গরু সম্পর্কিত রচনা

Author Topic: গরু সম্পর্কিত রচনা  (Read 839 times)

Offline ishaquemijee

  • Sr. Member
  • ****
  • Posts: 305
    • View Profile
গরু সম্পর্কিত রচনা
« on: January 12, 2016, 04:07:31 PM »

ছেলে পরীক্ষা উপলক্ষে শিখেছে গরু সম্পর্কে রচনা। কিন্তু পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে এসে গেছে ‘নদী’। অতএব, কী আর করা? সে গরুকে নদীর তীরে নিয়ে এল; লিখল, ‘আমাদের গ্রামে একটি নদী আছে। নদীর তীরে অনেক গরু চরে’। অতঃপর জুড়ে দিল গরু সম্পর্কিত শেখা রচনাটা। আর পরীক্ষার খাতায় দুই ভাইয়ের গরু সম্পর্কিত রচনায় হুবহু মিল পরিলক্ষিত হলে পরীক্ষকের জিজ্ঞাসার জবাবে দুই ভাই সমস্বরে বলে উঠেছিল, ‘তা তো হবেই; কারণ আমরা যে একই গরুকে দেখে লিখেছি।’

এবং গ্রামের এক লোকের গরু হারানো গিয়েছিল; বহু চেষ্টা করেও সেটার খোঁজ পাওয়া গেল না। প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ সাহেবের মতে, প্রতিটি গ্রামেই একজন করে পাগল থাকে। তো সেই পাগল এক ঘণ্টার মধ্যে গরুটি খুঁজে বের করে নিয়ে এসে বলল, ‘আমি চিন্তা করে দেখলাম, আমি গরু হলে কোথায় কোথায় যাইতাম। সেই সব জায়গায় গেছি, গরু পাইয়া গ্যাছিগা।’ আর গ্রামের অপর একজনের গরু হারালে পরে সে সকালে খুঁজতে বেরিয়ে দুপুরে শুষ্ক মুখে বাড়িতে প্রত্যাবর্তনের পর পুত্রকে ‘ভাই’ সম্বোধন করে এক গ্লাস পানি আনতে বললে স্ত্রীর জিজ্ঞাসার জবাবে নাকি বলেছিল, ‘মা, গরু হারালে এমনই হয়।’

ছাত্রাবস্থায় ‘জরাসন্ধ’ রচিত কারাগার সম্পর্কিত গ্রন্থ লৌহকপাট-এ পড়েছিলাম, গরু চুরির অপরাধে ধৃত অপরাধীকে কারাগারে সবচেয়ে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখা হয়। কেননা, গরু চুরি নাকি সবচেয়ে সহজ কাজ, গরুকে গোয়ালঘর থেকে বের করে রাতটা কোনোরকমে ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে রেখে ভোরের আলোয় মানুষের হাঁটাচলার রাস্তায় তুলে দিয়ে গরুর পেছনে পেছনে হাঁটা দিলেই ব্যস, আর কিছু করার দরকার নেই।

মানবদেহের জন্য প্রোটিন অত্যাবশ্যক, আর প্রোটিনের অন্যতম প্রধান উৎস হচ্ছে গরুর মাংস ও ডাল এবং একসময় ডাল অনেক সস্তা ছিল বিধায় ডালকে বলা হতো ‘পুওর ম্যানস বিফ’ তথা গরিবের গরুর মাংস; কিন্তু এখন আর সেই সুদিন নেই। আর আমাদের মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব কোরবানির ঈদ উপলক্ষে জবাইকৃত গরুর মাংসই সারা বছরের প্রোটিনের ঘাটতি বহুলাংশে পুষিয়ে দেয়। তো গল্প আছে: পাশাপাশি মুসলমান ও হিন্দুর বাড়ি। মুসলমানের বাড়িতে কোরবানির মাংস রান্না করায় হিন্দু প্রতিবেশী কোর্টে কেইস করে দিলেন যে যেহেতু ঘ্রাণে অর্ধভোজন হয়ে যায়, অতএব তাঁর জাত গেছে। সময়টা ছিল ব্রিটিশরাজের; ব্রিটিশ বিচারক রায় দিলেন—মুসলমান প্রতিবেশীকে ৫০০ টাকা জরিমানা করা হলো; তবে ২০০০ টাকার পরিমাণ মুদ্রার ঝনঝনানি অভিযোগকারীর কানের কাছে এক ঘণ্টা শোনালেই তা আদায় হয়ে যাবে, যেহেতু ঘ্রাণে অর্ধভোজন আর শ্রবণে সিকি।

বাংলা ভাষায় অনেক শব্দ বা শব্দগুচ্ছও এসেছে গরু থেকে। উদাহরণস্বরূপ: গোবেট, গোমূর্খ, গোধূলি, গোবর-গণেশ, মাথায় গোবর, গো-বেচারা, গোগ্রাসে গেলা, গোবরে পদ্মফুল, ওগায়রা-ওগায়রা

