একজন এফ আর খান

Author Topic: একজন এফ আর খান  (Read 900 times)

Offline Md. Alamgir Hossan

  • Hero Member
  • *****
  • Posts: 935
  • Test
    • View Profile
একজন এফ আর খান
« on: April 04, 2017, 04:31:23 PM »
আজ তিন এপ্রিল বিশ্বখ্যাত স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার এবং স্থপতি এফ আর খানের অষ্টাশিতম জন্মদিন। ১৯২৯ সালের এই দিনে বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলার শিবপুর উপজেলায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। গুগল যদি আজ তাদের ডুডল দিয়ে খোঁচা না দিত তাহলে আমরা অধিকাংশ বাঙালিরা এই অসাধারণ মানুষটির জন্মদিনটি হয়তো মনেও করতে পারতাম না। অথচ, অত্যন্ত স্বল্পসংখ্যক যে কয়েকজন মানুষ শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বাঙালির অবস্থান বিশ্বমানে তুলে দিয়ে গেছেন, ফজলুর রহমান খান তাদেরই একজন।
ফজলুর রহমান খান ১৯৮২ সালের ২৬শে মার্চ জেদ্দাতে মৃত্যুবরণ করেন। তার পরের বছরেই আমি যুক্তরাষ্ট্রে আসি। সেই সময় এই দেশের মানুষ বাংলাদেশকে প্রায় চিনত না বললেই চলে। কোত্থেকে এসেছ, এই প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ বললে অনেকেরই পরবর্তী প্রশ্ন হতো, “সেটা কোথায়? ” একটু দিন দুনিয়ার খবর রাখে অমন মানুষ হলে বলত, “ও, বাংলাদেশ; তোমাদের দেশে না দুর্ভিক্ষে প্রত্যেক বছর শত শত লোক মারা যায়” অথবা, “তোমাদের দেশটা তো সব সময় বন্যার পানির নিচে থাকে। ” কথাগুলোয় শ্লেষের ছোঁয়া অস্পষ্ট থাকত না। তাই ওই প্রশ্নটার মুখোমুখি হলেই কেমন একটা অস্বস্তিতে ভুগতাম। আশ্চর্য, প্রথম চাকরির ইন্টারভিউতে বসে এই প্রশ্নটাই আমাকে শুনতে হলো। আমার সি ভি তে চোখ বুলাতে বুলাতে ইন্টারভিউ বোর্ডের একজন মন্তব্য করে বসলেন, “তুমি দেখছি বাংলাদেশের লোক। “মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। জানি এর পরেই আসছে পৃথিবীর অন্য প্রান্তের কিছু দুর্ভিক্ষ পীড়িত আরে বন্যা কবলিত মানুষের জন্য হালকা সহানুভূতির কিছু বাণী। কিন্তু না, অবাক হয়ে শুনলাম তিনি বললেন, “তুমি এফ আর খানের দেশের লোক? ” ধাক্কাটা সামলে উঠে উত্তর দেওয়ার আগে বুকটা গর্বে ফুলে উঠল, শুধু বললাম, “জি! ” অবিশ্বাস্য হলেও এই দেশে আমার দ্বিতীয় চাকরির সাক্ষাৎকারের প্রথম দশ মিনিটের মধ্যেই সেই একই প্রসঙ্গ উঠে এল। এবার আর কোনো দেশের লোক-টোক না, সিভির পাতায় চোখ রেখে সরাসরি, “তুমি তো দেখছি এফ আর খানের দেশ থেকে এসেছ। “পেশাগত কারণে এই কথাটি তখন বিভিন্ন ভাবে গত কয়েক বছরে অনেক শোনা হয়ে গেছে; তাই প্রথম ইন্টারভিউর মতো চমকে গেলাম না। কিন্তু, পরের কথাটি শুনে আবারও অবাক হতে হলো। আমার ভাবি চাকরিদাতা বললেন, “তুমি জান, আমি তার সঙ্গে পাঁচ পাঁচটা বছর এক অফিসে কাজ করেছি। “কথাটি বলার সময় মনে হলো তার চোখে একধরনের দ্যুতি খেলে গেল। সেই দ্যুতি, যা দেখা যায় বাংলাদেশের কোনো এক পড়ন্ত বয়েসি গ্রাম্য কৃষকের চোখে যখন সে গল্প করে কেমন করে মাইলের পর মাইল হেঁটে সে একাত্তরের সাতই মার্চে রেসকোর্সের মাঠে গিয়ে পৌঁছেছিল, কিংবা সেই বৃদ্ধার চোখে যার দুটি গালে এখনো জন কেনেডি’র সযত্নে দেওয়া চুম্বনের ছোঁয়া লেগে আছে। এফ আর খানের ব্যাপারে লিখতে গিয়ে বলা এই কথাগুলো কি একটু বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে? হয়তো; কিন্তু ভবন নির্মাণ আর নকশা শিল্পের সঙ্গে জড়িত পেশাজীবীদের কাছে মনে হয় তা হবে না। কি করেছিলেন তিনি, যে কারণে প্রকৌশলী স্থপতিরা তাকে এখনো এত ভক্তিভরে স্মরণ করেন?
