ইসলামী শরিয়তে জাকাতের বিধিবিধান

Author Topic: ইসলামী শরিয়তে জাকাতের বিধিবিধান  (Read 2147 times)

Offline akazad600

  • Newbie
  • *
  • Posts: 45
  • Test
    • View Profile
ন্যূনতম মৌলিক অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে গেলেও সবার আগে অর্থের প্রয়োজন পড়ে। বলা যায়, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই অর্থের প্রয়োজন। এমনকি ইবাদাত-বন্দেগি, পূজা-অর্চনা—কোনো কিছুই অর্থ ছাড়া সম্ভব নয়। ইসলামের পাঁচটি মৌলিক বিধানও অর্থ ছাড়া পূর্ণাঙ্গরূপে প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।

জাকাত ইসলামী সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান। জাকাত একদিকে দরিদ্র, অভাবী ও অক্ষম জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি, অন্যদিকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান হাতিয়ার।

জাকাত শব্দের আরবি অর্থ হচ্ছে পবিত্রতা, ক্রমবৃদ্ধি, আধিক্য ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থে জাকাত বলতে ধনীদের ধন-মালে আল্লাহর নির্ধারিত অংশকে বোঝায়। জাকাত সম্পদকে পবিত্র করে, বিত্তশালীদের পরিশুদ্ধ করে, দারিদ্র্য মোচন করে, উত্পাদন বৃদ্ধি করে, অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করে এবং সমাজে শান্তি আনে। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে তৃতীয়টি হচ্ছে জাকাত। ইমানের পর নামাজ ও তার পরই জাকাতের স্থান। কোরআন মজিদের ৩২ জায়গায় জাকাতের কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে ২৮ জায়গায় নামাজ ও জাকাতের কথা একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।

জাকাত কে দেবে?

জাকাত স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক এমন মুসলিম নর-নারী আদায় করবে, যার কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ আছে। তবে এর জন্য শর্ত হলো—এক. সম্পদের ওপর পূর্ণাঙ্গ মালিকানা থাকতে হবে। দুই. সম্পদ উত্পাদনক্ষম ও বর্ধনশীল হতে হবে। তিন. নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে। চার. সারা বছরের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর পর অতিরিক্ত সম্পদ থাকলেই কেবল জাকাত ফরজ হবে। পাঁচ. জাকাত ফরজ হওয়ার জন্য ঋণমুক্ত হওয়ার পর নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা শর্ত। ছয়. কারো কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক বছর থাকলেই কেবল সে সম্পদের ওপর জাকাত দিতে হবে।

জাকাতের নিসাব

ক. সোনা ৭.৫ তোলা=৯৫.৭৪৮ গ্রাম প্রায়। খ. রুপা ৫২.৫ তোলা=৬৭০.২৪ গ্রাম প্রায়। (আহসানুল ফতোয়া ৪/৩৯৪, আল ফিকহুল ইসলামী ২/৬৬৯)

দেশি-বিদেশি মুদ্রা ও ব্যবসায়িক পণ্যের নিসাব নির্ধারণে সোনা-রুপা হলো পরিমাপক। এ ক্ষেত্রে ফকির-মিসকিনদের জন্য যেটি বেশি লাভজনক হবে, সেটিকে পরিমাপক হিসেবে গ্রহণ করাই শরিয়তের নির্দেশ। সুতরাং মুদ্রা ও পণ্যের বেলায় বর্তমানে রুপার নিসাবই পরিমাপক হিসেবে গণ্য হবে। তাই যার কাছে ৫২.৫ তোলা সমমূল্যের দেশি-বিদেশি মুদ্রা বা ব্যবসায়িক পণ্য মজুদ থাকবে, তার ওপর জাকাত ওয়াজিব হবে। যে সম্পদের ওপর জাকাত ফরজ, তার ৪০ ভাগের একভাগ (২.৫০%) জাকাত দেওয়া ফরজ। সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করে শতকরা আড়াই টাকা বা হাজারে ২৫ টাকা হারে নগদ অর্থ কিংবা ওই পরিমাণ টাকার কাপড়চোপড় বা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে দিলেও জাকাত আদায় হবে। (আবু দাউদ, হাদিস : ১৫৭২; সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৬২৩)

যেসব সম্পদে জাকাত ফরজ

সব ধরনের সম্পদে জাকাত ফরজ হয় না। শুধু সোনা-রুপা, টাকাপয়সা, পালিত পশু (নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী) এবং ব্যবসার পণ্যে জাকাত ফরজ হয়।

সোনা-রুপার অলংকার সব সময় বা কালেভদ্রে ব্যবহৃত হোক কিংবা একেবারেই ব্যবহার না করা হোক সর্বাবস্থায় তার জাকাত দিতে হবে। (আবু দাউদ শরিফ : ১/২৫৫; নাসায়ি, হাদিস : ২২৫৮)

অলংকার ছাড়া সোনা-রুপার অন্যান্য সামগ্রীর ওপরও জাকাত ফরজ। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭০৬১)

