উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির সব বইয়ের দাম আবারও বাড়ছে। তিন বছরের মাথায় ফের উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ্যবইয়ের দাম বাড়ানোর এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রকাশকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) দাম বাড়ানোর লক্ষ্যে ইতিমধ্যে বাজার যাচাই শুরু করেছে। এ ব্যাপারে শিগগিরই সিদ্ধান্ত আসতে পারে। বাজারে বইয়ের দাম বৃদ্ধির গুঞ্জনে উদ্বিগ্ন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা।
বইয়ের দাম বৃদ্ধির পক্ষে প্রকাশকরা কয়েকটি যুক্তি দিয়েছেন। সূত্র মতে,এরমধ্যে তিন বছর আগের তুলনায় কাগজ, কালিসহ মুদ্রণ উপকরণের দাম, শ্রমিকদের মজুরি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ইত্যাদির বিল বৃদ্ধির কথা তুলে ধরেছেন। এদিকে এনসিটিবির শীর্ষ কর্মকর্তারাও প্রকাশকদের এসব যুক্তি ইতিবাচকই দেখছেন। যে কারণে বইয়ের দাম বৃদ্ধির পক্ষে তারা। প্রকাশকরা আগের তুলনায় ৪০ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কত টাকা বাড়ানো হবে তা নির্ধারণের প্রক্রিয়া চলছে।
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির (বাপুস) সভাপতি আলমগীর সিকদার লোটন বইয়ের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে ১০ মে এনসিটিবিকে চিঠি দেন। এতে বলা হয়, ‘তিন বছর আগে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির প্রথম ও দ্বিতীয়পত্র বই অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। তখন এসব বইয়ের দাম কম নির্ধারণ করা হয়েছিল। এতে প্রকাশকরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হন। তবুও প্রকাশকরা জাতির স্বার্থে বইগুলো বাজারজাত করেন। সময়ের পরিক্রমায় জীবনযাত্রার মান বিবেচনা করে এবং সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির কারণে সব ব্যয় বৃদ্ধির ফলে বর্তমান মূল্যে বই প্রকাশ ও বাজারজাতকরণ দুরূহ হয়ে পড়বে।’
বাপুস পরিচালক শ্যামল পাল বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আমরা প্রতিটি বইয়ের দাম ৪০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছি। এনসিটিবি অনুমোদন দিলে বর্ধিত দামসহ বই ছেপে বাজারে ছাড়ব।
উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে মোট পাঠ্যবই আছে ৩৩ বিষয়ের। এরমধ্যে ৩০ বিষয়ের বই বেসরকারি প্রকাশকরা নিজেদের লেখক দিয়ে লিখে এনসিটিবি থেকে অনুমোদন নেয়। এনসিটিবি এসব বইয়ের দামও নির্ধারণ করে দেয়। এরপর এসব বই প্রকাশকরা বাজারজাত করে। এখন এই ৩০টি বইয়েরই দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এ বছর এসএসসি পাস করেছে ১৪ লাখ ৭৩ হাজার ৫৯৪ শিক্ষার্থী- যারা একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হবে। এছাড়া গত বছর একাদশে ভর্তি হয়েছে ১২ লাখের বেশি, যারা এখন দ্বিতীয় বর্ষে উঠবে। সেই হিসাবে ৩০টি বিষয়ের মোট ৬০টি বইয়ের ক্রেতা অন্তত ২৭ লাখ শিক্ষার্থী। যদি প্রতিটি বইয়ের দাম গড়ে ৪০ টাকা করেও বাড়ানো হয়, তাহলে এ খাতে অন্তত সোয়া ৩শ’ কোটি টাকা বেশি আদায় হবে। এসব টাকা ছাত্রছাত্রী বা তাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে যাবে প্রকাশকদের পকেটে।
শুধু বেসরকারি খাতের বই-ই নয়, এনসিটিবির তত্ত্বাবধানে থাকা ৩ বইয়ের দাম বাড়ানোর কূটকৌশলও চলছে। এ তিনটি বই হচ্ছে- বাংলা সাহিত্য, বাংলা সহপাঠ এবং ইংরেজি প্রথমপত্র। এসব বইয়ের মুদ্রণ ও বাজারজাত কাজ দিতে টেন্ডার ডাকা হয়েছিল। ২৫ মে শেষ দিন টেন্ডার বক্স খুলে দেখা যায়, মাত্র ১টি সিডিউল জমা পড়েছে। অথচ ২০টি লটের জন্য ১১৩টি সিডিউল বিক্রি হয়েছিল। ওই দিন এনসিটিবির কর্মকর্তা এবং কয়েকজন প্রকাশকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুই কারণে টেন্ডারে সারা মিলেনি। একটি হচ্ছে- আগের বছরের তুলনায় বইয়ের রয়্যালটি, পারফরমেন্স গ্যারান্টি এবং বিটমানির হার বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বইয়ের দাম বাড়ানো হয়নি। অর্থাৎ, এই তিন বইয়ের ক্ষেত্রেও পরোক্ষভাবে দাম বাড়ানোর চাপ সৃষ্টি করেছেন প্রকাশক ও মুদ্রাকররা। অথচ দু’বছর আগেও এ তিন বইয়ের দাম বাড়ানো হয়েছিল।
২০১৪ সালের জুনের আগে বাংলা বইয়ের দাম ছিল ৪৫ টাকা। এটা ১২৬ শতাংশ দাম বাড়িয়ে রাখা হয়েছে ১০২ টাকা। ইংরেজি বইয়ের দাম ছিল ৬৮ টাকা, যা বাড়িয়ে ৯০ টাকা করা হয়। বাংলা সহপাঠের মূল্য ৪৭ টাকা। এটির দাম আগে কম ছিল। এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ তিন বইয়ের বাজারজাত কার্যক্রম ২০১৪ সালের আগে সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। বাজারজাতে নানা জটিলতা ও লোকসানের কারণে ২০১৪-১৫ শিক্ষা বর্ষ থেকে অফারিং পদ্ধতিতে (ছেপে বাজারজাত করার জন্য বেসরকারি প্রকাশকদের আহ্বান জানিয়ে চুক্তি করা) ১৫ প্রকাশকের মাধ্যমে বাজারজাত করছে। এখন যদি দাম বাড়ানো না হয়, তাহলে নকল বইয়ে বাজার সয়লাব হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার রাজস্ব হারাবে। এভাবে এ তিন বইয়ের ক্ষেত্রে এনসিটিবি জিম্মি দশায় পড়েছে।
এদিকে বাজারে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির সকল বইয়ের মূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা। একজন উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীর অভিভাবক মো: নজরুল ইসলাম মুন্সি বলেন, বিনা কারণেই যখন দেশে সকল কিছুর মূল্য চড়া তার ওপর বইয়ের দাম বাড়ার অর্থ হল মরার উপর খারার ঘাঁ।
এদিকে আবু সামী নামে আরেক অভিভাবক বলেন, বাজেটে শিক্ষা খাতে সরকারের বরাদ্দ বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও শিক্ষা উপকরণে মূল্য বৃদ্ধির কোন কারণ থাকতে পারে না।