অপমানিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

Author Topic: অপমানিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়  (Read 937 times)

Offline Shah Alam Kabir Pramanik

  • Hero Member
  • *****
  • Posts: 542
  • Test
    • View Profile
বেতন কাঠামো
অপমানিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা চেয়েছিলেন স্বতন্ত্র বেতনকাঠামো, অথচ মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের পে-কমিশন শিক্ষকদের বলল অভ্যন্তরীণ ব্যয় বাড়িয়ে স্বনির্ভর হতে। উল্টো পে-স্কেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে কয়েক ধাপ নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশেষ মর্যাদা চেয়ে তাঁরা যেন আরও অসম্মানিত হলেন। এ থেকে জন্ম নিয়েছে ক্ষোভ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতিগুলো শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করছে। শিক্ষকেরা দাবি করছেন অষ্টম জাতীয় বেতনকাঠামো বাতিল করতে হবে, শিক্ষকদের মর্যাদা যতটুকু দেওয়া ছিল, তা ফিরিয়ে আনতে হবে। স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের দাবিটিও তাঁরা মৃদুস্বরে জানাচ্ছেন। তবে শিক্ষক নেতাদের কার্যকলাপ, বক্তব্য ও ভাবনায় একধরনের স্ববিরোধিতা ফুটে ওঠে। একদিকে তাঁরা স্বতন্ত্র বেতনকাঠামো সরকারের কাছ থেকে দাবি করেছেন, কিন্তু একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধিতে বিশ্বাসও করেন। অথচ দুটি প্রায় বিপরীত নীতি।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অভ্যন্তরীণ আয় কীভাবে বৃদ্ধি করতে পারে? শিক্ষার্থীদের বেতন বাড়ানো যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ধ্যাকালীন ও অন্যান্য বাণিজ্যিক কোর্স চালু করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌগোলিক অবয়বের প্রান্তসীমায় দোকানপাট বানিয়ে ভাড়া দিতে পারে। সত্যিকার অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেতারা এই কাজগুলো করেই চলেছেন। শিক্ষার্থীদের বেতন আন্দোলনের মুখে বেশি বাড়ানো না গেলেও অন্যান্য ফির পরিমাণ বহুলাংশে বেড়েছে। নতুন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা উচ্চ বেতনেই পড়ে। কেবল নেতারা নন, বেশির ভাগ শিক্ষকই ‘স্বনির্ভরতা’র আদর্শে বিশ্বাসী। নতুন নতুন সান্ধ্য কোর্স সে কারণেই চালু হচ্ছে। পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবধান ক্রমশ কমে আসছে। বস্তুত, বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ ও আর্থিক সহায়তায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন যে ২৫ বছর মেয়াদি কৌশলপত্র বাস্তবায়ন করছে ২০০৫ সাল থেকে, তাতেও এই ‘স্বনির্ভরতা’র ডাকই দেওয়া হয়েছে। তাহলে প্রায় শতভাগ শিক্ষক যে ভাবনায় বিশ্বাসী, পে-কমিশন তার এখতিয়ারভুক্ত বিষয় না হলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বনির্ভর হওয়ার যে পরামর্শ দিয়েছে, এবং তারপরেই কেবল স্বতন্ত্র বেতনকাঠামো দেওয়ার যে কথা বলেছে, তাতে শিক্ষক নেতাদের ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হওয়ার কোনো কারণ থাকছে না। কারণ তাঁরা যাতে বিশ্বাস করেন, সে কথাটিই তাঁদের শোনানো হয়েছে। অন্যদিকে প্রায় বিপরীত ভাবনার দাবি হলো পৃথক বেতনকাঠামোর দাবি। এতে মনে করা হয় যে রাষ্ট্র শিক্ষার উন্নয়নের দায়িত্ব নিজ হাতে নেবে। এ জন্য শিক্ষকদের অন্য পেশাজীবীদের থেকে বিশেষ মর্যাদা দেবে।
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি আয়োজিত একাধিক সভায় হাজির ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির ১৫টি পদেই এখন সরকার-সমর্থিত নীল দলের শিক্ষকেরা নির্বাচিত রয়েছেন। ইতিপূর্বে তাঁরা পৃথক বেতনকাঠামোর ব্যাপারে বেশ আশার বাণী শুনিয়েছেন সাধারণ শিক্ষকদের। কিন্তু তাঁদের সময়েই কিনা শিক্ষকদের মর্যাদা কমে গেল? ফলে সভায় বক্তাদের কণ্ঠে বেশ অভিমানের সুর ছিল। প্রধানমন্ত্রীর ওপরে আস্থা সম্পূর্ণ অটুট রেখে এসবের কারণ হিসেবে তাঁরা আমলাদের ষড়যন্ত্রকে খুঁজে পেলেন। কিন্তু বহুদিন ধরেই শিক্ষক নেতাদের যেটার অভাব, নিজেদের আত্মমর্যাদা লঘু করে ফেলার দায় তাঁরা নিলেন না। রাষ্ট্রের কাছে, সমাজের কাছে, শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষকদের, বিশেষত রাজনীতিবিদ শিক্ষকদের ভাবমূর্তি আজ কোন তলানিতে ঠেকলে আমলারা নিজেদের উচ্চপদ নতুন করে সৃষ্টি করেন আর শিক্ষকদের মর্যাদার অবনমন ঘটানোর সাহস পান, সেদিকটায় কেউ আলোকপাত করলেন না।
অতীতে রাজনীতিবিদেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবীদের কাছে আসতেন পরামর্শের জন্য। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা রাজনীতিবিদদের কাছে গিয়ে ধরনা দিয়ে থাকেন উপাচার্যসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগ পাওয়ার লোভে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি দেখি, জুনিয়র শিক্ষকেরা রাজনীতি শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে একটি ছোট বাসা পাওয়ার জন্য। আর সিনিয়র শিক্ষকেরা রাজনীতি করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন স্থানে পদ পাওয়ার জন্য। দলীয় আদর্শ সেখানে গৌণ। এ জন্য তাঁদের আচরণ অনেক ক্ষেত্রে আদর্শিক, যৌক্তিক ও শিক্ষকসুলভ না হয়ে সুবিধাসন্ধানকারী রাজনীতিবিদদের মতো দেখায়। ফলে একই দলের লোক হয়েও সরকারের কাছ থেকে কিছু আদায় করে নিয়ে আসার মতো নৈতিক বল ও তেজ তাঁদের নেই। শিক্ষকদের বেতনকাঠামো হিসেবে যা রাখা হয়েছে, তা দ্বারা মানবেতর জীবনযাপনই কেবল সম্ভব। বরাবরই দেখা গেছে, কেবল শিক্ষকদের নয়, সার্বিকভাবে সরকারি বেতনকাঠামোই চাকুরেদের দুর্নীতির জন্য অনেকখানি দায়ী। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত কিংবা পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশের সরকারি চাকুরেদের বেতন অনেক কম। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদে ভাগ বসানোর জন্য শিক্ষকেরা দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়েছেন, কিংবা বাড়তি উপার্জনের জন্য এখানে-ওখানে দৌড়াদৌড়ি করছেন।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান সমস্যাসহ সব সংকটকে সত্যিকার অর্থে মোকাবিলা করতে চাইলে আমাদের মৌলিক জায়গায় দৃষ্টি ফেরাতে হবে। উচ্চশিক্ষাকে কী দৃষ্টিতে দেখতে হবে, তার ব্যাপারে বাংলাদেশের সরকার, ইউজিসি, শিক্ষক নেতারা কারোর ধারণাই খুব পরিষ্কার নয়। রাষ্ট্রযন্ত্র চালানোর জন্য রাষ্ট্রের প্রয়োজন মানবসম্পদ। রাষ্ট্র নিজের প্রয়োজনে সেই মানবসম্পদ তৈরি করবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করবে। সেই বিনিয়োগের অন্যতম স্থান হলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ শিক্ষা-গবেষণায় বরাদ্দ না বাড়িয়ে বলা হয় অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির কথা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণার স্থান, আয় করার স্থান নয়। শিক্ষাঙ্গনে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, আধুনিক শিক্ষা-উপকরণ সরবরাহ, গবেষণায় বিপুল বরাদ্দ না থাকলে দেশের প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন জ্ঞানের সঞ্চার হবে কী করে? শিল্প ও বাণিজ্য খাতের উপযোগী নতুন আবিষ্কার আসবে কোত্থেকে? একটি দেশ সুশিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে না তুললে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা কীভাবে রক্ষিত হবে? বর্তমানের জিডিপি বৃদ্ধির যে হার, তা সম্পূর্ণভাবে সস্তা শ্রমের ওপর নির্ভরশীল। কৃষি, তৈরি পোশাক ও শ্রমবাজারে সস্তা শ্রম বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্ফীত হচ্ছে। উদ্বৃত্ত শ্রমবাজারের এই সরবরাহ অসীম নয়। যখন এই শ্রমশক্তির সরবরাহ স্থিতাবস্থায় আসবে, তখনই অনুভূত হবে শিক্ষা ও গবেষণার প্রয়োজনীয়তা।
কিন্তু এই জায়গায় আমাদের প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ নেই, ফলে নতুন জ্ঞানের ঘাটতিতে উন্নয়ন কার্যক্রম অচিরেই স্থবির হয়ে পড়বে। ল্যাবরেটরি রয়েছে, কিন্তু তাতে উন্নত সরঞ্জাম নেই, একে ঘিরে বড় গবেষণা প্রকল্প নেই। অন্যদিকে ইউজিসির কার্যক্রমে বাড়তি প্রণোদনা নেই। বরং বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ও পরামর্শে প্রতিষ্ঠানটি বাস্তবায়ন করছে দীর্ঘমেয়াদি এক কৌশলপত্র, যাতে মৌলিক জ্ঞানের (রসায়ন, পদার্থবিদ্যা) পরিবর্তে বাজারমুখী নানান শিক্ষা কার্যক্রমের (ব্যবসায় প্রশাসন) দিকে জোরারোপ করা হয়েছে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব আয় বৃদ্ধির বুলিই পুনরায় আওড়ানো হয়েছে। বেতন কিংবা ফি বৃদ্ধির মাধ্যমে গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীর পড়াশোনার পথ রুদ্ধ করার আয়োজন সমাপ্ত হয়েছে। উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি যথেষ্ট বেশি, কিন্তু সেখানকার জনগণের আর্থিক সক্ষমতা অর্জিত হয়েছে। কিন্তু যে দেশ উন্নয়নের ধারায় যুক্ত হতে চায়, তাকে জনগণের আর্থসামাজিক সক্ষমতাকে বিবেচনায় নিতে হবে।
শিক্ষার একটি দর্শনগত দিক থাকে, নীতিগত দিক থাকে। উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় শিক্ষাকে ঠিক কীভাবে কাজ লাগানো যাবে,
সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে নীতিনির্ধারকদের। বিশ্ববিদ্যালয় কেবল ক্লাস নেওয়ার স্থান নয়। আর নামমাত্র গবেষণা দ্বারা উন্নয়নের উপযোগী নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি হবে না। এর জন্য প্রয়োজন বিপুল বিনিয়োগ। আমরা সম্ভবত উল্টা পথে হাঁটছি। শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ না বাড়িয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই বলছি নিজের খরচ নিজে বহন করতে। এতে বোঝা যায়, কেন্দ্রীয় উন্নয়ন–ভাবনায় শিক্ষাকে সঙ্গে রেখে সরকার সামনের দিকে হাঁটছে না। বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চায়। কিন্তু পৃথিবীর কোনো দেশই শিক্ষা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ ছাড়া উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশে পরিণত হয়নি।
ফাহমিদুল হক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সদস্য।

Offline monirulenam

  • Sr. Member
  • ****
  • Posts: 295
  • Test
    • View Profile