মৌলিক প্রয়োজন থেকে উদ্বৃত্ত টাকাপয়সা নিসাব পরিমাণ হলে এবং এক বছর স্থায়ী হলে বছর শেষে তার জাকাত আদায় করা ফরজ। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭০৯১)

ব্যাংক ব্যালেন্স, ফিক্সড ডিপোজিট, বন্ড, সার্টিফিকেট ইত্যাদিও নগদ টাকাপয়সার মতোই। এসবের ওপরও জাকাত ফরজ।

টাকাপয়সা ব্যবসায় না খাটিয়ে এমনি রেখে দিলেও তাতে জাকাত ফরজ। (আদ্দুররুল মুখতার : ২/২৬৭)

হজের উদ্দেশ্যে কিংবা ঘরবাড়ি নির্মাণ, ছেলেমেয়ের বিয়েশাদি ইত্যাদি প্রয়োজনের জন্য যে অর্থ সঞ্চয় করা হয়, তাতেও জাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ১০৩২৫)

দোকানপাটে যা কিছু বিক্রির উদ্দেশ্যে রাখা থাকে, তা বাণিজ্যিক পণ্য। এর মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে জাকাত আদায় করা ফরজ। (সুনানে আবু দাউদ : ১/২১৮)

ব্যবসার নিয়তে কোনো কিছু ক্রয় করলে তা স্থাবর সম্পত্তি হোক যেমন—জমিজমা, ফ্ল্যাট কিংবা অস্থাবর সম্পত্তি যেমন—মুদিসামগ্রী, কাপড়চোপড়, অলংকার, নির্মাণসামগ্রী, গাড়ি, ফার্নিচার, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, হার্ডওয়্যার সামগ্রী, বইপুস্তক ইত্যাদি, তা বাণিজ্যিক পণ্য বলে গণ্য হবে এবং মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে জাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭১০৩)

যদি সোনা-রুপা, টাকাপয়সা কিংবা বাণিজ্যিক পণ্যের মধ্যে কোনোটি পৃথকভাবে নিসাব পরিমাণ না থাকে, কিন্তু এসবের একাধিক সামগ্রী এ পরিমাণ রয়েছে, যা একত্র করলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমমূল্য বা তার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে এ ক্ষেত্রে সব সম্পদ হিসাব করে জাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭০৮১)

যেসব সম্পদে জাকাত ফরজ নয়

সোনা-রুপা ছাড়া অন্য কোনো ধাতুর অলংকার ইত্যাদির ওপর জাকাত ফরজ নয়। তদ্রূপ হীরা, মণি-মুক্তা ইত্যাদি মূল্যবান পাথর ব্যবসার পণ্য না হলে সেগুলোতেও জাকাত ফরজ নয়। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ৬/৪৪৭-৪৪৮)

নিজ ও অধীনস্থ পরিবারপরিজনের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও বাহনের ওপর জাকাত ফরজ নয়। (মুসান্নাফে আবি শায়বা, হাদিস : ১০২০৭)

গৃহের আসবাবপত্র যেমন—খাট-পালঙ্ক, চেয়ার-টেবিল, ফ্রিজ, আলমারি ইত্যাদির জাকাত ফরজ নয়। অনুরূপ গার্হস্থ্য সামগ্রী যেমন হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাটি, গ্লাস ইত্যাদির ওপর জাকাত ফরজ নয়। (মুসান্নাফে আবি শায়বা, হাদিস : ১০৫৬০)

পরিধানের বস্ত্র, জুতা যদি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশিও থাকে, তবুও তাতে জাকাত ফরজ হয় না। (রদ্দুল মুহতার : ২/২৬৫)

ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের এমন আসবাবপত্র যা ব্যবসার পণ্য নয়, তার ওপর জাকাত ফরজ নয়।

ঘরবাড়ি বা দোকানপাট তৈরি করে ভাড়া দিলে তাতেও (মূল দামের ওপর) জাকাত ফরজ নয়। তবে এসব ক্ষেত্রে ভাড়া বাবদ বছরে যে অর্থ পাওয়া যাবে, তা যদি প্রয়োজন অতিরিক্ত হয়ে নিসাব পরিমাণ হয়, তবে সেই ভাড়ার ওপর জাকাত ফরজ।

ভাড়া দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঘরবাড়ি বা অন্য কোনো সামগ্রী—যেমন ডেকোরেটরের বড় বড় ডেগ, থালাবাটি ইত্যাদি ক্রয় করলে তার ওপরও জাকাত ফরজ নয়। তবে ভাড়া বাবদ প্রাপ্ত অর্থের ওপর জাকাত আসবে।

কারো ঋণ যদি এত হয়, যা বাদ দিলে তার কাছে নিসাব পরিমাণ জাকাতযোগ্য সম্পদ থাকে না, তাহলে তার ওপর জাকাত ফরজ নয়। (মুয়াত্তা মালেক : ১০৭; আদদুররুল মুখতার : ২/২৬৩)

কিন্তু এখানে মনে রাখতে হবে, ঋণ দুই ধরনের হয়ে থাকে। ক. প্রয়োজনাদি পূরণের জন্য বাধ্য হয়ে যে ঋণ নেওয়া হয়। খ. ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যে ঋণ নেওয়া হয়।

