শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক

Author Topic: শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক  (Read 1236 times)

Offline Samsul Alam

  • Full Member
  • ***
  • Posts: 160
  • The works that I left will remember me...
    • View Profile
    • Google Site

বাংলার মুক্তির সশস্ত্র সংগ্রামের প্রথম শহীদ - সার্জেন্ট জহুরুল হক। নোয়াখালির সুধারাম থেকে জগন্নাথ কলেজ, বেঙ্গল লিবারেশন আর্মি থেকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা- প্রতিটা ক্ষেত্রে তিনি উদ্ভাসিত আপন আলোকে। মুক্তি সংগ্রামের আপোষহীন এই জাতীয় বীরের জীবনের পুরোটা সংক্ষেপে তুলে ধরার প্রয়াস।
জহুরুল হক ছিলেন তার বাবা-মা'র তিন সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। আমরা শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক নামে জানলেও তাঁর পারিবারিক নাম ছিল 'সেরাজ জহুরুল হক', ডাকনাম ''রুনু''! ইংলিশ বানান লিখতেন Zahoorul Haq, আমরা লিখি Zahurul huq/Haque!
জহুরুল হক ছিলেন জন্মশিল্পী। দারুণ ছবি আঁকতেন। তার একটি ছবি 'ভাঙাচোরা একটা সুর্যকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক যুবক' যেন ইদানীংকালের 'গ্রাফিতি সুবোধ তুই পালিয়ে যা' এর থিম। তাদের বাসা ছিল ২৫ এলিফেন্ট রোডে, বাসার নাম চিত্রা।
জগন্নাথ কলেজে পড়া অবস্থায়ই যোগ দেন বিমান বাহিনীতে, ট্রেইনিং অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন আগরতলা মামলায় গ্রেফতার হওয়ার আগে পর্যন্ত।
সেনাবাহিনীতে কর্মরত কিছু বাঙালি সৈনিক গোপনে গঠন করেছিল বেঙ্গল লিবারেশন আর্মি। লক্ষ্য ছিল পূর্ব-পাকিস্তানের সব সেনানিবাসে একযোগে বিদ্রোহ করে স্বাধীনতা আনয়ন। জহুরুল হক শুরু থেকে জড়িত ছিলেন এর সাথে। নৌবাহিনীর ল্যাফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন বিপ্লবী এই সংস্থার প্রধান। এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও এর সাথে জড়িত হন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কন্যা আখতার সোলায়মান এর করাচীর বাসায় নিয়মিত বঙ্গবন্ধু ও সেনাকর্তাদের মিটিং হত।
১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি সরকারি (আইয়ুব আমল) প্রেসনোটে জানানো হয় সরকার পাকিস্তানের স্বার্থবিরোধী একটি চক্রান্ত ধরে ফেলেছে। সারা পাকিস্তানে প্রায় ১৫০০ জন বাঙালিকে গ্রেফতার করা হয়। ১৮ই জানুয়ারি এই অভিযোগেই গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। সর্বমোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়, এর একজন সার্জেন্ট জহুরুল।
মামলার নাম দেয়া হয় ''রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য'', তবে ভারতীয় ফ্লেভার এড করার নিমিত্তে সরকারি নির্দেশে এটিকে ''আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা'' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল এদের ভারতীয় চর আখ্যায়িত করে শাস্তি দেয়া, নির্বাচনে (৭০-এর) প্রভাব ফেলা।
বিচার চলাকালীন সার্জেন্ট জহুরুল বাংলা ভাষার সরলীকরণ ও এ সংক্রান্ত একটি অভিধান রচনার কাজ করেছিলেন।
তিনি ছাড়া পেলে কী করবেন, সহবন্দীর এরকম প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, 'আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌছার পথে কিছুটা বাধা পেয়েছি, সুযোগ পেলে আবার লক্ষ্যস্থলে পৌঁছার চেষ্টা করব।''
১৫ই ফেব্রুয়ারি ভোর পাঁচটার দিকে তাকে গুলি করা হয়, সেনা হেফাযতে থাকা অবস্থায়। তাকে গুলি করেছিল পাঞ্জাবী হাবিলদার মঞ্জুর শাহ। জহুরুল হকের সাথে সেদিন আহত হয়েছিলেন ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক। জহুরুল হককে গুলি করার পর বেয়নেট চার্জ করা হয়, পেটানো হয়। তার দোষ ছিল তিনি একটা পথশিশুকে পেটানোর প্রতিবাদ করেছিলেন।
আঘাতে জহুরুল হকের কলার বোন ভেঙে যায়। অগ্নাশয় ছিড়ে যায়। তার রক্তের গ্রুপ ছিল ও-নেগেটিভ, দুষ্প্রাপ্য।
ঘন্টা দুয়েক পরে তাকে সিএমএইচে নেয়া হলেও অপারেশন করানো হয়নি। রাত সোয়া নয়টায় তার মৃত্যু হয়।
দুপুরে রেডিও পাকিস্তানে জানানো হয় তিনি পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। অথচ তার বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ তারা প্রমাণ করতে পারেনি, ১৯ জন সাক্ষীর মধ্যে কেউ তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়নি। কয়েকদিনের মধ্যে তার মুক্তির সম্ভাবনা ছিল। আর তার বুকে গুলি করা হয়েছিল, পিঠে নয়।