এমন অল্প কথায় সব বলা সম্ভব নয়। খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে শুরু করতে হয় উইকিপিডিয়ার ভাষায়, “তিনি ছিলেন কাঠামো প্রকৌশলের আইনস্টাইন। “অথবা ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং “আর্ট অব দা স্কাইস্ক্র্যাপার, দ্য জিনিয়াস অফ ফজলুর খান” বইটির লেখক মীর এম আলী’র মতো, “আমাদের সময়ের শ্রেষ্ঠতম প্রকৌশলীদের একজন” বলে। “কাঠামো প্রকৌশল শুধু বিজ্ঞান নয় শিল্পও,” এই প্রবাদবাক্যের প্রবর্তক প্রিন্সটনের অধ্যাপক ডেভিড বিলিংটন; এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, খান এর প্রকৌশল কর্ম আমার এই প্রবাদবাক্যের জন্য সবচেয়ে বড় উদাহরণ। “বিলিংটন এই সূত্র ধরে আরও বলেছেন, “এই শিল্পের মন্ত্র হচ্ছে, নিয়মনিষ্ঠ দক্ষতা যা দিয়ে কম উপাদান ব্যবহার করে, স্বল্পব্যয়ে, দৃষ্টিনন্দন, ছিমছাম একটি ভবন বানানো যায়; আর এফ আর খানের সমস্ত গগনচুম্বী অট্টালিকায় তা আমরা সহজেই দেখতে পারি। “
ফজলুর রহমান খান নামটা মার্কিনিদের জন্য উচ্চারণ করা বেশ কঠিন ছিল। তার সহকর্মী এবং ঘনিষ্ঠজনেরা তাকে ফায নামে ডাকতেন। স্কিডমোর ওয়িংস অ্যান্ড মেরিল (এসওএম) নামে যে ফার্মের সঙ্গে তিনি ১৯৫৫ সাল থেকে শুরু করে তার মৃত্যুকাল পর্যন্ত কর্মজীবন কাটিয়েছেন, সেখানে খুব নামডাকওয়ালা অনেক স্থপতিরা কাজ করতেন। স্থপতি এবং স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে আবার একধরনের পেশাগত রেষারেষি রয়েছে। একজন স্থপতির শৈল্পিক পরিকল্পনা আর কাঠামো প্রকৌশলীদের বিজ্ঞানভিত্তিক অশৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি নাকি পরস্পর বিরোধী। সেখান থেকেই এই রেষারেষির উৎপত্তি। এই পেশায় যারা আছেন তারা ব্যাপারটা অস্বীকার করতে পারবেন না। কিন্তু, ফায খানের ব্যাপারে তার সহকর্মীরা কেউই সেটা মানতে চান না। কেন তা পরে বলছি, তার আগে বলি তিনি স্কাইস্ক্র্যাপার ডিজাইনে বৈপ্লবিক কি পরিবর্তন এনেছিলেন। যতটা সম্ভব আমার মতো করে বলছি। একটি ভবন যখন আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে, তখন তার কাঠামোর ওপরে পাশ থেকে একটা চাপ আসে। উচ্চতা যত বাড়তে থাকে, মূলত বাতাস কিংবা ভূমিকম্প ভিত্তিক এই চাপও তত বাড়তে থাকে। প্রকৌশলের ভাষায় একে বলে ল্যাটেরাল লোড। এই চাপ সহ্য করার জন্য সুউচ্চ ভবন তৈরিতে, ভিত্তি থেকে শুরু করে কলাম এবং বিমের আয়তন প্রচলিত জ্ঞানে প্রকাণ্ড থেকে প্রকাশের করার দরকার হতো। এতে করে যে শুধু ভবন তৈরির উপাদানের অসাশ্রয় হতো তা নয়, ভবনের চেহারাতেও এর প্রকাশ্য একটা প্রকোপ পড়ত। এফ আর খান “টিউবুলার কনসেপ্ট” নামে একটি মৌলিক প্রকৌশলতত্ত্ব স্কাইস্ক্র্যাপার ডিজাইনে নিয়ে আসেন। টিউবুলার কনসেপ্ট ব্যাপারটা বেশ খটমটে একটা বিষয়, সহজ করে বোঝানোটা আমার সাধ্যের বাইরে। অল্পস্বল্প যা বুঝি তাই বলছি, এর বেশি জানতে চাইলে গুগলের সাহায্য নেওয়ার অনুরোধ করব। ভবনের অঙ্গে যে ল্যাটারেল লোড আসে সেটা সইবার জন্য খান একটি ফাঁপা সিলিন্ডারের মতো কাঠামো প্রস্তাব করেন। যে কাঠামোর মূল ভর থাকবে মাটির নিচে, ওপরের অংশ ভূমির সমান্তরালে ক্যান্টিলেভার হয়ে বেড়ে উঠবে। খুব ঘন ঘন করে বসানো কলাম এবং স্প্যান্ড্রেল বিমের সংযোগে