যুক্তরাষ্ট্রসহ এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১২টি দেশ বহুল বিতর্কিত ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টায় দীর্ঘ আলোচনার পর গতকাল সোমবার এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী অন্য দেশগুলো হলো অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ব্রুনাই দারুস সালাম, কানাডা, চিলি, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, পেরু, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম।
ডেইরি পণ্য ও ওষুধশিল্প খাতের সুরক্ষা নিয়ে ১২টি দেশের মতপার্থক্য থাকলেও চূড়ান্ত চুক্তির মাধ্যমে অবশেষে তা দূর হলো। এই চুক্তির ফলে দেশগুলো দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিনা শুল্ক সুবিধা পাবে। ১২টি দেশ বর্তমান বৈশ্বিক বাণিজ্যের ৪০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ চুক্তির ফলে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হবে ভিয়েতনাম। টিপিপিতে থাকায় ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিনা শুল্কে তৈরি পোশাক রপ্তানি করতে পারবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের যে চাহিদা রয়েছে, তা দখলে চলে যেতে পারে ভিয়েতনামের। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রায় ১৬ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামী পাঁচ থেকে সাত বছরে বাংলাদেশ যদি বিভিন্ন পণ্য আমদানি শুল্ক কমিয়ে আনতে না পারে, তাহলে আগামী দিনে আমাদের দিকে কেউ ফিরেও তাকাবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভিয়েতনাম যদি টিপিপিসহ আসিয়ান, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বড় বড় বাণিজ্যিক জোটে নিজেদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ কেন পারবে না—আমাদের নীতিনির্ধারকদের তা গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে।’
টিপিপি চুক্তি বাস্তবায়নে বড় বাধা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলোর স্বার্থ ও মুনাফা সংরক্ষণে দেশটির অনমনীয় অবস্থান। যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী, বায়োলজিকস অথবা জীবন্ত উপকরণ থেকে প্রতিষেধক উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে ১২ বছর পর্যন্ত মেধাস্বত্ব সংরক্ষিত থাকে। কিন্তু বিশ্বের সিংহভাগ দেশে এ ধরনের বিষয়ে একচেটিয়া স্বত্বের মেয়াদ পাঁচ বছর। টিপিপি আলোচনায় অংশ নেওয়া দেশের সরকারগুলো যেমন এতে আপত্তি জানিয়েছে, তেমনি বেশ কিছু নাগরিক সংগঠনও এতে উদ্বেগ প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের এই শর্ত মানতে টিপিপির অংশীদার বেশ কয়েকটি দেশকে নিজেদের মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ আইন ও নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন।
তবে এই টিপিপির বিরুদ্ধে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেরই বিভিন্ন গোষ্ঠীর বড় বিরোধিতা রয়েছে। তাদের অভিযোগ, বহুজাতিক বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান এই চুক্তি থেকে লাভবান হবে। এতে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের করপোরেট কোম্পানিগুলোর ব্যবসা ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হবে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাণিজ্য-সংক্রান্ত মেধাস্বত্ব চুক্তির (ট্রিপস) ফলে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো নিজস্ব মেধাস্বত্ব আইনের আওতায় উন্নত বিশ্বের প্রযুক্তি ব্যবহার করে আসছিল। কিন্তু টিপিপিতে ‘বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধা’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এখন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থে উন্নত প্রযুক্তি কিনতে হবে। বাংলাদেশের কৃষি খাত ও ওষুধশিল্প এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।