শহীদ সার্জেন্ট এর মৃতদেহ তার ভাইয়ের হাতে তুলে দেন পাকসেনাকর্তা রাও ফরমান আলি খান। জহুরুল হকের লাশ নিয়ে শোক মিছিল হয় আওয়ামীলীগ এর নেতৃত্বে। সেসময়ের আওয়ামীলীগ প্রধান আমেনা বেগমের নেতৃত্বে শোক মিছিলে সাদা কাপড়ের ব্যানারে লেখা ছিল 'শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেবো না।'
শোক মিছিল এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট, শহীদ মিনার, নাজিম উদ্দিন রোড, চকবাজার, মোগলটুলি হয়ে সদরঘাট ও জিন্নাহ এভিনিউ(বঙ্গবন্ধু এভিনিউ) হয়ে স্টেডিয়ামে যায়।
জানাজা শেষে সেক্রেটারিয়েট এর সামনে দিয়ে আসার সময় উত্তেজিত জনতার দিকে পুলিশ গুলি ছোড়ে। ঘটনাস্থলেই ইসহাক খান নামে একজন মারা যান। বিক্ষুব্ধ জনতা পূর্তমন্ত্রী, মুসলীম লীগ সভাপতি, তথ্যমন্ত্রীর বাসভবন ও দুটো দমকল গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
সার্জেন্ট জহুরুলের অন্তিম শয্যা হয় আজিমপুর করবস্থানে।
সেদিনই কারফিউ জারি করে আইয়ুব, এছাড়া ১৪৪ ধারা জারি করা হয় বড় শহরগুলোতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট আহবান করে, বটতলায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে।
১৫ই ফেব্রুয়ারির সেই নির্মম হত্যাকান্ডই গণ-অভ্যুত্থানের আগুনে আহুতি দেয়। মাওলানা ভাসানী জনসভা করেন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাওয়া হয়। ১৮ই ফেব্রুয়ারি শহীদ হন রাবির প্রোক্টর ড. শামসুজ্জোহা। তীব্র আন্দোলনের মুখে আইয়ুব শাহী পদত্যাগের ঘোষণা দেয় ২১শে ফেব্রুয়ারি। ২২ ফেব্রুয়ারি নি:শর্ত মুক্তি দেয়া হয় সব আসামীকে, আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করা হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি যখন শেখ মুজিব ''বঙ্গবন্ধু''তে রুপান্তরিত হন, সেদিন ইত্তেফাকের শিরোনাম ছিল ''ফিরিলো না শুধু একজন''- এই একজন শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক, বাংলার এক সুর্যসন্তান।
৭০-এ বঙ্গবন্ধু জহুরুল স্মরণ দিবসে বলেছিলেন, ''জহরুল মরে নাই, মরণেরে শুধু করিয়াছে উপহাস।''
১৫ই ফেব্রুয়ারি পালনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল কেন্দ্রীক একটি ছাত্রসেনাবাহিনী গঠন করা হয়, নাম দেয়া হয় ''১৫ই ফেব্রুয়ারি বাহিনী' পরে 'জহুর-১৫'। পরে যে বাহিনী রুপ নিয়েছিল ''জয় বাংলা'' বাহিনীতে, যারাই প্রথম স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে মাস্টারপ্ল্যান করেছিল দেশমুক্তির। নেতৃত্বে ছিল ছাত্রলীগ।
জহুরের শাহাদতের পরই ইকবাল হলের নাম বদলে জহুরুল হক হল করার দাবী পেশ করে ছাত্রলীগ ও ডাকসুর সেসময়ের নেতারা। ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদ বলেন, ''সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যু, তার শাহাদাত, তার রক্ত আমাদের আন্দোলনকে গতিশীল করলো, সমস্ত মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। সরকার সান্ধ্য আইনইন দিল। আমরা আইন ভেঙে মিছিল করলাম। সেই এলিফ্যান্ট রোডের বাসা চিত্রায় আমরা ইকবাল হলের হাজারো ছাত্র জমায়েত হলাম। সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষে আমি ঘোষণা করলাম আজ থেকে ইকবাল হলের নাম পরিবর্তন করে জহুরুল হকের নামে রাখা হবে। সেই থেকেই ইকবাল হল হয়ে গেল জহুরুল হক হল।''
অফিসিয়ালি এই নাম কার্যকর হয় ১৯৭২ সালে। তখন নাম ছিল 'জহুরুল হক হল'। ২০১১ সালে প্রধান ফটকে জহুরুল হকের মুরাল স্থাপন করে এর নাম পরিবর্তন করা হয় ''শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল''।
সেনানিবাসে যেখানে বঙ্গবন্ধু, জহুরুল হক ও অন্যান্যদের বিচার হয় সেখানে জাদুঘর স্থাপন করা হয়েছে বিজয় কেতন মানে। জহুরুল হক যে হ্যান্ড গ্রেনেড দিয়ে বিপ্লবীদের গোপনে প্রশিক্ষণ দিতেন, সেটি এখানে রাখা হয়েছে ''রক্তঋণ'' স্মারক হিসেবে।
২০১১ সালে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের আয়োজনে আগরতলা মামলার অভিযুক্ত ও তাদের পরিবারকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। প্রধান ভূমিকা রাখেন হল প্রাধ্যক্ষ ড. আবু মো: দেলোয়ার হোসেন। সার্জেন্ট জহুরলসহ অভিযুক্ত ৩৫ জনকে ''জাতীয় বীর'' ঘোষণা করা হয় এবং রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবী ওঠে।
জহুরুলকে নিয়ে পল্লীকবি জসীম উদ্দিন লেখেন,
''মতিউর গেছে, আসাদ গিয়াছে
জহিরুল গেছে আর,
রক্ত জবায় সাজায়েছে তারা
চরণ যে দেশ মা-র।''
জহুরুল ১ম স্মরণ দিবসের স্লোগান ছিল,
''জয় ১৫ই ফেব্রুয়ারি, জয় জহুর, জয় বাংলা''।
- সংগৃহিত
Samsul Alam (710001796)
Sr. Lecturer (MIS)
Department of Business Administration
Faculty of Business and Entrepreneurship
Daffodil International University