বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্য চুক্তি: যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে–বাইরে বিরোধিতা বাড়ছে

Author Topic: বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্য চুক্তি: যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে–বাইরে বিরোধিতা বাড়ছে  (Read 2159 times)

Offline mahmudul_ns

  • Full Member
  • ***
  • Posts: 129
  • Never confuse a single defeat with a final defeat.
    • View Profile
দীর্ঘ পাঁচ বছর গোপনে আলাপ-আলোচনার পর আন্তপ্রশান্ত মহাসাগর সহযোগিতা চুক্তি (ট্রান্স পার্টনারশিপ প্যাক্ট, টিপিপি) চূড়ান্ত হলেও যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে-বাইরে এর বিরোধিতা বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ১১টি দেশ এই চুক্তির মাধ্যমে তাদের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধির এক নতুন সহযোগিতা-কাঠামো নির্মাণে সম্মত হলেও এটি কার্যকর করতে অংশগ্রহণকারী ১২টি দেশের আইন পরিষদ কর্তৃক তা অনুমোদিত হতে হবে।
যাঁরা এই চুক্তির বিরোধী, তাঁরা বলছেন, এতে জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষিত হবে এবং বহুজাতিক করপোরেশনগুলো বিপুলভাবে লাভবান হবে। বাংলাদেশের মতো যেসব রাষ্ট্র রপ্তানির বাজারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর কিছুটা নির্ভরশীল, সেসব দেশ এই চুক্তির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এই চুক্তির বিস্তারিত বিবরণ এখনো প্রকাশিত না হওয়ায় এ বিষয়ে বিতর্ক আরও বাড়ছে।
তবে সরকারিভাবে বলা হয়েছে, এই চুক্তির মূল লক্ষ্য চুক্তিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি। এ লক্ষ্যে প্রায় ১৮,০০০ ক্ষেত্রে শুল্ক প্রত্যাহার করার কথা। এর ফলে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি ও সেবা আদান-প্রদানের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে। চুক্তির প্রবক্তারা দাবি করেছেন, চুক্তিভুক্ত দেশগুলোর সাধারণ ভোক্তা আগের তুলনায় অধিক সস্তায় বিভিন্ন পণ্য কিনতে সক্ষম হবে। এ ছাড়া পুঁজি বিনিয়োগের সুযোগ বাড়বে এবং এক দেশ থেকে অন্য দেশে মুনাফা হস্তান্তর সহজতর হবে। একই সঙ্গে এই চুক্তির ফলে শ্রম আইন, পরিবেশ সংরক্ষণ, ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যবসা ও ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টির মালিকানা প্রশ্নে অভিন্ন মানদণ্ড প্রতিষ্ঠিত হবে।
বিশ্বের বৃহত্তম এই বাণিজ্যিক চুক্তির সদস্য যে ১২টি দেশ, তাদের সম্মিলিত মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি প্রায় ২৮ ট্রিলিয়ন ডলার, যা বিশ্বের জিডিপির ৪০ শতাংশ এবং বিশ্বের মোট বাণিজ্যের এক-তৃতীয়াংশ। বাংলাদেশ, ভারত বা দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশে আপাতত এই চুক্তির সদস্য নয়। চীনও এই চুক্তির বাইরে, যদিও বেইজিং ইঙ্গিত দিয়েছে, সে চুক্তিতে যোগ দিতে আগ্রহী।
যাঁরা এই চুক্তির বিরোধী, তাঁরা যুক্তি দেখিয়েছেন, এই চুক্তির ফলে বহুজাতিক করপোরেশনগুলো তাদের স্বার্থ রক্ষা হয়, এমন নানা শর্ত বিভিন্ন দেশের ওপর চাপিয়ে দিতে পারে, যার ক্ষতিকর প্রভাব অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলোর পক্ষে বহন করা কঠিন হবে। ‘বিনিয়োগকারী-রাষ্ট্র বিবাদ মীমাংসা’ (আইএসডিআর) এই নামে পরিচিত চুক্তিভুক্ত শর্ত অনুসারে কোনো দেশের জাতীয় আইনের কারণে তাদের মুনাফা ব্যাহত হলে কোনো বহুজাতিক সংস্থা সে দেশের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা ও মেক্সিকোর মধ্যে সম্পাদিত নাফটা উন্মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতে অনুরূপ একটি ধারা অন্তর্ভুক্ত আছে, যা ব্যবহার করে একাধিক বহুজাতিক কোম্পানি ক্ষতিপূরণ আদায় করে নিয়েছে। ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে যেসব আইনকানুন বর্তমানে চালু আছে, এই চুক্তির মাধ্যমে তার অনেকগুলোর পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই চুক্তির কারণে ওষুধ প্রস্তুতকারক বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের উদ্ভাবিত ওষুধসামগ্রীর পেটেন্টের ওপর মালিকানা দীর্ঘায়িত করতে সক্ষম হবে। ফলে ক্যানসার ও অন্যান্য দুরারোগ্য ব্যাধির প্রতিষেধক সস্তা ‘জেনেরিক’ ওষুধ স্থানীয়ভাবে উৎপাদন কঠিন হয়ে পড়বে। এ ছাড়া কম্পিউটারের সাহায্যে কেউ যদি বহুজাতিক করপোরেশনগুলোর অবৈধ কার্যকলাপের কথা ফাঁস করে দেয়, তারা অপরাধী বলে সাব্যস্ত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইলেকট্রনিক ফ্রন্টিয়ার ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, এই চুক্তির ফলে চুক্তিভুক্ত দেশগুলো বহুজাতিক করপোরেশনের স্বার্থে ইন্টারনেট ব্যবহারের স্বাধীনতা খর্ব করে আইন চালু করতে পারে।