গড়া হবে সেই সিলিন্ডারের দেয়াল। এই দেয়াল একদম নিচ্ছিদ্র না হওয়াতে অবকাঠামো তুলনামূলকভাবে হালকা থেকে যাবে, শুধু তাই নয়, ভেতরের অন্যান্য কাঠামোর ওজনের অনেকটাও সেই বাইরের অবকাঠামোর ওপরে চাপিয়ে দেওয়া যাবে। খানের এই টিউবুলার কনসেপ্ট ব্যবহার করে ১৯৬৮ সালে শিকাগো শহরে গড়ে ওঠে ১০০ তলা ভবন, জন হ্যানকক সেন্টার। তার কিছুদিন পর তৈরি হয় সিয়ার্স টাওয়ার যা ১৯৭৩ সাল থেকে শুরু করে দীর্ঘ ২৫ বছর যাবৎ পৃথিবীর সব চাইতে উঁচু বিল্ডিং হিসেবে সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। তার সরাসরি সম্পৃক্ততায় সেটাই ছিল সর্বোচ্চ ভবন। কিন্তু তিনি আমাদের মাঝে আজ যদিও নেই তবু, সারা পৃথিবীতে স্কাইস্ক্র্যাপার ডিজাইনে এখন পর্যন্ত তার বিকল্প খুঁজে পাওয়া যায়নি। মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস টাওয়ারই হোক আর দুবাইয়ের বুর্জ আল খালিফাই হোক, প্রকৌশলীরা তার কনসেপ্ট ধরেই আজও ডিজাইন করে চলেছেন। স্কাইস্ক্র্যাপার ডিজাইনই যে শুধু তার নাম জড়িয়ে আছে তা কিন্তু নয়। এত এত বিশিষ্ট স্থাপনায় তার নাম জড়িয়ে আছে যে তার সবটা লেখা সম্ভব নয়। জেদ্দা এয়ারপোর্টের হজ টার্মিনাল অনেকের পরিচিত তাই তার কাজের আরেকটি উদাহরণ হিসেবে এখানে উল্লেখ করতে চাইছি।
লেখাপড়ার সূত্রে তিনি যদিও একজন প্রকৌশলী, কিন্তু এসওএম এ তার সহকর্মীদের ভাষ্যমতে, ফায হচ্ছেন স্থপতি এবং প্রকৌশলী দুটোই, দুই পেশার মাঝে তিনি ছিলেন এক অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র। তার কাঠামো পরিকল্পনা স্থাপত্যশৈলীর সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা করে। তাই তাকে স্থপতি হিসেবে দলে টানতে এসওএম এর বাইরের স্থপতিদেরও কখনো আপত্তি করেন না।
এফ আর খানের জীবনী বলতে এই লেখা নয়। তার জন্মদিনে একটি কথা বারবার মনে হচ্ছে বলে এই লেখা; অন্যেরা দিলেও, বাংলাদেশ কি তাকে তার যোগ্য সম্মান দিয়েছে? ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি সিয়ার্স টাওয়ার ডিজাইন করছিলেন। সেই সময় বারবার কাজ ফেলে রেখে আমেরিকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন স্বাধীনতার স্বপক্ষে জনসমর্থন গড়ে তোলার জন্য। ১৯৯৯ সালে তাকে স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়েছে, আর একই বছর ডাক বিভাগ তার নামে চার টাকা দামের একটি ডাকটিকিট বের করেছিল। ব্যাস, ওই পর্যন্তই। যাকে ছাড়া বাঙালির ইতিহাস অপূর্ণ রয়ে যাবে, এই প্রজন্ম কি তাকে চেনে? পরের প্রজন্মের কথা থাক।
অথচ, তার অবলম্বিত দেশ আমেরিকা কিন্তু তার প্রতিভার মর্যাদা দিতে পিছপা হয়নি। জীবদ্দশায় এবং তার মৃত্যুর পরেও তাকে অজস্র প্রাতিষ্ঠানিক সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। তার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানসূচক চেয়ার করা হয়েছে। ২০০৯ সালে মিসরে এক বক্তৃতায়, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যে সমস্ত আমেরিকান মুসলমান নাগরিক এ দেশের সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছে তাদের মাঝে এফ আর খানও একজন বলে উল্লেখ করেছেন। শিকাগো শহরে তার নামে একটি রাস্তার নামকরণ পর্যন্ত করা হয়েছে; আর আমরা?