সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমসমূহে অতি তীব্র ভূমিকম্পের সম্ভাব্য স্থান হিসেবে ঢাকা শহরকে যেভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে তা সাধারণ জনগণকে কিছুটা বিভ্রান্ত ও কিছুটা আতঙ্কিত করেছে। একজন শিল্পপতি এই লেখককে বলেই বসলেন যে ৮ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ করে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা কতটা যুক্তিসংগত হবে তা তিনি ভাবতে শুরু করেছেন। তিনি জানালেন, কম্পিউটারে ইন্টারনেট ঘেঁটে ঘেঁটে তিনি জেনেছেন যে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প মানে সর্বাত্মক ধ্বংসলীলা। বাস্তবিকই তাই, ভূমিকম্প মাত্রার স্কেলে ৯ মাত্রার সংজ্ঞা সর্বাত্মক ধ্বংসই বটে।
ওপরে উল্লিখিত ভূমিকম্পের সংবাদটি দেশি-বিদেশি কয়েকজন ভূবিজ্ঞানী কর্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণা রচনার সূত্রে পরিবেশন করা হয়। নেচার জিওসায়েন্স নামের পত্রিকাতে উপরিউক্ত গবেষক দল বেশ কয়েক বছর ধরে চালানো কাজের ওপর ভিত্তি করে প্রবন্ধটি প্রকাশ করেন। ওই গবেষণাকাজে মাঠভিত্তিক উপাত্ত সংগ্রহের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা হলেও উপাত্তসমূহের বিশ্লেষণ বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকেনি। দেশের একাধিক ভূবিজ্ঞানী উপরিউক্ত গবেষকদের বিশ্লেষণের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তাঁদের মতে, উপাত্ত বিশ্লেষণের একাধিক পর্যায়ে গবেষক দলের মতসমূহ বহুলাংশে অনুমানভিত্তিক। আর এহেন অনুমানভিত্তিক বিশ্লেষণের ওপর নির্ভর করে একটি এলাকা বা শহরকে ৮ বা ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সম্ভাবনাময় বলা বা তা বাসের অনুপযুক্ত হয়ে যাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করাটা নেহাত অযৌক্তিক। তবে এই লেখকের সঙ্গে উল্লেখিত গবেষণা প্রবন্ধের প্রধান লেখক কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইকেল স্টেকলারের যোগাযোগ হলে তিনি মত প্রকাশ করেন যে দেশের সংবাদমাধ্যমসমূহে বিষয়টি অতিরঞ্জিতভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা কখনো একচোখা হতে পারে না। একজন বিজ্ঞানী তখনই প্রজ্ঞার পরিচয় দেন যখন তিনি ভিন্নমতকে আস্থায় নিয়ে মতবিনিময় করে থাকেন। তাই আগামী দিনে এ বিষয়ে পক্ষ-বিপক্ষ বিজ্ঞানীদের মতবিনিময়ের অবকাশ রয়েছে। আর গবেষণালব্ধ জ্ঞানের পরিপক্বতা সেটির বিশ্বাসযোগ্যতা বা গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করে। পৃথিবীর অনেক স্থানেই পরিপক্ব গবেষণা বৈজ্ঞানিক তথ্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। উদাহরণস্বরূপ ভূবিজ্ঞানীদের কাছে ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান্ড এনড্রেস ফল্টটি তীব্র ভূমিকম্পের উৎসের অন্যতম প্রধান স্থান হিসেবে খুবই সুপরিচিত। ভূবিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি কেবল সময়ের ব্যাপার যে ক্যালিফোর্নিয়ায় বিরাট মাত্রার ভূমিকম্প হবে, যা নাকি একাধিক শহরকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এ ফল্টটির ওপর এতটাই গবেষণা ও জরিপকাজ হয়েছে যে এটির অস্তিত্ব বা প্রকৃতি নিয়ে কেউ প্রশ্ন করেন না। এই ফল্টটি ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান এবং দুটি প্লেটের সংযোগকারী রেখা হিসেবে তাদের বিপরীতমুখী গতিকে ধারণ করে। আর রাডারসংবলিত উপগ্রহ এবং জিপিএস প্রযুক্তির মাধ্যমে দীর্ঘ বছরের গবেষণা থেকে এই ফল্ট রেখার গতি, দিক বা নানা প্রকৃতি বিজ্ঞানীদের জানা হয়েছে। এভাবেই তাঁরা বলেন যে ৮ মাত্রার বিরাট ভূমিকম্প কোনো না কোনো সময় হবেই। অথচ দীর্ঘদিন ধরে দিয়ে রাখা এই ভবিষ্যদ্বাণীর পরও বিশ্বের অন্যতম প্রধান প্রযুক্তি কম্পিউটার শিল্পের স্বর্গরাজ্য বলে পরিচিত সিলিকন ভ্যালি গড়ে উঠেছে ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের মাঝবরাবর।
