেমিকরা ভক্তিভরে দরুদ পাঠে মশগুল থাকবেন। প্রাণের আবেগ মেখে পড়বেন: ‘বালাগাল উলা বিকামালিহি/কাশাফাত দুজা বিজামালিহি/হাসুনাত জামিঊ খিসালিহি/সাল্লু আলাইহি ওয়ালিহি...’।
ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে যথাযথ মর্যাদায় পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী পালনের জন্য সরকার, বিভিন্ন ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনও বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে মহানবী (সা.)-এর সিরাতের ওপর আলোচনা, সিম্পোজিয়াম, সেমিনার, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল। দিবসটির তাত্পর্য তুলে ধরে বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনসহ বিভিন্ন টিভি চ্যানেল বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে। জাতীয় দৈনিকগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্রও প্রকাশ করবে। সংবাদপত্রগুলোতে ছুটি পালিত হবে। তাই সোমবার দৈনিক পত্রিকাগুলো প্রকাশিত হবে না। তবে টিভি চ্যানেল ও বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমসহ অনলাইন গণমাধ্যমগুলো চালু থাকবে বিশেষ ব্যবস্থায়।
এ উপলক্ষে বায়তুল মোকাররমের উত্তর চত্বরে মাসব্যাপী ইসলামী বইমেলার আয়োজন থাকছে। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত মেলা খোলা থাকবে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে জাতীয় মসজিদে প্রতিদিন বাদ মাগরিব থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ওয়াজ মাহফিল, সপ্তাহব্যাপী সেমিনার, স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান, রাসুলকে (সা.) নিয়ে স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর, কেরাত মাহফিল, হামদ-নাত প্রতিযোগিতা, মহানবীর (সা.) জীবন ও শিক্ষা বিষয়ক আলোচনা সভা।
পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপন উপলক্ষে দেশের সব হাসপাতাল, কারাগার, সরকারি শিশুসদন, বৃদ্ধ নিবাস, মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রে উন্নত খাবার পরিবেশনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।