বাঘ বাঁচলে বাঁচবে বন, রক্ষা হবে সুন্দরবন
2৯ জুলাই আন্তর্জাতিক বাঘ দিবস। বিশ্বজুড়ে বিলুপ্ত হতে যাওয়া এই প্রাণী রক্ষায় বিশ্ববাসীর উদ্যোগের অংশ হিসেবে বিশ্বে বাঘ আছে, এমন দেশগুলোয় দিবসটি পালিত হয়। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) রেড ডেটা বুক অনুযায়ী বাঘ বিশ্বের মহা বিপন্ন প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত। তাই আমাদের সুন্দরবনের বাঘের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনই জরুরি ভিত্তিতে ভাবা প্রয়োজন
ঘের আটটি উপপ্রজাতির মধ্যে বেঙ্গল টাইগারসহ কোেনা রকমে পাঁচটি উপপ্রজাতি টিকে আছে
* ১৯০০ সালে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা ছিল এক লাখ। বর্তমানে এ সংখ্যা চার হাজারে নেমে এসেছে। বাঘ বিশেষজ্ঞদের মতে, কমার এই প্রবণতা চলমান থাকলে আগামী কয়েক দশকে পৃথিবী থেকে বাঘ হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে
* বাঘ আছে এমন ১৩টি দেশ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বাঘ পুনরুদ্ধার কর্মসূচি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে
আলোচনায় সুপারিশ
* ২০২২ সালের মধ্যে বাঘের সংখ্যা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করতে হবে
* ভবিষ্যতে সুন্দরবনের বাঘ নিরাপদ রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে
* যেসব দেশে বােঘর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যবহার রয়েছে, আন্তর্জাতিকভাবে তাদের সচেতন করা জরুরি
* ২০১২ সালের বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা
* আরও অনেক বেশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি ছাড়া কোনোভাবে বাঘকে ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে না
* জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা সুন্দরবনে কাজ করে, তাদের ঝুঁকি ভাতাসহ জীবনমান উন্নয়নের ব্যবস্থা করতে হবে
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম: ২৯ জুলাই আন্তর্জাতিক বাঘ দিবস। বাংলাদেশের জন্য দিবসটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, বাঘ আমাদের জাতীয় প্রাণী। দেশে বীরত্ব ও শক্তির প্রতীক হিসেবে বাঘকে দেখা হয়। আমাদের জাতীয় ক্রিকেট দলের লোগো বেঙ্গল টাইগার। আমরা বলছি, বাঘ বাঁচলে বাঁচবে বন, রক্ষা হবে সুন্দরবন।
বিশ্বজুড়ে বিলুপ্ত হতে যাওয়া এই প্রাণী রক্ষায় বিশ্ববাসীর উদ্যোগের অংশ হিসেবে দিবসটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হয়। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) রেড ডেটা বুক অনুযায়ী বাঘ বিশ্বের মহা বিপন্ন প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত।
আজকের আলোচনায় বাঘের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বিভিন্ন বিষয় আসবে। এখন আলোচনা করবেন কামাল উদ্দিন আহমেদ।
কামাল উদ্দিন আহমেদ: বাঘ নিয়ে আমরা গর্ব করি। আমাদের সুন্দরবনের অত্যন্ত সমৃদ্ধ প্রাণী বাঘ। একসময় বনে অনেক বাঘ ছিল। এখন কমে গেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাঘ আছে। কিন্তু আমাদের ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার সুন্দরবনে অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি বাঘ আছে। ঘনত্বের বিচারে এটি বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাঘের বাস। ভারতে ৫৬টি বনে ১ হাজার ৭০০ বাঘ আছে। কোথাও আড়াই লাখ বর্গ কিলোমিটার জায়গায় মাত্র ২০০ থেকে ২৫০টি বাঘ আছে। আমরা গর্ব করে বলি, গত ১০০ বছরে সুন্দরবন আয়তনের দিক থেকে কমেনি। এই না কমার কারণ হলো সুন্দরবনের বাঘ। বাঘ বেঁচে থাকলে বনের জীববৈচিত্র্য বেঁচে থাকবে। বন রক্ষা হবে। আর বৃক্ষের কী প্রয়োজন, তা বিশ্বব্যাপী মানুষ আজ জানে।
বন ধ্বংস হলে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে। তখন আমরা বিভিন্ন সংকটে পড়ব। জীববৈচিত্রে্যর মাধ্যমে জীবনধারণের উপকরণগুলো পেয়ে থাকি। এই জীববৈচিত্র্য রক্ষার অন্যতম কারণ বাঘ। আমাদের সবার প্রিয় প্রাণীও বাঘ। এই প্রাণীকে কোনোভাবে ধ্বংস হতে দিতে পারি না।
বিশ্বের অন্যতম ম্যানগ্রোভ বন আমাদের সুন্দরবন, এটি টিকে আছে বাঘের জন্য। ১৯০০ সালে বিশ্বে বাঘের পরিমাণ ছিল এক লাখ। মাত্র ১১৫ বছরে এক লাখ থেকে চার হাজারে নেমে এসেছে। এত দ্রুত হারে বাঘ কমেছে, যা আমাদের কল্পনার অতীত। এ অবস্থা চলতে থাকলে আর মাত্র কয়েক দশকে বিশ্ব থেকে বাঘ বিলুপ্ত হবে।
আটটি উপপ্রজাতির বাঘ ছিল, তার তিনটি ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে। ২০১০ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে একটি সম্মেলন হয়েছিল। আমাদের প্রধানমন্ত্রী এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। এ সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়, ২০২২ সালের মধ্যে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করতে হবে।
