আমার মা সব পারে...
বিপাশা মতিন
মেয়েটি পড়ালেখায় বেশ ভালো ছিল। ক্লাশে অন্য সবার মতো না। একটু অন্যরকম। পড়ালেখায় তার বিস্তর আগ্রহ। ক্লাশের অন্যসব মেয়ে যখন বিভিন্ন ঘরোয়া আড্ডায় মেতে থাকতো, মেয়েটি তখন বই পড়তো। নানারকম সব বই।
পড়তে সে খুব ভালোবাসে। যে কোন বই। আর এজন্যই প্রতিবার ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরতে তার মামা তার জন্য অনেক বই নিয়ে আসতেন।
সে কি খুশি, সে কি আনন্দ।
১৯৮৪ সাল। আর ক’দিন পরই এস,এস,সি পরীক্ষা। খুব পড়াশোনা চলছে। দম ফেলার সময় নেই একেবারে। এমন সময়ই বাসায় একটি বিয়ের প্রস্তাব আসে। বাবা মাও খুব করে চাচ্ছেন বিয়েটা হয়ে যাক। ছেলে ভালো, বংশ ভালো, তাহলে দেরী করে লাভ কি?
‘কিন্তু বাবা, আমার পড়াশোনা?’
বাবা বলেন, “সে ঠিকই হবে, বিয়ে করলেই কি আর পড়াশোনা করা শেষ নাকিরে?”
হুট করেই বিয়েটা হয়ে গেলো।
কোনরকম পরীক্ষাটা দেয়া হয়েছিলো সেবার।
শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় বার বার ঘুরে ঘুরে দেখছিল টেবিলে ও তাকে রেখে যাওয়া তার সব বইগুলো।
থাকবে তো সব ওরকমই?
বাবা আশ্বাস দিলেন, ‘সবই থাকবে। তুই ভালো থাকিস মা!’
মেয়েটির মন থেকে শঙ্কা যায়না।
শুরু হয় নতুন জীবন। নতুন সব মানুষ, নতুন সংসার। বেশ মানিয়ে নিচ্ছিলো মেয়েটি। ঐ বাড়ির সবার প্রিয় হয়ে উঠছিল সে।
কিন্তু কোথায় যেন কি হচ্ছেনা, কি যেন নেই।
কেউ তো তার পড়াশোনা নিয়ে কোন কথা বলছেনা? তবে যে বাবা বলল, ‘বিয়ের পরও আমি পড়াশোনা করতে পারবো?”
“আরো ক’টা দিন যাক, সবে তো সংসার শুরু করেছ। কিছুটা সামলে নাও। পড়াশোনা? সে পরে দেখা যাবে”
“হুমম তাইতো, সবেতো সংসার শুরু করলাম। আর কটা দিন যাক। তখন বলবো”- লোকের কথা সে বিশ্বাস করলো।
বছর না ঘুরতেই কোল জুড়ে চলে আসে প্রথম সন্তান। এর মাঝে মেয়েটিও ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার সংসার সামলানো নিয়ে। স্বামী তার শিক্ষক তাই বাসায় বইপত্রের কোন অভাব ছিলোনা। সময় সুযোগ পেলেই পড়ে ফেলতো অনেক বই। কখনো গল্পের, কখনো বা সাইন্স ফিকশন, কখনো স্বামীর পড়ানোর বিষয় ‘হিসাবরক্ষণ’। কোন বাধাধরা নিয়মে নয়, মনের ইচ্ছা থেকেই পড়তো সে।
এদিকে দিন যায়, মাস যায়, বছর পেরিয়ে তার কোলে আসে এক এক করে আটটি সন্তান। আট সন্তানের জননী হয়ে ওঠে সেই মেয়েটি। সারাদিন কেটে যায় তাদের সাথে। খুব সুন্দর একটি পরিবার। খুব ভাল যাচ্ছে সবকিছু।
এতোসবের মাঝে বলা হয়ে উঠছেনা তার না বলা সেই কথা।
এক একটি ছেলে-মেয়ে বড় হচ্ছে তার। পড়ালেখার হাতে-খড়িটা হচ্ছে তার হাত দিয়েই।
“অ, অ-তে অজগর, অজগর ঐ আসছে তেড়ে,
আ, আ-তে আম, আমটি আমি খাবো পেড়ে”...
