স্যামসাং: নুডলস বিক্রেতা থেকে বিশ্বের শীর্ষ ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী নির্মাতা প্রতিষ

Author Topic: স্যামসাং: নুডলস বিক্রেতা থেকে বিশ্বের শীর্ষ ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী নির্মাতা প্রতিষ  (Read 1764 times)

Offline 710001113

  • Sr. Member
  • ****
  • Posts: 493
    • View Profile
By Tawfiqur Rahman

    “ছোট ছোট জিনিস একত্র হয়েই বড় কিছুর জন্ম দেয়” – ভিনসেন্ট ভ্যান গখ

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি বড় জিনিসের শুরু হয়েছে কোনো না কোনো ক্ষুদ্র জিনিস থেকে। কোনো একটি ক্ষুদ্র আইডিয়া, সেই সাথে ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা- এ দুয়ের মাধ্যমেই কিন্তু জন্ম হয় বড় কিছুর।

যেমন, ১৯৯০ সালে স্টানফোর্ডের দুই ছাত্র তাদের সমস্ত কিছু বিনিয়োগ করে একটি নতুন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন। তখন তাদের একমাত্র চিন্তা ছিল কিভাবে সবকিছু মিলিয়ে মোটামুটি ১,৭০০ ডলার নিজেদের পকেটে নিয়ে আসা যায়, যাতে করে তারা তাদের নতুন অফিসের এক মাসের ভাড়া পরিশোধ করতে পারেন। আর তাদের নতুন অফিসটি কোথায় ছিল জানেন? তাদেরই এক বন্ধুর ফাঁকা গ্যারেজে! এখানেই ল্যারি পেইজ আর সের্গেই ব্রিন গড়ে তোলেন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ইন্টারনেট ও সফটওয়্যার কোম্পানি গুগল।

স্যামসাংয়ের প্রতিষ্ঠাতা লি বিয়ং চল; Source: Wikipedia Commons

আর ঠিক এমনভাবেই ১৯৩০ সালে যখন লি বিয়ং চল দক্ষিণ কোরিয়ার ডেইগ শহরে প্রথম স্যামসাং নামের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানটি শুরু করেন তখন তার উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় বাজারে ছোটখাট মুদি ব্যবসা করা আর সেই সাথে স্থানীয় নানা পণ্য বাইরে রপ্তানি করা। বিভিন্ন ফ্লাগশিপ পণ্য? না, বর্তমানে স্যামসাং যেসব পণ্য তৈরি করে অতীতে কিন্তু তার ধারে কাছেও ছিল না তারা। আপনি হয়তো জানেন না, সেসময় স্যামসাংয়ের শুরু হয় নুডলস তৈরির মাধ্যমে!

স্যামসাংয়ের লোগোর বিবর্তন; Source: news.samsung.com

স্যামসাংয়ের প্রতিষ্ঠাতা লির জন্ম হয় এক ধনী পরিবারে। তাকে যখন টোকিওর ওয়াসেডা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয় তখন তিনি তার গ্রাজুয়েশন শেষ না করেই আবার বাসায় ফিরে আসেন। এরপর জড়িয়ে পড়েন নানা পারিবারিক ব্যবসার সাথে। সেসময় তিনি মাত্র ৪০ জন কর্মচারী, একটি ছোট গুদাম ঘর ও কয়েকটি ট্রাক নিয়ে গড়ে তোলেন একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, যার নাম দেন ‘স্যামসাং’। স্যামসাং একটি কোরিয়ান হানজা শব্দ। এখানে ‘স্যাম’ অর্থ থ্রি বা তিন এবং ‘সাং’ অর্থ স্টার বা তারা। অর্থাৎ দুয়ে মিলে এর অর্থ দাঁড়ায় ‘থ্রি স্টার’ বা তিন তারা। কোরিয়ান ভাষার ‘স্যাম’ শব্দটি দিয়ে বিশাল ও শক্তিশালী বুঝানো হয়। স্যামসাং প্রতিষ্ঠার সময় লির হাতে ছিল মাত্র ৩০,০০০ ওন (প্রায় ২৭ ডলার) আর ব্যবসার মালের মধ্যে ছিল কেবল ময়দা ও শুকনা সীফুড।

