বাংলাদেশের শিল্প-বাণিজ্যের এক পথিকৃতের নাম আমজাদ খান চৌধুরী

Author Topic: বাংলাদেশের শিল্প-বাণিজ্যের এক পথিকৃতের নাম আমজাদ খান চৌধুরী  (Read 1129 times)

Offline Sultan Mahmud Sujon

  • Administrator
  • Hero Member
  • *****
  • Posts: 2669
  • Sultan Mahmud Sujon, Sr. Admin Officer
    • View Profile
    • Helping You Office Operation & Automation Management
বাংলাদেশের শিল্প-বাণিজ্যের এক পথিকৃতের নাম আমজাদ খান চৌধুরী। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের অর্থনীতির মূলধারাকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে এ দেশে এক শিল্পবিপ্লব ঘটিয়েছেন তিনি। যত দূর মনে পড়ে, ১৯৮৮ সালে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়।

মতিঝিলের শিল্প ব্যাংকের পাশে বিআরটিসি ভবনে তাঁর অফিস। আমাকে সেখানে ডেকেছিলেন। তার ঠিক কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনে আমার নিয়মিত অনুষ্ঠান ‘মাটি ও মানুষ’-এ বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো মাশরুম চাষ নিয়ে একটি প্রতিবেদন দেখিয়েছিলাম, যখন দেশের মানুষের কাছে মাশরুমের কোনো পরিচিতি ছিল না। সবাই সেটিকে ব্যাঙের ছাতাই মনে করত। আমজাদ খান চৌধুরী এর বছর দু-এক আগে কৃষিপণ্যকে শিল্পপণ্যে রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু করেছেন।

প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছেন প্রাণ। একে তো আমার তরুণ বয়স, তার ওপর টেলিভিশনে কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠান যখন হিসাবের মধ্যেই আসেনি, তখন অনুষ্ঠান দেখে একজন শিল্পোদ্যোক্তার ডাক আমার কাছে বেশ বড় ব্যাপারই ছিল। তিনি চিন্তা করছিলেন মাশরুমের মতো পণ্যকে টিনজাত খাদ্যপণ্য হিসেবে বিদেশে বাজারজাত করা যায় কি না। তখন বিদেশ থেকে টিনজাত মাশরুম বাংলাদেশে আসত।

সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে এ দেশের জন্য এটি ছিল দারুণ এক উদ্ভাবনী চিন্তা। একজন শিল্পোদ্যোক্তা অনেক কৃষি ফসল বাদ দিয়ে মাশরুম নিয়ে এমন চিন্তা করছেন জেনে তাঁর চিন্তার জায়গাটি আমার কাছেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি বলছিলেন প্রাণ নিয়ে তাঁর স্বপ্নের যাত্রার কথা। কীভাবে বাংলাদেশের কৃষির সঙ্গে শিল্পের এক বিশাল সংযোগ গড়ে তোলা যায়, তা নিয়ে তাঁর স্বপ্নের নানা দিক আমার সামনে তুলে ধরেন। তাঁর চিন্তার সঙ্গে আমার মনের ভেতরে তৈরি একটি দৃশ্যপটের যেন মিল খুঁজে পেলাম। মাটি ও মানুষ করতে করতেই বারবার কাঙ্ক্ষিত দৃশ্যপটটি চোখে ভাসত।
গ্রামের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া হাইওয়ে দিয়ে একটি দামি গাড়ি কৃষকের খেতের পাশে গিয়ে থামল, সফেদ স্যুট-কোটের ভেতর থেকে একটি হাত বেরিয়ে এসে কৃষকের কাদামাখা হাতের সঙ্গে যুক্ত হলো। সংযোগ তৈরি হলো প্রান্তিক কৃষকের সঙ্গে একজন শিল্পোদ্যোক্তার। মনে হলো, আমজাদ খান চৌধুরীর মতো মানুষের মাধ্যমেই এমন দৃশ্যপট রচিত হতে পারে। সেই থেকে আমজাদ খান চৌধুরীর সঙ্গে সখ্য। এই সখ্য টিকে ছিল তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।

কৃষিতে এসে আমজাদ খান চৌধুরী প্রাণ কোম্পানির মাধ্যমে বিভিন্ন কৃষিপণ্যের চুক্তিভিত্তিক উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ শুরু করেন। শুরুটা নরসিংদীর রূপগঞ্জে পেঁপে চাষের মধ্য দিয়ে। পর্যায়ক্রমে ঘোড়াশাল এলাকায় যুক্ত হলো কলা আর আনারস চাষ। সেখান থেকেই তাঁর মাথায় এল কৃষিপণ্যের মূল্য সংযোজন করা এবং ফসল খেত থেকে তোলার পর তার স্থায়িত্ব (Shelf life) বাড়ানোর চিন্তা। ভাবলেন, কৃষিপণ্যের বহুমুখী মূল্য সংযোজন ছাড়া কৃষক যেমন লাভবান হতে পারবেন না, একইভাবে এর বাণিজ্যিকীকরণও সফল হবে না। এখান থেকেই একে একে শিল্পের বিশাল সাম্রাজ্যে তাঁর সাফল্যের পথচলা। ১৯৯২ সালে নরসিংদীর ঘোড়াশালে গড়ে তোলা হলো প্রথম ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা। শুরু হলো আনারস প্রক্রিয়াজাতকরণ। সেই থেকে শুরু হয়ে সেই প্রাণ আজ বহু দূর। বাংলাদেশ নয় শুধু, সারা পৃথিবীতে শিল্পে কৃষিপণ্যের ব্যবহারের সংখ্যার হিসাবে প্রাণ এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। প্রাণের কৃষিভিত্তিক শিল্পপণ্যের সংখ্যা এখন দুই হাজারের ওপরে। পৃথিবীর ১২৪টি দেশে প্রাণের পণ্যের একচ্ছত্র বাজার।

সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক বিষয়টি হচ্ছে, দেশের এক লাখের মতো কৃষক সরাসরি প্রাণের চুক্তিভিত্তিক উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। এটি যেন সেই স্বপ্নের সঙ্গে মিলে যায়। নগরের শিল্পোদ্যোক্তার সঙ্গে লক্ষাধিক কৃষকের মাটিমাখা হাত যুক্ত হয়ে গেছে। প্রাণের এই সফলতার পথ ধরে একে একে বহু শিল্পোদ্যোক্তা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান কৃষিশিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।

নিজস্ব শিল্প পরিমণ্ডলে আমজাদ খান চৌধুরী ছিলেন আর দশজন কর্মীর মতোই। তাঁর শিল্পবাগানে দিনে দিনে তিনি বৈতনিক কর্মী হিসেবে যোগ করেছেন ৮০ হাজার মানুষকে। দেশে-বিদেশে তাঁর কর্মযজ্ঞের সরাসরি সুফলভোগী ২০ লাখেরও বেশি মানুষ। এ দেশে কৃষিপণ্যকে শিল্পপণ্যে রূপ দেওয়ার সবচেয়ে বৃহৎ আয়োজক আমজাদ খান চৌধুরী। নাটোরের প্রাণের প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রে গিয়ে জেনেছি, ওই এলাকার আমবাগানের মালিক থেকে শুরু করে সাধারণ চাষি ও স্থানীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনে এক সুদিন ফিরে এসেছে প্রাণের কারখানাকে ঘিরে। একসময় আশ্বিনা আম, দেশীয় গুটি আম টক হওয়ার কারণে বাগানেই পড়ে নষ্ট হতো, সেগুলো ভালো দামে প্রাণ কিনে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে ম্যাঙ্গো জুস করছে, ম্যাঙ্গো বার করছে—এগুলোই কৃষকের জন্য নতুন এক অভিজ্ঞতার জন্ম দিয়েছে। আজ প্রাণের ১৩টি কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানাকে ঘিরে অজস্র কৃষক আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন।

আমজাদ খান চৌধুরী ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী একজন মানুষ। দেশের কৃষি ও শিল্পের মধ্যে অনেক বড় একটি জায়গা তৈরির পর তিনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন আমাদের দুগ্ধশিল্প নিয়ে। ভারতের আমুল দুগ্ধশিল্প বিশ্বের মধ্যে আজ এক উদাহরণ। মিল্ক ভিটাকে ঘিরে তেমনি আমাদের বিরাট একটি সাফল্যের গল্প তৈরি হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু হয়নি। এ ক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে নানা সংকট। কিন্তু এই জায়গা থেকেই দুগ্ধশিল্প পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াবে এমন স্বপ্নই দেখতেন আমজাদ খান চৌধুরী। তিনি দুগ্ধশিল্পের সমস্ত ব্যর্থতা ও সংকটকে স্বীকার করে নিয়েই বলেছিলেন, ‘২০২০ সালের মধ্যেই আমরা দুগ্ধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হব।’ যখন আমাদের উৎপাদন মাত্র ২০ শতাংশ, সেখানে দাঁড়িয়ে তাঁর এই উচ্চারণ সত্যিই অবাক করার মতো।

অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম, এই বাংলাদেশকে শিল্পে ও সম্ভাবনায় আজকের এই জায়গাটিতে আনার পেছনে যেসব মানুষ ছোট্ট একটি জায়গা থেকে সংগ্রাম শুরু করে বিশাল নজির গড়েছেন, তাঁদের নিয়ে একটি বিশেষ প্রামাণ্য অনুষ্ঠান নির্মাণ করব। যাঁদের কথা চিন্তা করেছিলাম, তাঁদের মধ্যে আমজাদ খান চৌধুরীও ছিলেন। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম ও বাস্তবতায় তিনি হারিয়ে গেছেন আমাদের মাঝ থেকে। প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি নিরন্তর সংগ্রামী এই মানুষটিকে।
শাইখ সিরাজ: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই।



http://www.prothom-alo.com/…/%E0%A6%8F%E0%A6%95%E0%A6%9C%E0…