উদ্ভাবনী ক্ষমতায় ইলেকট্রনিকস বাণিজ্যে বিশ্বের শীর্ষ তালিকায় উঠে এসেছে তাইওয়ান। অল্প জনগোষ্ঠী ও সামান্য প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে ছোট এই দেশটি এখন প্রযুক্তিবিশ্বের বিস্ময়। তরুণ উদ্যোক্তাদের উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশেও ডিজিটাল বিপ্লব ঘটানো সম্ভব বলে মনে করেন ড্যাফোডিল গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি মো. সবুর খান। এ জন্য দেশে সরকারি-বেসরকারিভাবে উদ্যোক্তা তৈরির কাজকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাদের দক্ষতা উন্নয়ন থেকে শুরু করে ব্যবসায় দাঁড় করাতে সব রকমের সহায়তা দিতে হবে। তাহলে তারাই একদিন দেশের অর্থনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেবে বলে মনে করেন ড্যাফোডিল গ্রুপের কর্ণধার। সম্প্রতি কালের কণ্ঠ'র বিজনেস এডিটর মাসুদ রুমীকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা তৈরির নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।
সরকারি চাকরির মোহ ত্যাগ করে নব্বইয়ের দশকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ব্যবসা শুরু করেন সবুর খান। ১৯৯২ সালে ড্যাফোডিল ডেস্কটপ পাবলিশিং সেন্টারকে আরো বড় আকারে গড়ে তোলেন এবং এই সময় থেকেই তিনি স্থানীয় বাজার থেকে সংগৃহীত কম্পিউটার অ্যাকসেসরিজ বিক্রি শুরু করেন। ১৯৯৩ সালে সিঙ্গাপুর থেকে আমদানিকৃত যন্ত্রাংশ দিয়ে তিনি সিডিকম ক্লোন পিসি অ্যাসেম্বলিং করে বাজারজাত শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে তাঁর নেতৃত্বে ড্যাফোডিল কম্পিউটার সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। কম্পিউটার ও আইটি ব্যবসা তাঁকে সফলতা এনে দিলেও তিনি অন্যান্য ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন। এখনো তথ্যপ্রযুক্তিতেই নিজের প্রতিষ্ঠান ও দেশের ভবিষ্যৎ দেখছেন তিনি। এ ছাড়া নতুন উদ্যোক্তা তৈরির আন্দোলনেও ব্যাপক সক্রিয় সবুর খান। ড্যাফোডিল গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, 'ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফরে এসে বলেছিলেন, দুই দেশের অর্থনীতিকে বদলে দিতে পারে তরুণরা। নতুন উদ্যোক্তারাই আগামী দিনের ব্যবসায় পরিবর্তন আনবে। আমাদের দেশের তরুণরাই বিদেশে বসে আইফোনের চিপ বানাচ্ছে, গুগল-ফেসবুকে কাজ করছে। কিন্তু দেশে তরুণ উদ্যোক্তাদের অনেক উদ্ভাবন আলোর মুখ দেখছে না।'
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজসহ সারা দেশে প্রচারণা চালিয়ে বিভিন্ন খাতে উদ্যোক্তা তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে। এ উদ্যোগের পুরোধা সাবেক ডিসিসিআই সভাপতি মো. সবুর খান বলেন, 'আমি ঢাকা চেম্বারের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকেই নতুন উদ্যোক্তাদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করি। এখন এফবিসিসিআই নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে গুরুত্বারোপ করেছে। আমি ২০০০ উদ্যোক্তা তৈরির যে উদ্যোগ নিয়েছিলাম তা থেমে যায়নি। এটাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। দেশে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন পণ্য তৈরি হচ্ছে, কিন্তু সেগুলো সফল করার জন্য কাজ করতে হবে। আমাদের নতুন উদ্যোক্তা তৈরির মডেল ব্রুনেই সরকারও অনুসরণ করতে চায়। ব্রুনেইয়ের সুলতান আমাকে দাওয়াত করেছেন।'
অর্থনীতিই এখন সারা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে। কিন্তু অর্থনীতিতে দেশের বেসরকারি খাতের অবদানগুলো স্বীকৃতি দেওয়া উচিত বলে জানান সবুর খান। তিনি বলেন, 'বিদেশে একজন ব্যবসায়ী কোনো ভালো কাজ করলে তাঁকে তুলে ধরার জন্য সবাই সহায়তা করে। কিন্তু আমাদের দেশে হচ্ছে উল্টোটা। কেউ ভালো কাজ করলে তাঁকে যদি উৎসাহিত করা যায় তাহলে তিনি আরো ভালো করবেন। হোন্ডার প্রতিষ্ঠাতাও স্বীকার করেন তিনি এই প্রযুক্তি চুরি করে এনে মানব কল্যাণে কাজে লাগিয়েছেন। ব্যসসায়ীরাও ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। তাদের ভুলের পাশাপাশি ভালো কাজগুলোও গণমাধ্যমে গুরুত্ব পাওয়া উচিত।'
