ঘুম হচ্ছে বিধাতার সর্বশ্রেষ্ঠ দানের মধ্যে একটি। রাতের ফ্রেশ ঘুম একটি কর্মময় সুন্দর দিনের নিশ্চয়তা দেয়। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন তো ঘুমের মধ্যে আপনার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলে কী রকম ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। হ্যাঁ, অনেকের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। এ ধরনের অবস্থাকে স্লিপ এপনিয়া বলা হয়। শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়াকে চিকিৎসাবিদ্যায় এপনিয়া বলে। তাই স্লিপ
এপনিয়া মানে ঘুমের মধ্যে শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়াকে বোঝানো হয়ে থাকে। টানা ১০ সেকেন্ড বা তার বেশি
সময় শ্বাস বন্ধ থাকলে বা একেবারে কমে গেলে এ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
কাদের হয়
এটা সাধারণত বড়দের রোগ এবং শিশুরা খুব কম ক্ষেত্রে আক্রান্ত হয়। মহিলাদের তুলনায় পুরুষরা সাধারণত এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। তবে বয়স ৫০ পার হলে মহিলা পুরুষ উভয়ই সমানভাবে এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। স্থূলকায় লোকদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি। তাছাড়া হার্টের রোগসহ বেশকিছু রোগ আছে, যেগুলোতে আক্রান্ত হলে স্লিপ এপনিয়া হতে পারে। এ ধরনের রোগীরা সাধারণত একটু ঘুমালেই নাক ডাকতে থাকে। এসব রোগীর রাতে ঘুম ঠিকমতো না হওয়ায় এরা সারাদিন ঘুম ঘুমভাব নিয়ে চলাফেরা করে। ফলে কাজ-কর্মে ঠিকমতো মন বসে না। এদের স্মৃতিশক্তি একেবারে কমে যায়। এমনকি মিটিং চলাকালীনও এরা ঘুমিয়ে পড়ে। এমন লোকেরা ড্রাইভিং পেশার সঙ্গে জড়িত থাকলে অ্যাক্সিডেন্টের ঝুঁকি মারাত্মক বেড়ে যায়।
কীভাবে হয়
স্লিপ এপনিয়া কিভাবে হয়, সেটা বুঝতে হলে প্রথমেই আপনাকে জানতে হবে আমরা কিভাবে শ্বাস নিই। আমরা নাক ও মুখ দিয়ে যে বাতাস গ্রহণ করি, তা শ্বাসনালি নামক লম্বা পথ পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত ফুসফুসে গিয়ে পৌঁছায়। স্লিপ এপনিয়ার শুরুতে ঘুমের মধ্যে শ্বাসনালিপথ বন্ধ বা কলাপস হয়ে যায়। এ অবস্থায় রোগী একটু জোরে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সেটা সম্ভব হয় না। ফলে রোগীর ব্রেইনে অক্সিজেন ঘাটতি দেখা দেয়। ব্রেইন তখন বাধ্য হয়ে রোগীকে জাগিয়ে তোলে। ফলে রোগী হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে তীব্র শ্বাসকষ্ট অনুভব করে। জেগে জেগে বেশ কিছুক্ষণ শ্বাস নেয়ার পর এরা একটু স্বস্তি পায়। আপনি যদি এ জাতীয় রোগীর পাশে শুয়ে থাকেন, তাহলে দেখবেন এরা ঘুমের মধ্যে হঠাৎ শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ করে নিশ্চুপ হয়ে যায় এবং
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘুম থেকে জেগে খুব তীব্রভাবে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করে।
কী কারণে হয়
আমরা যখন ঘুমাই, তখন ব্রেইন শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে জড়িত মাংসপেশিগুলোকে নির্দেশ দেয় সুন্দরভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য। অনেক সময় ব্রেইন এ ধরনের নির্দেশ পাঠায় না। তখন স্বাভাবিকভাবেই শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে ব্র্র্রেইন হয়তো নির্দেশ পাঠালো; কিন্তু শ্বাসনালিপথ যদি কোনো কারণে বন্ধ হয়ে থাকে, তখনো শ্বাস নেয়া সম্ভব হয় না। একই সঙ্গে দুই ঘটনাও ঘটতে পারে। অর্থাৎ ব্রেইন নির্দেশ পাঠালো না এবং শ্বাসনালিপথও বন্ধ থাকলো, তখন তীব্র শ্বাসকষ্টে রোগী ঘুম থেকে জেগে ওঠে।
স্লিপ এপনিয়া কেন এতো ভয়াবহ
স্লিপ এপনিয়া বেশিরভাগ সময় মারাত্মক কোনো রোগের ইঙ্গিত বহন করে তা হলো :
. হার্টের রোগ যেমনÑ হার্ট ফেইলিওর, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন ইত্যাদি
. ব্রেইনের রোগ
. জন্মগত কোনো ত্রুটি
. কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
. উচ্চ রক্তচাপ।
প্রতিকার বা চিকিৎসা
সঠিক চিকিৎসায় এ ধরনের সমস্যা একেবারেই ভালো হয়ে যায়। তবে চিকিৎসা শুরু করার আগে খুব ভালোভাবে দেখে নিতে হয় রোগীর প্রকৃত কোন সমস্যার কারণে স্লিপ এপনিয়া হচ্ছে। এ জন্য রোগের ইতিহাস জানতে হয়। এছাড়া বেশকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা আছে, যেগুলোর সাহায্যে রোগ ও রোগের তীব্রতা নির্ণয় করা যায়।
সঠিক চিকিৎসার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয় সেগুলো হলো :
. শোয়ার স্টাইল পরিবর্তন। কারণ চিত হয়ে শুয়ে থাকলে স্লিপ এপনিয়া বাড়ে
. ওজন কমানো। ১০ ভাগ ওজন কমালে স্লিপ এপনিয়া ২৫ ভাগ কমে যায়।
.সুষম খাবার গ্রহণ
.নিয়মিত ব্যায়াম
. কিছু ওষুধের সাহায্যে চিকিৎসা
. অপারেশন বা সার্জারির মাধ্যমে চিকিৎসা।
চিকিৎসার জন্য কার কাছে যাবেন
স্লিপ এপনিয়া কোনো নিদির্ষ্ট অঙ্গের রোগ নয়। ফলে একজন বিশেষজ্ঞের নাম এক কথায় বলে দেয়া মুশকিল। বিদেশের হাসপাতালগুলোতে স্লিপ সেন্টার নামে আলাদা ইউনিট থাকে, যেখান থেকে এ ধরনের রোগীর চিকিৎসা দেয়া হয়। বিদেশি আদলে আমাদের দেশেও বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে এ ধরনের সেন্টার গড়ে উঠেছে, যারা স্লিপ এপনিয়া রোগীর সুচিকিৎসা দিয়ে থাকেন। তবে যেখানেই যান একজন নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ ও একজন ডেন্টিস্টের সহায়তা ছাড়া এ ধরনের রোগীর চিকিৎসা দেয়া প্রায় অসম্ভব।
তাই বুঝতেই পারছেন। নাকডাকা রোগ থাকলে নাকে তেল দিয়ে না ঘুমানোই উত্তম। কেননা ছোট্ট এ সমস্যাটি অনেক জটিল রোগের বাহক হতে পারে।
ডা. সাকলায়েন রাসেল
কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগ
বিএসএমএমইউ (পিজি হাসপাতাল)