মেয়েটি যখন এক একটি ছেলে-মেয়েকে মানুষ করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো, তাদের স্বপ্নগুলো পূরনের সর্বাত্মক চেষ্টায় যখন সে ভুলে বসছিলো তার নিজের ও একটি স্বপ্ন ছিলো, তার জমানো শখের সেইসব বইগুলোতে তখন পড়ছিলো ধূলো-বালি। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে মাঝে মাঝে ধূলো ঝাড়তো মেয়েটি। কিংবা বিকেলে যখন ছেলে-মেয়েরা বাইরে খেলতে যেতো, অবসরের সেই সময়টুকু মেয়েটি দিতো তার বই পড়াকে।
এইভাবে কেটে যায় আরো কিছু বছর। সবাই ভুলে যায় মেয়েটির সেই স্বপ্নের কথা। মেয়েটিও চুপ থেকে যায়। আট সন্তানের পড়াশোনার খরচ ও ঝামেলা সব মিলিয়ে বলা হয়ে ওঠেনা তার পড়াশোনা করার ইচ্ছের কথা।
থাক না। কি আর হবে পড়াশোনা করে? মেয়েটি সামলে নেয় নিজেকে। মেনে নেয় বাস্তবতা। আবেগ এর দাসত্তের কাছে হার মানে সে।
এদিকে তার এক একটি ছেলে-মেয়ে একেক বছর এনে দিচ্ছিলো তাকে এক একটি সুখবর!
“আম্মু আমি ক্লাশে ফার্স্ট হয়েছি!
আম্মু, আমি এ-প্লাস পেয়েছি!
আম্মু আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছি!”
মেয়েটি একগালে হাসে, কেনো যেন হাসিটা সারা মুখ জুড়ে থাকতোনা। অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন ভাবতো।
কেটে যায় জীবনের আরো কিছু বছর।
২০১১ সাল। মেয়েটি এখন একজন মহিলা। পুরোদস্তুর গৃহিণী। তার সব ছেলেমেয়েগুলো যখন মোটামুটি বড় হয়েছে তখন তারা সবাই মিলে এক গভীর ষড়যন্ত্র করল।
হয়তো, তারা তাদের মায়ের সেই অন্যমনস্ক হওয়ার কারন বুঝতে পেরেছিল।
অথবা, তারা তাদের মায়ের একগালে হাসির মানে বুঝতে পেরেছিল।
কিংবা, তারা মায়ের তাদের মায়ের সেই পূরন না হওয়া স্বপ্নের কথা বুঝতে পেরেছিল।
সে যাই হোক, তারা সবাই মিলে ঠিক করলো, আম্মুকে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দিলে কেমন হয়? শুরু করুক আবার পড়ালেখা?
মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করতেই, এক বাক্যে বলে ফেলল, আচ্ছা!, বলে নিজেই লজ্জা পেল, শুধরে আবার বলল, ‘তোরা যা ভালো মনে করিস’।
যেই ভাবা সেই কাজ।
বাবাকে গিয়ে বলল তাদের ইচ্ছের কথা, মায়ের স্বপ্নের কথা।
তাদের বাবা একবাক্যে রাজি হয়ে গেলেন। এতোদিনে তিনিও বুঝতে পেরেছিলেন, বিরাট ভুল হয়ে গেছে!
আট ছেলে-মেয়ে নিয়ে রওনা হলেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে।
কিন্তু একি! ভর্তির সময় নাকি শেষ। আর কোন ভর্তি চলতি বছরের জন্য গ্রহনযোগ্য হবেনা। তবে কি আরো এক বছর পিছিয়ে যাবে মায়ের স্বপ্ন?