এগুলো খুব সহজেই বহন করা যেত এবং অনেক দিন ভালো থাকতো। ফলে ব্যবসার জন্য এগুলো ছিল সুবিধাজনক। ধীরে ধীরে ব্যবসা এগোতে শুরু করলো। লি তখন তার সমস্ত সঞ্চয় একেবারে বিনিয়োগ করে বিশাল পরিমাণে পণ্য কিনলেন। আর সেই সাথে দিলেন আকর্ষণীয় ছাড়। ফলে মানুষ তার পণ্যের প্রতি ঝুকলো। কয়েক দিনের মধ্যেই দেখা গেলো অসংখ্য ট্রাক নানা রকম মুদিদ্রব্য নিয়ে চীনের উদ্দেশ্য যাতায়াত করছে। আর এভাবেই শুরু হলো স্যামসাংয়ের এগিয়ে চলা।

স্যামসাংয়ের প্রস্তুতকৃত নুডলসের প্যাকেট; Source: Wikipedia Commons

স্থানীয় নানা পণ্যের পাশাপাশি এসময় স্যামসাং তাদের নিজস্ব গৃহজাত নুডলস বিক্রি করা শুরু করলো। নুডলসগুলোর প্যাকেটের গায়ে থাকতো তিনটি তারাযুক্ত প্রতীক যা ছিল তৎকালীন কোম্পানির লোগো।

এরপর ১৯৪৫ সালের শুরু হওয়া যুদ্ধ ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার ফলে স্যামসাংকে নানা দুর্ভোগ পোহাতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোরিয়ায় জাপানী ঔপনিবেশিক শাসনের পতন ঘটে। এসময় বিচক্ষণ ও দূরদর্শী লি তার কোম্পানির সদরদপ্তর সরিয়ে সিউলে নিয়ে আসেন। নানা পদের নানা দরকারি মানুষের সাথে লির ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ফলে নানা বিপদ ও আসন্ন কোরিয়ান যুদ্ধের মধ্য দিয়েও তিনি স্যামসাংকে এগিয়ে নিয়ে যান। এসময় সিউলে আক্রমণ হলে তিনি আবার তার কোম্পানির সদরদপ্তর সিউল থেকে উত্তর কোরিয়াতে নিয়ে যান। সেইসাথে তিনি বুসান শহরে একটি চিনির কল স্থাপন করেন।

১৯৫৪ সালের দিকে লি চিমসাং ডং এ একটি উলের মিল স্থাপন করেন। সেসময় এটি ছিল দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় উলের মিল। ১৯৪৭ সালে হিওসাং গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চো হং যাই এবং লি মিলে ‘স্যামসাং মুলসান গংসা’ নামের একটি যৌথ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। ধীরে ধীরে এটি বড় হতে থাকে এবং ১৯৫১ সালে তা ‘স্যামসাং সি এন্ড টি কর্পোরেশন’ নামকরণ করা হয়। পূর্বের নানা পণ্যের পাশাপাশি লি ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ এর মধ্যে আবাসন, জীবনবীমা, টেক্সটাইল প্রভৃতি ব্যবসা শুরু করেন। এভাবে কয়েক বছরের মধ্যেই যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই লি বিশাল অংকের ব্যাংক ব্যালেন্স জমিয়ে ফেলেন। তবে ব্যাংক ব্যালেন্সের পাশাপাশি তার নামে দুর্নীতির অভিযোগও জমা হতে থাকে।