আমরা জাতীয়ভাবে বাঘ পুনরুদ্ধারের কর্মসূচি নিয়েছি। আরও বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা আমাদের আছে। যেকোনো মূল্যে সুন্দরবনের বাঘকে সংরক্ষণ করতেই হবে।
পন কুমার দে: বিশ্বের ১৩টি দেশে বিভিন্ন প্রজাতির বাঘ আছে। আমরা বলে থাকি, বাঘ বাঁচলে বন বাঁচবে। কেন বলি? বাঘ হলো বনের সার্বক্ষণিক পাহারাদার। যেখানে বাঘ আছে, সেখানে মানুষ যায় না। অর্থাৎ মানুষ না গেলে বন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সুযোগ থাকে না। ফলে বন রক্ষা পায়। বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপাল, চীন, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনামসহ আরও কয়েকটি দেশে বাঘ আছে। কিন্তু বিশ্বের অধিকাংশ বাঘ আছে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানে। একসময় দেশের কয়েকটি অঞ্চলে বাঘ ছিল। এখন শুধু সুন্দরবনেই আছে। ২০০৪ সালে সুন্দরবনের বাঘের একটি জরিপ হয়। এ জরিপে বাঘের সংখ্যা পাওয়া যায় ৪৪০।
জরিপের সময় ইউএনডিপি ও ভারত আমাদের সঙ্গে ছিল। ১৯৭৫ সালের পর থেকে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল অনেকটা অনুমানভিত্তিক। এখন আমরা ফটোগ্রাফির মাধ্যমে জরিপ করছি। এটা হলো বিজ্ঞানভিত্তিক ও আধুনিক। ২০১৪ সালের মার্চ থেকে বাংলাদেশ-ভারত যৌথভাবে বাঘ গণনা শুরু করে এবং ২০১৫ সালের এপ্রিলে শেষ হয়।
এই জরিপ থেকে আমরা বাঘের সঠিক পরিসংখ্যান পাচ্ছি। প্রাপ্ত হিসাব অনুযায়ী যে পরিমাণ বাঘ আমাদের সুন্দরবনে আছে, সেটাকে ধরে রাখব। ধীরে ধীরে বাড়ানোর চেষ্টা করব।
সুন্দরবনের যেসব এলাকায় সুন্দরীগাছ আছে, সেখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে তিনটি হরিণ আছে। আবার কটকা এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৭৫ থেকে ২০০টি হরিণ আছে। ২০১২ সালের বন্য প্রাণী রক্ষার আইনে শাস্তির বিধান সর্বনিম্ন তিন বছর ও সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড করা হয়েছে। কেউ যদি দ্বিতীয়বার বাঘ হত্যা করে, তাহলে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ভবিষ্যতে সুন্দরবনের বাঘ নিরাপদে রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
কবর হোসেন: সুন্দরবনে ১৩ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। সেন্ট পিটার্সবার্গের বাঘ সম্মেলনে ছিলাম। বাঘ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আমার সম্পৃক্ততা ছিল। বাঘ সংরক্ষণের কার্যকর পরিকল্পনা আছে। পরিকল্পনায় কীভাবে বাঘ সংরক্ষণ করতে হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত বলা আছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বন বিভাগ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। সুন্দরবনের তিন দিকে বসতি। কেবল দক্ষিণ দিকে সমুদ্র।
সুন্দরবনের আশপাশের ১৭টি উপজেলার পাঁচ থেকে ছয় লাখ মানুষ সরাসরি বনের ওপর নির্ভরশীল। এদের বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করা খুবই জরুরি। সরাসরি যারা বনের ওপর নির্ভরশীল, এরা বনের বৃক্ষ ও বন্য প্রাণী ধ্বংস করে। প্রায়ই পত্রপত্রিকায় দেখা যায়, বনের হরিণ শিকার হচ্ছে। এভাবে যদি বাঘের খাদ্য কমে যায়, তাহলে বাঘও একসময় বিপন্ন হবে।
এখন এসব ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। দুই বছর আগেও যেকোনো কারণে বাঘ লোকালয়ে এলে হত্যা করা হতো। এখন সেটা বন্ধ হয়েছে। গত দুই বছর আমরা স্থানীয় মানুষের বিভিন্নভাবে সচেতন করেছি। কিছু ক্ষেত্রে আমরা বাঘকে বনে ফিরিয়ে নিতে পেরেছি।
বনের পাশে বসবাস করা মানুষের বোঝাতে হবে, বাঘ না বাঁচলে বন থাকবে না। বন না থাকলে আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হব। সবচেয়ে বড় কাজ হলো বনের ওপর নির্ভরশীল মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা করা। এদের জীবিকার বিকল্প ব্যবস্থা না থাকলে এরা বন ধ্বংস করবেই।
এ ক্ষেত্রে একা বন বিভাগ কিছুই করতে পারবে না। বিশ্বের কোনো কোনো দেশে কথিত ওষুধ হিসেবে বাঘের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। যে কারণে বাঘ শিকার হচ্ছে। যেসব দেশে বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যবহার রয়েছে, আন্তর্জাতিকভাবে তাদের সচেতন করা জরুরি।
বিশ্ববাজারে বাঘের চাহিদা না থাকলে বাঘ শিকার হবে না। ফটোগ্রাফির মাধ্যমে বাঘ গণনা শেষ হয়েছে। এ গণনা অনুযায়ী সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১০৬। এখন বাঘ সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।