একইভাবে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরের পশ্চিমে সাগরের ভেতর দিয়ে অপর একটি ভয়ংকর প্লেট বাউন্ডারি বিদ্যমান এবং বিজ্ঞানীদের মতে, এটিও আমেরিকা মহাদেশের অন্যতম বৃহৎ ভূমিকম্পের প্রমাণিত উৎস। এটিও ভূবিজ্ঞানীদের দীর্ঘদিনের গবেষণা ও জরিপে ব্যাপকভাবে পরীক্ষিত। তাঁরা বলছেন, ভ্যাঙ্কুভার শহর ও আশপাশ অঞ্চল ভবিষ্যতে কোনো একসময় তীব্র আকারের ভূমিকম্পের শিকার হবে, যার মাত্রা ৮ বা ততোধিক হতে পারে। কবে হবে তার কোনো ঠিক নেই অর্থাৎ তা আগামীকাল থেকে ৫০০ বছরের মধ্যের যেকোনো সময়। কিন্তু তাতে কী এসে যায়, কানাডার সবচেয়ে সুন্দর ও বাসযোগ্য শহর হিসেবে ভ্যাঙ্কুভার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে অনেক দিন। কয়েক বছর আগে শহরটি বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর ও বাসযোগ্য শহরের তালিকায় এক নম্বর স্থান অধিকার করে। নেপালের ভূমিকম্পপ্রবণতা বহুলভাবে পরিচিত। গত বছর সেখানে ৭.৮ মাত্রার যে ভূমিকম্প হয়েছে, তা ব্যাপক প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞ ঘটায়। হিমালয় পাহাড় বরাবর কতগুলো মেগা ফল্ট বহুদিন ধরে ভূবিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে রয়েছে এবং এই ফল্ট যেকোনো একসময় ভূমিকম্প দেবে, তা আগেই জানা ছিল।
বাংলাদেশ তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলের কাছে অবস্থিত। তাই এটি তুলনামূলকভাবে সাধারণ কোনো স্থান থেকে অধিকতর ভূমিকম্পপ্রবণ। বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি বা ভূমিকম্পবিজ্ঞান এখনো তুলনামূলকভাবে অপরিপক্ব। বাংলাদেশের ভূমিকম্প নিয়ে সুনির্দিষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী করার পূর্বশর্ত হিসেবে আরও অনেক জরিপ ও গবেষণার প্রয়োজন। ভূমিকম্প নিয়ে ওপরে উল্লেখিত গবেষণাকাজের বিশ্লেষণে বহু অনিশ্চয়তা রয়েছে। যেমন গবেষক দল তাদের প্রকাশিত প্রবন্ধে যে মেগা থ্রাস্ট ফল্ট দেখিয়েছেন তার অবস্থান অতিমাত্রায় জল্পনাভিত্তিক। কেনই বা সে ফল্টটি ঠিক ঢাকা শহরের নিচ দিয়ে যাবে, তার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। আবার সে ফল্টটির কোনো ভূতাত্ত্বিক চিহ্নও কেন নেই, তার ব্যাখ্যা নেই। তাই এখানে অতি তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ভূতাত্ত্বিক উপাদানসমূহের অবস্থান নিয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। আবার ভূমিকম্প হওয়ার ফলে লিকুইফ্যাকশন হয়ে বাড়ি রাস্তা লোকজন সমূলে তলিয়ে যাওয়ার ঘোষণাটিও অতিরঞ্জিত। ভূবিজ্ঞানীরা বলছেন, ঢাকা শহরের লাল মাটির এলাকাসমূহ যথেষ্ট সুদৃঢ় এবং তাতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে নিচু ভূমি ভরাট করে যেসব এলাকায় বাড়ি-ঘর তৈরি হয়েছে সেসব বড় ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
পরিশেষে বলা যায় যে দেশি ও বিদেশি সংবাদমাধ্যমসমূহে ঢাকা শহর অঞ্চলে ৮ বা ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা নিয়ে যে প্রচার হয়েছে, তা নেহাত অপরিপক্বতার সাক্ষ্য বহন করে। যে সূত্রমতে এই সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে সেই গবেষণা প্রবন্ধেই এ ধরনের এসটিমেটকে বহুলভাবে অনিশ্চিত উপাদানের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে বলে উল্লেখ আছে।
কোনো কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এহেন তীব্র ভূমিকম্পের ভবিষ্যদ্বাণী প্রচারটি বাংলাদেশকে নেতিবাচকভাবে বিশ্ববাজারে উপস্থাপন করার ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখার প্রয়াস পান। তবে একজন বিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকে তা সম্ভবত অমূলক। গবেষণা প্রবন্ধটির প্রধান লেখক অধ্যাপক মাইকেল স্টেকলার এই নিবন্ধকারকে জানান যে মানুষের মধ্যে ভীতি সঞ্চালন করার কোনো উদ্দেশ্য বা ইচ্ছা তাঁর নেই। তিনি কখনো বলেননি যে বাংলাদেশে ভূমিকম্পের বিপদ আসন্ন। তাদের কাছে এমন কোনো উপাত্ত নেই যা দিয়ে এখানে ভূমিকম্প হওয়ার সময় নিয়ে মন্তব্য করা যায়। তবে তিনি আশা করেন সে সময়টি সুদূর, যাতে করে বাংলাদেশ ভঙ্গুর স্থাপনাসমূহ শক্ত করে তোলার যথেষ্ট সময় পায়।
ভূমিকম্পের তীব্রতা নিয়ে বিতর্কে না গিয়ে যে কথাটি দেশের সব ভূবিজ্ঞানী মনে করে থাকেন তা হলো বাংলাদেশের ভঙ্গুর প্রকৃতির অবকাঠামোসমূহকে অপেক্ষাকৃত সুদৃঢ় করার প্রয়োজনীয়তা আবশ্যক।
ড. বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।