রেনু,
আমার ভালোবাসা নিও। ঈদের পরে আমার সাথে দেখা করতে এসেছো ছেলেমেয়েদের নিয়ে আস নাই। কারণ তুমি ঈদ করো নাই। ছেলেমেয়েরাও করে নাই। খুবই অন্যায় করেছো। ছেলেমেয়েরা ঈদে একটু আনন্দ করতে চায়। কারণ সকলেই করে। তুমি বুঝতে পারো ওরা কত দুঃখ পেয়েছে। আব্বা ও মা শুনলে খুবই রাগ করবেন। আগামী দেখার সময় ওদের সকলকে নিয়ে আসিও। কেন যে চিন্তা করো বুঝি না। আমার যে কবে মুক্তি হবে তার কোনো ঠিক নাই। তোমার একমাত্র কাজ হবে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখানো। টাকার দরকার হলে আব্বাকে লেখিও, কিছু কিছু মাসে মাসে দিতে পারবেন। হাছিনাকে মন দিয়ে পড়তে বলিও। কামালের স্বাস্থ্য মোটেই ভালো হচ্ছে না। ওকে নিয়মমতো খেতে বলিও। জামাল যেন মন দিয়ে পড়ে আর ছবি আঁকে। এবার একটা ছবি এঁকে যেন নিয়ে আসে, আমি দেখব। রেহানা খুব দুষ্ট, ওকে কিছুদিন পর স্কুলে দিয়ে দিও জামালের সাথে। যদি সময় পাও নিজেও একটু লেখাপড়া করিও। একাকী থাকাতে একটু কষ্ট প্রথম হতো। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে, কোন চিন্তা নাই। বসে বসে বই পড়ি। তোমার শরীরের প্রতি যত্ন নিও।
ইতি
তোমার মুজিব
ঢাকা জেল
ঢাকা কারাগারে বসে স্ত্রী বেগম ফজিলাতুননেসাকে এই চিঠি লিখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এমন অসংখ্য চিঠিসংবলিত বোর্ড প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছে পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে। কারাগারটি এখন বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর। আজ বুধবার থেকে আগামী শনিবার পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত ১০০ টাকা টিকিটে বঙ্গবন্ধু কারাস্মৃতি জাদুঘর দেখতে পারবে দর্শনার্থীরা। তারা বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে নিয়ে আলোকচিত্র প্রদর্শনী ও কারাস্মৃতি জাদুঘর দেখতে পাবে। তবে একজন দর্শনার্থী দুই ঘণ্টার বেশি কারাগারের ভেতর থাকতে পারবে না বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
গতকাল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকে কিছূদূর যেতেই যে শেডগুলোতে বন্দিরা বিভিন্ন জিনিস বানাতেন সেগুলোতেই করা হয়েছে আলোকচিত্র প্রদর্শনী। প্রদর্শনীতে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর যুবক বয়স থেকে মৃত্যুর আগের ছবি পর্যন্ত। এ ছাড়া জাতীয় চার নেতার এক্সক্লুসিভ ছবি জায়গা পেয়েছে প্রদর্শনীতে।
গতকাল বিকেলে প্রদর্শনী উদ্বোধন উপলক্ষে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের যমুনা সেলের সামনে আয়োজন করা হয়েছিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের। উদ্বোধন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ সময় উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রসচিব। উপস্থিত ছিলেন জাতীয় চার নেতার একজন এ এইচ এম কামরুজ্জামানের ছেলে রাজশাহীর সাবেক মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন।
বিকেলে কারাগারে ঢুকে খায়রুজ্জামান লিটনকে জাতীয় চার নেতার স্মৃতি জাদুঘরের সামনে যেতে দেখা যায়। তাঁর বাবার ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। তখন তাঁকে আবেগপ্রবণ দেখা যায়। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছবি তোলার জন্য ব্যস্ত হয় অনেকে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কারাগারে ঢুকে প্রথমেই বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে নিয়ে আলোকচিত্র প্রদর্শনী ঘুরে দেখেন। এরপর তিনি মঞ্চে যান। সন্ধ্যার দিকে কারাগারে ঢোকেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। গতকালের এ অনুষ্ঠানটিতে পুরান ঢাকার সংসদ সদস্য হাজি সেলিম উপস্থিত ছিলেন। এ সময় পুরান ঢাকার অনেক বাসিন্দাকেও দেখা যায় কারাগারে। দর্শকদের সারিতে কয়েকজন বিদেশিকেও দেখা যায়। তারাও মোবাইল ফোনে ছবি ধারণ করেন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক এই স্থানের।
অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণা করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘১৯৫৫ সালে ছাত্র থাকাকালীন আমাদের গ্রেপ্তার করা হয়। আমি ৪২ দিন জেলে ছিলাম। প্রথমে আমাদের লালবাগ থানায় নিয়ে রাখা হয়েছিল। বিকেলের দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসা হয়। আমাদের রাখা হয় মেন্টাল ওয়ার্ডে। প্রথম ১১ দিন আমাদের সেখানে রাখা হয়। ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ৫০০ জন ছাত্রকে ধরে আনা হয় কারাগারে। তখন কারা কর্তৃপক্ষ আমাদের সরিয়ে তাদের সঙ্গে থাকতে বলে। আমরা রাজি হই।’ তিনি আরো বলেন, ‘জেলজীবন খারাপ লাগত। সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগত বিকেলে বাইরে বের না হতে পারাটা। এক সময় আমরা বিকেলে সেল থেকে বেরিয়ে নিউ মার্কেট যাচ্ছি এমন ভাব করে কারাগারের ভেতরে হাঁটাহাঁটি করতাম।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘একবার আমি কারাগারে এসে সেই সেলটি দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এসে দেখি সেটি নেই। জায়গাটিতে বড় দালান উঠেছে।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘এই কারাগারটি ২২৮ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী। প্রধানমন্ত্রী আমাদের কাছে প্রায়ই স্মৃতি তুলে ধরে বলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য কারাগারটিতে আসতেন। এবার কারাগারটি জনগণের সামনে সীমিত আকারে উন্মুক্ত করা হচ্ছে। এই জায়গাটিতে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা স্মৃতি জাদুঘর থাকছে। পুরান ঢাকার মানুষের জন্য বিনোদনকেন্দ্র করা হবে।’
আইজি প্রিজন্স সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন বলেন, ‘এই জায়গায় কী করতে হবে সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনেক স্মৃতি রয়েছে এখানে। তিনি কারাগারটি ঘুরে দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন।’
রাজশাহীর সাবেক মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘আমরা এতিম হয়েছি সেটা বড় কথা নয়। তারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি।’
পুরান ঢাকার বাসিন্দা জামাল উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু কারাস্মৃতি জাদুঘর’ দেখলাম। তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেখে অন্য রকম লেগেছে। জাদুঘরে রাখা হয়েছে বহু বছর আগে তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র। সেখানে যেন বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পাচ্ছিলাম।’ তিনি আরো বলেন, ‘জাতীয় চার নেতার স্মৃতি জাদুঘরও দেখলাম। রডের মধ্যে গুলির চিহ্ন দেখে মনে হচ্ছিল গুলিগুলো যেন রডে নয় আমার অন্তরে বিদ্ধ হচ্ছে।’ একই ধরনের কথা বললেন পুরান ঢাকা থেকে আসা আরো কজন।
প্রথমবারের মতো গতকাল সাংবাদিক ও বাইরের কিছু লোক পুরান ঢাকার এই কারাগারটির ভেতরে ঢুকে দুটি জাদুঘর দেখার সুযোগ পেলেন। তা দেখতে পেয়ে তাঁরা বেশ আনন্দিত। তাঁদের বঙ্গবন্ধুর ছবি ও বঙ্গবন্ধুর হাতে লেখা চিঠি পড়তে দেখা যায়। কয়েকটি চিঠিতে বঙ্গবন্ধু রেনুকে উদ্দেশ করে চিঠি লিখেছেন—
এক সময় দেওয়ানি সেল নামে পরিচিত ছিল সেলটির। সেটিতেই রাখা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বর্তমানে যেটিকে জাদুঘর করা হয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সেমি পাকা একটি ঘর। ওপরে টিন। সামনে কয়েকটি গাছ ও ফুল বাগান। এই জাদুঘরটির প্রবেশ পথে একটি ফলকে লেখা রয়েছে ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারা স্মৃতি জাদুঘর’। সেই ঘরটির ঠিক সামনে বঙ্গবন্ধু নিজের হাতে লাগিয়েছিলেন একটি কামিনীগাছ। যে গাছটি এখন অনেক বড় হয়েছে। কারা কর্তৃপক্ষ সেই গাছটিকে সযতনে রেখেছে। রয়েছে পাখি রাখার একটি খাঁচাও। যে কক্ষে তিনি গোসল করতেন সে কক্ষটিও সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত চেয়ার, টেবিল, খাট, পাতিলসহ নানা জিনিস কাচ দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে, যাতে কেউ স্পর্শ করতে না পারে। সেখানে রয়েছে চায়ের কাপ, কেটলি, রান্নার হাঁড়ি-পাতিলও।