আমাদের দেশে ‘টল-টক্’ তথা লম্বা-চওড়া কথা বলায় ওস্তাদ একজন একবার গল্প করছিলেন, ‘আমার দাদার গোয়ালঘর এত বিশালাকৃতির ছিল যে তার এক প্রান্তে গাভি বাছুর বিয়ালে সেটা অপর প্রান্তে হেঁটে যেতে যেতে নিজেই আরেকটা বাছুর বিয়ানোর উপযুক্ত হয়ে যেত।’ এটা শুনে আরেকজন বলল, ‘আমার দাদার একটি বিশাল লম্বা বাঁশ ছিল, যেটা দিয়ে তিনি মেঘাচ্ছন্ন সকালে মেঘ সরিয়ে রোদ পোহাতেন।’ ‘তা তোমার দাদা এত লম্বা বাঁশটি মাটিতে রাখতেন কোথায়’? প্রথমোক্ত ব্যক্তির এই প্রশ্নের উত্তরে দ্বিতীয় ব্যক্তি জানালেন, ‘তোমার দাদার গোয়ালঘরে।’

গল্পটির একটি চায়নিজ সংস্করণও আছে: জনৈক চায়নিজ বললেন, ‘আমাদের বাড়িতে একটা দারুণ ঢাক আছে, যেটা বাজালে আওয়াজ ১০০ মাইল দূর থেকেও শোনা যায়।’ শুনে অপর চায়নিজ বলে উঠলেন, ‘আমাদের বাড়িতে একটি বিশালাকৃতির গরু আছে, যেটা নদীর এপারে যখন পানি খায়, তখন তার মুখ চলে যায় ওপারে।’ আগের ওস্তাদের ‘এত বিশালাকৃতির গরু কি থাকতে পারে’ প্রশ্নের উত্তরে এবার তিনি বললেন, ‘না থাকলে আপনাদের ওই ঢাকের চামড়া আসবে কোত্থেকে?’

ইসমাইলিয়া শিয়া সম্প্রদায়ের বর্তমান গুরু প্রিন্স করিম আগা খানের দাদা প্রিন্স আলী আগা খানকে একবার নাকি ইউরোপে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘এটা কি সত্যি যে আপনার ধর্মানুসারীরা আপনাকে পূজা করেন?’ তদুত্তরে তিনি মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘আরে, আমি যে ভারতবর্ষের অধিবাসী, সেখানে লোকজন গরুকে পূজা করে; আর আমি তো মানুষ।’

১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের বেলায়ও গরুর একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। সিপাহিদের বন্দুকে যে কার্তুজ ব্যবহৃত হতো, সেটা দাঁত দিয়ে কাটতে হতো। তো গুজব রটে যায় যে এর সঙ্গে গরু ও শূকরের চর্বি মিশ্রিত আছে; তাই কার্তুজ ব্যবহার করলে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সৈন্যদেরই জাত যাবে। তাই দানা বাঁধে বিদ্রোহের, যেটা ব্রিটিশরা অনেক কষ্টে সামাল দিতে পেরেছিল।

গরু সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দেরও (যাঁর পারিবারিক নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত) একটি মজার উপাখ্যান আছে: একবার গিরিধারী লাল নামক এক ব্যক্তি স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎপূর্বক বলল যে সে গো-রক্ষিণী সমিতির সম্পাদক; দুর্বল, রুগ্ণ, জরাগ্রস্ত গো-মাতাদের সেবা করাই তাদের ব্রত। এটা শুনে বিবেকানন্দ বললেন, ‘শুনেছি মধ্য ভারতে দুর্ভিক্ষে প্রায় নয় লাখ লোক মারা গেছে। এ ব্যাপারে আপনারা কী করেছেন? লোকটি বলল, ‘মানুষ মরছে নিজের কর্মফলে। তাদের বাঁচার দরকার কী? আর গাভি হচ্ছে আমাদের মাতা।’ এবারে স্বামীজি সহাস্যে মন্তব্য করলেন, ‘হ্যাঁ, গাভি যে আপনাদের মাতা, সেটা বিলক্ষণ বুঝেছি। কেননা, তা নইলে এমন সব ছেলে জন্মাবে কেন?’

আর গোপাল ভাঁড়ের গল্পেও গরু যথারীতি বিদ্যমান। একদা নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর ভাঁড় গোপালের বুদ্ধি পরীক্ষা করার জন্য বললেন, ‘কাল তুমি আমাকে একসের ষাঁড়ের দুধ এনে দিও।’ গোপাল তো চিন্তায় চিন্তায় অস্থির। তাঁর বউ বললেন, ‘চিন্তার কোনো কারণ নেই; আমি এটা সামাল দিচ্ছি।’ তিনি এক বোঝা কাপড় নিয়ে রাজবাড়ির সামনে নদীর ঘাটে কাচতে শুরু করে দিলেন। রাজা দেখতে পেয়ে প্রশ্ন করাতে তিনি বললেন, ‘আমার স্বামী প্রসব বেদনায় কাতর। তাই আমাকে এ কাজ করতে হচ্ছে।’ রাজা এটা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করাতে গোপাল-পত্নী এবার বললেন, ‘রাজা মশায়, যে দেশে ষাঁড়ের দুধ পাওয়া যায়, সে দেশে ওটা এতই কি অসম্ভব!’ রাজা তখন বিষয়টা বুঝতে পেরে উচ্চ স্বরে হেসে উঠেছিলেন।