তবে নিজের উদ্যোক্তা গণমাধ্যমের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সবুর খান বলেন, 'প্রখ্যাত সাংবাদিক নাজিম উদ্দীন মোস্তান কলাবাগানে আমার প্রথম আইটি সুপারস্টোর নিয়ে ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠায় নিউজ করেছিলেন। ১৯৯৫ সালের ওই নিউজ আমাকে অনেক এগিয়ে নিয়ে যায়। এভাবে গণমাধ্যমও ব্যবসায়ীদের অগ্রগতির অংশীদার হতে পারে।'
ব্যবসায় ধৈর্য ধরলে সুফল আসে। নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে ড্যাফোডিল গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, 'আমরা ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে ল্যাপটপ দিই, যদিও শুরুতে আমাকে অনেকে নিষেধ করছিল। তারা বলেছিল, এতে ব্যয় বাড়বে। আমি তখন বলেছিলাম, এর সুবিধা আসবে, তবে সময় লাগবে। আমি সেই নীতিতে থেকে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটির শিক্ষার্থীদের এ পর্যন্ত ১২-১৩ হাজার ল্যাপটপ প্রদান করেছি। আমরা কখনোই কোথাও বিজ্ঞাপন দিইনি। এখন আমরা দেখছি তারা ভালো ফল করছে এবং চাকরির বাজারেও অন্যদের চেয়ে বেশি সফল হচ্ছে। এ রকম ধৈর্য ইন্ডাস্ট্রি কিংবা সরকার দেখায় না বলে ফলাফল ভালো আসে না।'
আগামীতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসায় ড্যাফোডিল গ্রুপ জোর দেবে উল্লেখ করে সবুর খান বলেন, 'আমাদের জীবনের বেশির ভাগ শ্রম গেছে সফটওয়্যারের পেছনে। এই ইন্ডাস্ট্রির পেছনে কত কোটি টাকা ব্যয় করেছি তার কোনো হিসাব নেই। রেলের, ব্যাংকের সফটওয়্যার প্রথম দিকে আমার প্রতিষ্ঠান করেছে। কিন্তু যেসব দক্ষ কর্মী এসব কাজ করেছে তাদের আর পরে ধরে রাখা যায়নি। অনেকে বড় বড় চাকরি নিয়ে চলে যায়। আজকের ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের একজন ডিএমডি আমার সফটওয়্যার টিমের একজন সদস্য ছিলেন। আমরা জনশক্তি তৈরির কাজ করছি। আমাদের পণ্য তৈরি। আবার আমরা সফটওয়্যার শিল্পে নতুন উদ্ভাবন যোগ করব। আমরা স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে জোর দিচ্ছি।'
সবুর খান বলেন, 'ড্যাফোডিল গ্রুপের জবস বিডি বাংলাদেশের প্রথম চাকরি খোঁজার পোর্টাল। একসময় আমরা মালয়েশিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত হয়েছিলাম, যদিও সেটা সফল হয়নি। এটাকেও আমরা বড়ভাবে এই খাতে বিনিয়োগ করেছি। খুব শিগগির এটি বাজারে আসবে।'
বাংলাদেশে কম্পিউটার হার্ডওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিতে ড্যাফোডিল ভালো অবস্থানে ছিল উল্লেখ করে সবুর খান বলেন, "দোয়েলের আগমনে স্থানীয় পিসির মান নিয়ে সংশয় তৈরি হয়, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ড্যাফোডিলসহ আরো অনেকে। আমরা প্রচুর কম্পিউটার, মনিটর বিক্রি করেছি যেগুলো খুব ভালোভাবে চলছে। আমরা হার্ডওয়্যারে ভালোভাবে আসব, তবে আমরা একটু সময় নিচ্ছি। ল্যাপটপ, ট্যাবে আমাদের ভালো সম্ভাবনা আছে। আমরা লোকাল ব্র্যান্ড হিসেবে জনপ্রিয় হলেও ইন্ডাস্ট্রির সবাইকে নিয়ে বাংলাদেশি একটি গ্লোবাল ব্র্যান্ড পিসি তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু কেউ আসতে চায়, কেউ চায় না। পরে এ উদ্যোগ থেকে সরে আসি। আমরা স্থানীয়ভাবে পিসি সংযোজন করছি। স্থানীয়ভাবে উৎপাদনে যেতে সরকারি নীতি সহায়তা প্রয়োজন। এইচপি, ডেল সব কিছু তৈরি করে না। তারা অন্যান্য অনেকের কাছ থেকে পণ্য নেয়। ওয়ালটনের অনেক আগে থেকেই আমি ফ্রিজ, টেলিভিশন ইত্যাদি তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলাম। 'এমিগো' নামে আমরা একটি ব্র্যান্ড তৈরি করেছিলাম। কিন্তু আমরা সফল হতে পারিনি। কিন্তু আমরা নেতৃত্ব বাছাইয়ে ভুল করেছিলাম। আমরা এখন ম্যাচিউরড স্টেজে এসেছি। এখন আমরা নতুন কিছু ব্যবসায় হাত দিচ্ছি। ইলেকট্রনিকসের ওয়ান স্টপ শপিংমল তৈরির পরিকল্পনা আছে। চট্টগ্রাম থেকে আমরা এই উদ্যোগ শুরু করেছি। আগ্রাবাদে ইতিমধ্যে আমরা ১০ তলা ভবন করেছি। ডিজিটাল বাংলাদেশের কিছু সার্ভিস ডেভেলপ হয়েছে। কিন্তু এখনো তৃণমূলে এসব সুবিধা পৌঁছে দেওয়া যায়নি।"