বাংলাদেশ এই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় তার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপর ঋণাত্মক প্রভাব পড়তে পারে বলে যেসব বিশেষজ্ঞ অভিমত প্রকাশ করেছেন, তাঁরা বলছেন যে তৈরি পোশাক খাতে সে ইতিমধ্যেই ভিয়েতনামের কাছ থেকে তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছে। এই চুক্তিতে অন্তর্ভুক্তির সুবাদে ভিয়েতনামের তৈরি পোশাকশিল্প লাভবান হবে। বর্তমানে ভিয়েতনাম সাত বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পিটারসন ইনস্টিটিউটের এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, শুল্কের পরিমাণ যদি শূন্য শতাংশ হয়ে আসে, তাহলে আমেরিকায় ভিয়েতনামে তৈরি পোশাক বিক্রি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অবশ্য ডেনভার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ হায়দার আলী খান প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, টিপিপির ফলে বাংলাদেশ যে খুব বেকায়দায় পড়বে, সে ধারণা সত্য না-ও হতে পারে। বাংলাদেশের বাণিজ্য ইতিমধ্যে যথেষ্ট উন্মুক্ত, রপ্তানি ক্ষেত্রে শুল্কের পরিমাণও এখন তেমন বেশি নয়। তিনি মনে করেন, টিপিপির সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব এড়ানোর জন্য বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সম্পাদন করতে পারে। সে লক্ষ্যে ইতিমধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপে নেওয়া হয়েছে। অধ্যাপক খান মনে করেন, এসব দ্বিপক্ষীয় চুক্তির প্রভাব অনেক দীর্ঘপ্রসারী হতে পারে। তাঁর মতে, টিপিপির ফলে বহুজাতিক সংস্থাগুলোর দাপট বহুগুণে বৃদ্ধি পেলেও এই চুক্তির বাইরে থাকায় বাংলাদেশের ওপর তার প্রভাব পড়বে না।
অধিকাংশ পর্যবেক্ষক একমত যে চুক্তিটির আসল লক্ষ্য চীন। বাণিজ্যিক ও সামরিকভাবে চীন এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যেভাবে তাদের প্রভাব দ্রুত সম্প্রসারিত করছে, যুক্তরাষ্ট্রকে তা উদ্বিগ্ন করেছে। রক্ষণশীল মার্কিন সাময়িকী ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট মন্তব্য করেছে, এই চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্রের মোট অর্থনৈতিক সুফল তার জিডিপির মাত্র ০ দশমিক ৫ শতাংশ। সাময়িকীটি বলছে, ‘অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য নয়, আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে (চীনের বিপরীতে) নিজের আধিপত্য সংহত করাই’ এই চুক্তির আসল লক্ষ্য।
এই চুক্তির ফলে আমেরিকার সাধারণ শ্রমিকদের কোনো লাভ হবে না, বরং অনেক চাকরি বিদেশে চলে যাবে—এই যুক্তিতে আমেরিকার শ্রমিক ইউনিয়নগুলো এই চুক্তির বিরোধিতা করছে। ইতিপূর্বে মেক্সিকো ও কানাডার সঙ্গে সম্পাদিত নাফটা চুক্তির ফলে শুধু মার্কিন চাকরিই নয়, আমেরিকান পুঁজিও মেক্সিকো চলে গেছে। আমেরিকার বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শ্রমিক ও মানবাধিকার সংস্থা চুক্তির বিরোধিতা করে আন্তর্জাতিক স্বাক্ষর অভিযান শুরু করেছে। এই চুক্তির ফলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে ও ইন্টারনেট স্বাধীনতা বিঘ্নিত হবে—এই অভিযোগে আমেরিকার কয়েক শ প্রযুক্তিনির্ভর কোম্পানিও তাদের বিরোধিতার কথা জানিয়েছে।
হিলারি ক্লিনটন ও একাধিক ডেমোক্রেটিক রাজনীতিক যেভাবে চুক্তিটি চূড়ান্ত গোপনীয়তার মধ্যে সম্পাদিত হয়েছে, তার সমালোচনা করেছেন। তবে রিপাবলিকান-নিয়ন্ত্রিত মার্কিন কংগ্রেসে এই চুক্তি অনুমোদন পাবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
Md. Mahmudul Islam
Lecturer, Dept. Of Natural Sciences
Daffodil International University
mahmudul.ns@diu.edu.bd