৪ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার, দিবাগত রাত প্রায় সাড়ে ১২টায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফটের বার্তা বা সংকেত ব্যবহার করে ৩৫টি অর্থ স্থানান্তরের পরামর্শ বা অ্যাডভাইস পাঠানো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে। ব্যাংলাদেশ ব্যাংকে সুইফট পদ্ধতি ব্যবহারের ব্যাক অফিসে কর্মরত আট কর্মকর্তা ৫ ফেব্রুয়ারি শুক্রবারও কার্যালয়ে দায়িত্ব পালনের জন্য এসেছিলেন। ওই কার্যালয়ে এসে তাঁরা কম্পিউটার খুলতে পারেননি। কম্পিউটারের সঙ্গে সংযুক্ত প্রিন্টারগুলোও অকেজো দেখতে পান। কিন্তু তাঁরা ঊর্ধ্বতন মহলের কাছে এই ‘বিপৎসংকেতটি’ পৌঁছাননি। আর এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রিজার্ভের ১০ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরি হয়ে চলে যায় শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনে। তাই ব্যাক অফিসে ছুটির দিনেও দায়িত্বে থাকা আট কর্মকর্তাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সামগ্রিকভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যপ্রযুক্তি বা আইটি নিরাপত্তার ঘাটতির কারণেই রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনা ঘটেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব এম আসলাম আলম নিজেও এই অদক্ষতার কথা গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন।
পুরো বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তদন্ত শেষ হতে আরও দুই সপ্তাহ লাগবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশে ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মো. রাজি হাসান। গত রাত ১১টায় ব্যাংকিং সচিব এম আসলাম আলম প্রথম আলোকে বলেছেন, এ ঘটনার জন্য সরকারিভাবে তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। অর্থমন্ত্রী শিগগিরই তদন্ত কমিটির বিষয়ে বিস্তারিত ঘোষণা দেবেন।
এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা যেমন বিষয়টি সময়মতো জানাননি, তেমনি বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ লুকিয়ে রেখেছে সরকারের প্রায় সব পক্ষের কাছ থেকেই। অর্থমন্ত্রীকে জানানো হয়নি, জানতেন না বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরাও। ফলে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এখন বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় মুখোমুখি অবস্থানে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গতকাল রোববার সাংবাদিকদের বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এ ক্ষেত্রে ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিষয়টি যেভাবে হ্যান্ডল করেছে, তাতে তিনি খুব আনহ্যাপি (অসুখী)। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
এ নিয়ে অর্থমন্ত্রী গতকাল বিকেলে গণভবনে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে সন্ধ্যায় অর্থমন্ত্রী আবার সচিবালয়ে ফেরেন। গণভবনে কী আলোচনা হয়েছে তা জানা যায়নি। তবে পুরো বিষয়টি নিয়ে আজ সোমবারের নিয়মিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচনা হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
কেবল অর্থমন্ত্রী নন, বিষয়টি জানতেন না বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরাও। ব্যাংকিং সচিব এম আসলাম আলম পদাধিকারবলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদ সদস্য। তিনিও গতকাল বলেছেন যে রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনাটি জেনেছেন প্রায় এক মাস পর। অথচ ওই এক মাসের মধ্যে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও নিরীক্ষা (অডিট) কমিটির তিনটি বৈঠকে ছিলেন। এম আসলাম আলম জানিয়েছেন, গত ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্ষদ সভা এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি ও ১ মার্চের নিরীক্ষা কমিটির সভায় তিনি উপস্থিত ছিলেন। সেখানে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনোভাবেই অর্থ চুরির বিষয়টি নিয়ে কোনো ধরনের আলোচনা হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক থেকে বাংলাদেশের রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনাটি ঘটেছে ৪ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত প্রায় সাড়ে ১২টায়। তাই এটিকে ৫ ফেব্রুয়ারি হিসেবেও ধরা হচ্ছে। ফেব্রুয়ারির শুরুতে ঘটনাটি ঘটলেও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও ব্যাংকিং সচিব এম আসলাম আলম তা জানতে পারেন মার্চের প্রথম সপ্তাহে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অর্থ চুরির ঘটনাটি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সভায় প্রথম আলোচনা হয় ৯ মার্চ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক পরিচালক জানিয়েছেন, ৯ মার্চের পর্ষদ সভার আগে পত্রপত্রিকার মাধ্যমে প্রথম তাঁরা ঘটনাটি সম্পর্কে জানতে পারেন। অর্থমন্ত্রীও ৭ মার্চ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, পত্রিকার মাধ্যমেই তিনি প্রথম অর্থ চুরির বিষয়টি জেনেছেন।
অর্থ চুরির ঘটনাটি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের জরুরি পর্ষদ সভা ডাকা হয়েছে। কাল মঙ্গলবার এ সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এর আগে গতকাল সকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদকক্ষে দীর্ঘ বৈঠক করেন তিনি। বৈঠক থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের ‘জরুরি সভা’ ডাকার এ তথ্য জানান পর্ষদ সদস্য ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব এম আসলাম আলম। ভারত সফরে থাকা গভর্নর আতিউর রহমানের অনুপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ের অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে জরুরি এ সভার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।