১৯৩০ সালে ডেইগে অবস্থিত স্যামসাংয়ের সদরদপ্তর; Source: thevintagenews.com

১৯৬১ সালে লি টোকিও থেকে ফিরে এসে নতুন সরকারের সাথে এক লেনদেনের চুক্তি করেন। পুরনো দুর্নাম ও দুর্নীতি বাদ দিয়ে স্যামসাং এসময় নতুন করে আবার সবকিছু শুরু করার পরিকল্পনা করে। লি সরকারের সাথে পরিকল্পনা করে এ সময় কোরিয়ার পাশাপাশি বিশ্ববাজারে তার ব্যবসাকে নতুনভাবে গড়ে তোলার চেষ্টায় লেগে পড়েন। ১৯৬০ এর শেষের দিকে স্যামস্যাং পেট্রোকেমিক্যালের মতো নানা ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসা শুরু করে। শুধু তা-ই নয়, তাদের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যানুসারে ১৯৬৯ এর দিকে তারা সামরিক পোশাক ও বস্ত্র ইথিওপিয়ায় রপ্তানি শুরু করে। আর এই বছরই প্রথমবারের মতো ‘স্যামসাং ইলেক্ট্রনিক’ নামের ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী নির্মাতা প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয় স্যামসাং কর্পোরেশনের সাথে। এই বছরই স্যামসাং সর্বপ্রথম তাদের নিজেদের তৈরি সাদা-কালো টেলিভিশন বাজারে ছাড়ে।

সাদা-কালো টিভি নির্মাণ করছে স্যামসাংয়ের কর্মীরা; Source: news.samsung.com

১৯৭০ সালে ইলেক্ট্রনিক পণ্যের ব্যাপক জনপ্রিয়তার আভাস পেয়ে স্যামসাং ইলেক্ট্রনিক পণ্য নির্মাণের দিকে মনোযোগ দেয়। তারা তাদের সমস্ত কিছু ইলেক্ট্রনিক পণ্য নির্মাণ ও তা নিয়ে গবেষণায় বিনিয়োগ করে। ফলে গড়ে ওঠে স্যামসাং ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস, স্যামসাং কর্নিং, স্যামসাং ইলেক্ট্রো-মেকানিক্স, স্যামসাং সেমিকন্ডাক্টর এবং স্যামসাং টেলিকমিউনিকেশনের মতো নানা শাখা। আর এসব শাখার মাধ্যমেই ধীরে ধীরে স্যামসাং হয়ে ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ইলেক্ট্রনিক ব্রান্ডগুলোর মধ্যে অন্যতম।

স্যামসাংয়ের তৈরি প্রথম কম্পিউটার; Source: Wikipedia Commons

এভাবে নুডলস থেকে শুরু করে স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়া স্যামসাংয়ের ২০১৪ এর হিসাব অনুসারে গোটা পৃথিবীতে মোট ৮০টির বেশি দেশজুড়ে ৪,৮৯,০০০ এর বেশি কর্মচারী রয়েছে। ফোর্বসের রিপোর্ট অনুসারে গত বছর স্যামসাং প্রায় ১৭৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য বিক্রয় করছে। এতে তাদের লাভ হয়েছে প্রায় ১৯ বিলিয়ন ডলার।

একজন কলেজ পালানো নুডলস প্রস্তুতকারক কি কখনো চিন্তা করতে পেরেছিলেন তার প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি একদিন বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান ও জনপ্রিয় ব্রান্ডগুলোর একটিতে পরিণত হয়ে উঠবে! লি হয়তো ভাবেননি, তবে তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন। আর সেই স্বপ্নকে কিভাবে বাস্তবে রূপ দিতে হবে তা জানা ছিলো লিয়ের। লি যদি সেদিন কলেজ না পালিয়ে নিজের স্বপ্নের পিছে না ছুটতেন তবে হয়তো আজ স্যামসাংয়ের যে রূপ আমরা দেখছি তা কোনো দিন দেখতে পেতাম না। তার অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর তা বাস্তবায়নের ক্ষমতাই তার সেই নুডলসের প্যাকেটের গায়ের তিন তারাকে বাড়িয়ে লক্ষ লক্ষ তারা যুক্ত এক গ্যালাক্সির রূপ দিয়েছে, যা কিনা এখন স্যামসাং এর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ।