প্রাচীন ইতিহাস থেকে অনুমিয় সপ্তম শতাব্দীর কোন এক সময় মেসোপটেমীয় জনগোষ্ঠীর একটি বানিজ্যিক জাহাজ বক্ষোপসাগরে ডুবে গিয়েছিল। সেই সময় জাহাজের অধিকাংশ যাত্রীই দৈবক্রমে বেচেঁ গিয়ে বর্তমান মিয়ানমারের রোহিং এলাকায় বসবাস করতে শুরু করেছিল। অথৈই-অতল সাগর থেকে এই অলৌকিক বেচেঁ যাওয়াকে তারা আল্লাহর ‘রহমত’ হিসাবে উল্লেখ করে তা হৃদয়ে শিলমোহর হিসাবে লাগিয়েছিল। সেই থেকে তাদের বেচেঁ যাওয়ার ‘রহতকে’ কেন্দ্র করেই তারা ‘রোহিংগা’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
জাতিগোষ্ঠী হিসাবে রোহিংগারা আরবীয় এবং হযরত মুহাম্মদের অনুসারী বলে জানা যায়। পরবতীতে এই দুগর্ম এলাকায় রোহিংগারা রোহিং প্রনালীতে তাদের বসতী গড়ে তুলেন। ১৪৩০ থেকে ১৭৮৭ সাল পর্যন্ত রোহিং একটি ক্ষুদ্র জনপথ ছিল। কেউ কেউ মনে করেন রোহিং জনপদে বসবাসকারীরাই পরবর্তীতে রুইঙ্গা নামে পরিচিতি লাভ করে। আজ বিশ্ব বিবেকের কাছে রইঙ্গা একটি ‘অসহায়, নির্যাতিত, নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর নাম।
রোহিংগাদের জাতিগত পরিচয় সর্ম্পকে ১৭৯৯ সালে হ্যামিল্টন তার ‘বার্মা সাম্রাজ্য’ বইয়ে আরাকান রাজ্যের অধিবাসীকে ‘রুইঙ্গা নামে উল্লেখ করেছেন। এতে তিনি সুস্পষ্ট উল্লেখ করেছেন ‘এই রুইঙ্গারা মূলতঃ অত্র এলাকার অাদি-বাসীন্দা এবং হযরত মুহাম্মদ (সঃ) অনুসারী। প্রায় হাজার বছর পর মুগল আমলের কোন এক সময় বার্মিরা (মূলতঃ বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী) আরাকান রাজ্য দখল করে নিয়ে জাতিগত দাঙ্গা ফ্যাসাদের সূচনা করে বলে ইতিহাসে উল্লেখ্য রয়েছে।
পরবর্তীতে ভারববর্ষে ব্রিটিশদের আগমন ঘটে। ব্রিটিশরা নানান অযুরে ভারতবর্ষ অধিকার করে নিলে এক সময় আরাকানও তাদের হস্তগত করেন। এক সময়ের মূঘল অনুসারী রুইঙ্গারাই মূলতঃ এই সময়টিতে বিট্রিশ শাসনের বিরুধীতা করেন। অনেকটাই রাগে-ক্ষুব্ভে, রাজনৈতিক শুক্ষ্ণ বিবেচনায় বিট্রিশরা আরাকানে ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠি চিহিৃত করলেও রোহিঙ্গাদেরকে কোন জাতিগোষ্ঠী হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করেন নাই। আরাকান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভোক্ত হলে আরাকান রাজ্যেও অধিকার আদায় প্রশ্নে কিছু উচ্চ পদস্থ বার্মি আরাকান সেনাধক্ষ্যকে ব্রিটিশ পালামের্ন্টে কাউন্সিলিংয়ের সুযোগ দেন। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই বার্মিজরা তাদের আধিপত্য বিস্তার ও পদে পদে রুইঙ্গাদের অপদস্ত করতে থাকে এবং নানা অযুরে রুইঙ্গা উৎখাতের ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে।
অটোম্যান তুর্কী সাম্ররাজ্যের ঘোষনাপত্র অনুয়ায়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রুইঙ্গরা মিত্রশক্তির পক্ষ অবলম্বন করলে জাপানীরা বীরদর্পে আরাকান (মিয়ানমার) আক্রমন করে। আরাকানের এবং এই যুদ্ধে মিত্র বাহিনী পরাজিত হলে অক্ষশক্তির পক্ষে অবস্থান নেওয়া জাপানীরা বীরদর্পে বেছে বেছে ব্যাপক হারের রুইঙ্গাদের হত্যা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির জয় লাভ করলে ১৯৪৭ সালের ৪ জানুয়ারী আরাকান (আধুনিক মিয়ানমার) গণতন্ত্রের স্লোগান নিয়ে স্বাধীনতা লাভ করে।
কাংঙাখীত অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালে রুইঙ্গারা ‘মুজাদি পার্টি’ গঠন করলে জাতিগত বিভাজন সু-স্পষ্ট হয়। তখন গুটি কয়েক সামরিক কর্মকর্তা গণতন্ত্রের স্লোগানকে পদাপনত করে রুইঙ্গাদের বিদেশী হিসাবে চিহৃত করে তাদের উপর নির্যাতন চালাতে থাকে। বিশেষ করে ১৯৬২ সালে ‘নে উইন’ (উগ্র-বৌদ্ধ ধর্ম অনুসারী) নামের এক সামরিক অফিসার আধুনিক মিয়ানমারের ক্ষামতা দখল করে ঘোষনা দিয়ে রুইঙ্গাদের বিদেশী হিসাবে চিহৃত করেন এবং সেই সময় থেকেই রুইঙ্গাদের ভোটাধিকার, ধর্ম, স্বাস্থ্য-সেবা মোট কথা সমুদ্বয় নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ‘শ্রমজীবি হিসাবে ব্যবহার করতে থাকেন। ফলে নিষ্পেষিত রইঙ্গাদের মনে স্বাধীনতার সূর্য্য উকিঁ মারতে থাকে। আর এ থেকেই ক্ষমতাধর হিংস্র পশুর থাবায় আধুনিক মিয়ানমান নামক রাজ্যটি রইঙ্গা লাশে শ্মশানে পরিনত হয়েছে।
ইতিহাস স্বাক্ষীদেয় আদিকাল থেকে আজ অব্দি রুইঙ্গাদের বসতিপূর্ণ এলাকায় ব্যাপক তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে যুগে যুগের শক্তিধর হায়নারা। আজ যা চলছে তা নিত্য কালের ক্ষণ প্রভা। জাগ্রত বিবেকের এ যুগেও সামরিক জ্যান্তাগণ নির্বাচরে হত্যা করছে অসহায় রুইঙ্গাদের। মুহাম্মদের (সঃ) অনুসারী অসহায় এই রুইঙ্গারা কোন প্রকার ধর্মীয় উষ্কানী ছাড়ায় শুধূ মাত্র বেচেঁ থাকার অধিকার আদায়ে ইসলামকে বুকে জড়িয়ে অকাতরে জীবন দিচ্ছে। এক সময়ের মূলজন¯স্রোত আজ নিজ দেশে বিদেশীর খেতাবে পদধস্ত হচ্ছে। বিশ্ব শান্তি সংস্থার চোখে বুজে আছে। নিরুপায়- অন্ধ-কানার মত বকে যাচ্ছে ‘পাশ্ববর্তীদেশকে তাদের বর্ডার খোলে দিতে। এহেন, অবস্থায় অসহায়ের মুক্তি কোথায়? মানবতার ডাক কোথায়?