মানব পাচারকারী চক্র মালয়েশিয়াতে চাকরি দেয়ার লোভ দেখিয়ে থাইল্যান্ডে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখে মুক্তিপণ দাবি করে। গত ৮ বছরে এভাবে আড়াই লাখ লোক সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের কাছ থেকে মানব পাচারকারীরা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তাদের কখনো কখনো মাসের পর মাস এমনকি বছর পর্যন্ত থাইল্যান্ডের দুর্গম জঙ্গলে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। সংঘবদ্ধচক্রের চাহিদা মোতাবেক যারা টাকা দিতে অক্ষম তাদের সেখানে ক্রীতদাস হয়ে থাকতে হয়। নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেককেই মৃত্যুবরণও করেছে।
গত শনিবার (২ মে, ২০১৫) থাই কর্তৃপক্ষ যে ২৬ জনের লাশ খুঁজে পেয়েছে ধারণা করা হচ্ছে, সেখানেও হতভাগ্য বাংলাদেশী রয়েছে। গত বছরের অক্টোবরে থাই রাবার বাগান থেকে যে ১৩৪ জনের লাশ থাই পুলিশ উদ্ধার করে বিবিসির ভাষ্য অনুযায়ী তার বেশিরভাগই ছিল বাংলাদেশী।
মানব পাচার মানবাধিকারবিরোধী জঘন্য অপরাধ। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানব পাচারের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। মানব পাচারকে দাসত্বের আধুনিক রূপ বলে মনে করা হয়। অনেকের মতে, মানব পাচারের যে পরিমাণ খবর পত্রিকায় আসে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মানব পাচার হয় বিভিন্ন দেশে। অর্থ উপার্জনের সহজ মাধ্যম হিসেবে কিছু লোক মানব পাচারের মতো ঘৃণ্য কাজকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে।
শুধু বর্তমান সময়ে নয়, মানব পাচারের মতো জঘন্য অপরাধের প্রবণতা আগেও ছিল। তাই ইসলাম মানব পাচারকে অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখে। ইসলামের দৃষ্টিতে মানব পাচার সংশ্লিষ্ট সব ধরনের কাজ হারাম। দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা ও বেকারত্বের কারণে যে কোনো অসচেতন নারী-পুরুষ পাচারকারীর কবলে পড়তে পারে। অনেক সময় পাচারকারীরা বিভিন্ন প্রলোভন দেখায়, যাতে নারী বা শিশুর অভিভাবক নিজেদের সন্তানকে স্বেচ্ছায় তাদের হাতে তুলে দেয়, কিন্তু সে আর ফিরে আসে না। এভাবেই পাচারকারীরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের স্বাধীনতা হরণ করার পাশাপাশি তাদের বিশ্বাসের চরম অবমাননা ও অবমূল্যায়ন করে থাকে। এর চেয়ে প্রতারণা ও ধোঁকাবাজি আর কী হতে পারে?
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এর চেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা আর কিছুই নেই যে তুমি এমন ব্যক্তির সঙ্গে মিথ্যার আশ্রয় নেবে, যে তোমাকে বিশ্বাস করে।’-আবু দাউদ
পাচার হওয়া নারী ও মেয়েশিশুদের সাধারণত পতিতাবৃত্তি, পর্নোগ্রাফি, গৃহস্থালির কাজসহ নানাবিধ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, উটের জকি, অঙ্গহানি করে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত করা হয়। আর পুরুষদের বিভিন্ন অমানবিক, অপরাধমূলক ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে বাধ্য করা হয়। যেমন— মাদক ও অস্ত্র পাচার, চোরাচালান, চুরি-ছিনতাই ইত্যাদি।
পাচারের শিকার হওয়া মানুষগুলোর মানবাধিকার বা কোনো স্বাধীনতা থাকে না। পাচারকারীরা নারী ও শিশুদের সাধারণত যেসব কাজে নিয়োজিত করা হয়, তার অধিকাংশই শরিয়তসম্মত নয়। এসব কাজ ইসলামে অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানব পাচার শারীরিক ও মানসিক বল প্রয়োগের পাশাপাশি নানা ধরনের প্রতারণার মাধ্যমে হয়ে থাকে। যেমন- বিদেশে বেশি বেতনে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন, বিয়ে করে উন্নতমানের জীবনযাপনের আশ্বাস ইত্যাদি। এ থেকে দেখা যায়, এই অপরাধ বেশিরভাগ সময়ই ঘটে দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অপরাধ সম্পর্কে অসচেতনতা, লোভ, বেকারত্বসহ নানাবিধ কারণে।
পৃথিবীতে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বিভিন্ন অপরাধের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে ইসলামে। মানব পাচার একটি প্রতারণামূলক কাজ। এ প্রসঙ্গে ইসলামি স্কলারদের অভিমত হলো, প্রতারণার মাধ্যমে মানব পাচারের শাস্তি বিধানে সরকার তার ধরন ও ভয়াবহতার ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড, জেল-জরিমানা, নির্বাসনে দেয়া, মালামাল ক্রোক করা, সামাজিকভাবে বয়কট করাসহ যে কোনো শাস্তি নির্ধারণ করতে পারে। সে হিসেবে বলা যায়, সমাজের শৃঙ্খলা বিধানের জন্য মানব পাচাররোধে প্রচলিত আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের যে বিধান রাখা হয়েছে, তা ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। মানব পাচার রোধ আজ আমাদের সামনে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। আমরা চাই আইনের কঠোর প্রয়োগ। মানব পাচারের সঙ্গে যারা নানাভাবে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে।
ইসলাম যেহেতু মানব পাচারকে সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করেছে এবং পাচারকারীদের কঠিন শাস্তি প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে, সেহেতু পাচারের মাধ্যমে নির্যাতিতদের জীবন রক্ষায় আত্মনিয়োগ করা প্রতিটি মুসলমানের ওপর অবশ্য করণীয়। ইসলাম মানব পাচারকারীদের কোনো অবস্থাতেই ক্ষমা করে না, তাদের অবশ্যই ইহকাল ও পরকালে কঠিন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ভোগ করতে হবে। আমাদের সমাজ থেকে যাতে আর কেউ পাচার না হয়, সে জন্য জনগণকে সচেতন করতে হবে। সেই সঙ্গে কেউ পাচার হয়ে গেলে তাকে মুক্ত করার জন্যও সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এমন অসহায় নারী, পুরুষ ও শিশুদের বিপদ-আপদে পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়ে আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারিমে ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের কী হলো যে তোমরা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করছ না? অথচ দুর্বল নারী, পুরুষ ও শিশুরা চিৎকার করে বলছে যে, হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি আমাদের জালিমের জনপদ থেকে উদ্ধার করুন। আপনি আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে সাহায্যকারী পাঠান।’ -সূরা আন নিসা : ১৭৫
বলার অপেক্ষা রাখে না, যারা পাচারের শিকার হচ্ছে তারা মূলত কায়িক শ্রমিক। ন্যূনতম মজুরিটুকু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়েই তারা জীবনের ঝুঁকি নেয়। একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও বেড়িয়ে পড়ছে অনেকেই। মানবপাচারকারী চক্র অসহায় ও হতাশাগ্রস্ত এসব মানুষকে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে দাস হিসেবে বিদেশে পাচার করছে। এ প্রবণতা দুখঃজনক।
মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে অমানবিক মানবপাচার বন্ধ করা যাচ্ছে না। এ নিয়ে বহুবার লেখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মহল তাতে কর্ণপাত করছে বলে মনে হচ্ছে না। এর ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ইমেজ যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাও আমলে নেয়া হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টদেরও এ ব্যাপারে অনেক সময়ই যথাযথ পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। অবৈধভাবে মানব পাচার বন্ধ করার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য। যে চক্র এই অমানবিক ও অবৈধ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত তাদের গ্রেফতার করে শাস্তিমূলক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জাতীয় স্বার্থেই অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।