প্রথম প্রকার ঋণ সম্পদ থেকে বাদ দিয়ে জাকাতের হিসাব করতে হবে। কিন্তু যেসব ঋণ উন্নয়নের জন্য নেওয়া হয়, যেমন—কারখানা বানানো, ভাড়া দেওয়া বা বিক্রি করার উদ্দেশ্যে বিল্ডিং বানানো অথবা ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ঋণ নিলে জাকাতের হিসাবের সময় সে ঋণ ধর্তব্য হবে না। এ ধরনের ঋণের কারণে জাকাত কম দেওয়া যাবে না। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭০৮৭)

কেউ অন্যের কাছে টাকা পেলে পাওনা উসুল হওয়ার পর ওই টাকার জাকাত আদায় করা ফরজ। তার আগে আদায় করা জরুরি নয়, তবে আদায় করলে জাকাত আদায় হয়ে যাবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ১০৩৫৬)

তাই স্বামীর কাছে পাওনা মোহরানা নিসাব পরিমাণ হলেও তা স্ত্রীর হস্তগত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাতে জাকাত ফরজ হয় না।

যাদের জাকাত দেওয়া যাবে

জাকাত কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও জাকাতের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য আর যাদের মনোরঞ্জন উদ্দেশ্য, তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারী ও মুসাফিরের জন্য। এটা আল্লাহর বিধান।

যে দরিদ্র ব্যক্তির কাছে অতি সামান্য মাল আছে অথবা কিছুই নেই, এমনকি এক দিনের খাদ্যও নেই, এমন লোক শরিয়তের দৃষ্টিতে গরিব। তাকে জাকাত দেওয়া যাবে।

যার কাছে জাকাতযোগ্য সম্পদ আছে, সে শরিয়তের দৃষ্টিতে ধনী। তাকে জাকাত দেওয়া যাবে না।

অনুরূপভাবে যে ব্যক্তির কাছে জাকাতযোগ্য সম্পদ নিসাব পরিমাণ নেই, কিন্তু প্রয়োজন অতিরিক্ত অন্য ধরনের সম্পদ আছে, যাতে জাকাত আসে না—যেমন ঘরের আসবাবপত্র, পরিধেয় বস্ত্র, জুতা, গার্হস্থ্য সামগ্রী ইত্যাদি নিসাব পরিমাণ আছে, তাকেও জাকাত দেওয়া যাবে না। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭১৫৬)

তবে এই ব্যক্তির ওপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব।

জাকাত আদায় হওয়ার জন্য শর্ত হলো, উপযুক্ত ব্যক্তিকে মালিক বানিয়ে দেওয়া। যাতে সে নিজের খুশিমতো তার প্রয়োজন পূরণ করতে পারে। এরূপ না করে যদি জাকাতদাতা নিজের খুশিমতো দরিদ্র লোকটির কোনো প্রয়োজনে টাকাটি খরচ করে যেমন—তার ঘর সংস্কার করে দিল, টয়লেট স্থাপন করে দিল কিংবা পানি বা বিদ্যুতের ব্যবস্থা করল, তাহলে জাকাত আদায় হবে না। (রদ্দুল মুহতার : ২/২৫৭)

আত্মীয়স্বজন যদি জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত হয়, তাহলে তাদের জাকাত দেওয়াই উত্তম। ভাই, বোন, ভাতিজা, ভাগ্নে, চাচা, মামা, ফুফু, খালা এবং অন্য আত্মীয়দের জাকাত দেওয়া যাবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭১৬০)

তাদের জাকাতের কথা না বলে মনে মনে জাকাতের নিয়ত করলেও জাকাত আদায় হয়ে যাবে। এ ধরনের ক্ষেত্রে এটাই উত্তম।

নিজ মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, পরদাদা প্রমুখ ব্যক্তি—যারা তার জন্মের উৎস তাদেরকে নিজের জাকাত দেওয়া জায়েজ নয়। এমনিভাবে নিজের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি এবং তাদের  অধস্তনকে নিজ সম্পদের জাকাত দেওয়া জায়েজ নয় । স্বামী ও স্ত্রী একে অন্যকে জাকাত দেওয়া জায়েজ নয় । (রদ্দুল মুহতার : ২/২৫৮)

জাকাত দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময়ের বাধ্যবাধকতা নেই। যার জন্য যেভাবে বছর গণনা করা সুবিধাজনক হয়, সে সেভাবেই জাকাত আদায় করবে। তার পরও রমজান মাসেই বিত্তবানরা দান-সদকা ও জাকাত প্রদানে উৎসাহী হন। কেননা রমজান মাসে যেকোনো ধরনের দান-সদকা করলে অন্য সময়ের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি সাওয়াব পাওয়া যায়। স্মরণ রাখতে হবে, এ মাসেই জাকাত আদায়ের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
- See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/islamic-life/2016/06/24/373688#sthash.lGZSQBh3.dpuf

Offline fahad.faisal

  • Hero Member
  • *****
  • Posts: 734
  • Believe in Hard Work and Sincerity.
    • View Profile
Thanks for sharing.
Fahad Faisal
Department of CSE