না !
সবাই মিলে রীতিমতো আন্দোলন শুরু করলো, কতৃপক্ষকে নানাভাবে বোঝাতে লাগলো। বিষয়টা অনেক জরুরী, যদি কোনভাবে কিছু করা যায়?
তিনি কি বুঝলেন জানিনা, তবে বললেন, ১০দিনের মধ্যে ব্যবস্থা করতে পারলে তিনি ভর্তি নিবেন।
কিন্তু ১০ দিন? সে তো অনেক কম সময়? এতো কম সময়ে মায়ের সার্টিফিকেট তোলা যাবে কি? কুমিল্লা বোর্ডে গিয়ে দেখা যাক।
সবার যাত্রা এইবার কুমিল্লা, সাথে যোগ দিয়েছে তাদের নানী। মেয়ের ইচ্ছা বলে কথা।
সব ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে সকল কাজ সম্পন্ন করে মায়ের ভর্তি নিশ্চিত করেই বাসায় ফেরে ওরা। ক্লান্তি ভর করলেও অবসর পায়না। কারন দীর্ঘ ২৮ বছর পর তাদের মা আবার পড়াশনা শুরু করেছেন, তাকে পড়াতে হবে, নতুন সিলেবাস বোঝাতে হবে। পরীক্ষার ও বেশিদিন বাকি নেই। এতো কম সমইয়ে এতো কিছু কিভাবে হবে তা ভেবে পায়না সেই আট ভাই-বোন।
কেউ মাকে পড়াচ্ছে ‘অংক’, কেউবা আবার ‘ইংরেজি’, তাদের বাবা নিলেন ‘হিসাবরক্ষণ’ পড়ানোর দায়িত্ব। জীবনের হিসাব মিলাতে সহযোহিতা করছিলো তার পুরো পরিবার। কারন মনে মনে নিজেদের দোষী মনে করছিলো কম বেশি সবাইই।
মেয়েটির জীবন মোড় নেয় সম্পূর্ণ অন্য এক পথে।
যে মেয়েটি জীবনের ২৮টি বছর ব্যস্ত ছিলো তার সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়া নিয়ে, সে এখন তার ভবিষ্যৎ গড়ছে; যে মেয়েটি এতোটা বছর কাটল রান্নাঘরের রান্না নিয়ে, সে মেয়েটি আজ দেশের অর্থনীতি নিয়ে পড়ছে;
এতোদিন মেয়েটি তার সন্তানদের ধমক দিয়েছিলো, “পড়তে বস, ভালো নম্বর না পেলে সোজা গ্রামে খেতের কাজ করতে পাঠিয়ে দিবো” আজ তার সন্তানেরা তাকে ধমক দিচ্ছে, “আম্মু, রান্না করতে হবেনা, যাও পড়তে বসো, পাশ না করলে সোজা গার্মেন্টসে কাজ করতে পাঠিয়ে দিবো”
দেখতে দেখতে পরীক্ষার দিন ও ঘনিয়ে আসলো। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলো হয় প্রতি শুক্রবারে। তবে মেয়েটির ভয়ের চেয়ে আত্নবিশ্বাস ছিল বেশি, ছিলো স্বপ্নপূরনের প্রবল ইচ্ছা। প্রতিটি পরীক্ষার পর বাসায় এসে তার ছেলেমেয়েরা তার প্রশ্ন নিয়ে বসতো। কন্টা ভুল হোল, কেন হোল, কি লিখেছে, কিভাবে লিখেছে।
‘এ যেন ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম’
আট সন্তানের কোলে জন্ম নিলেন এক মা।
২০১২ সাল। মেয়েটির সুনামের সাথে এইচ,এস,সি পাশ করে। আজ তার হাসি একগালে না, সারা মুখে লেগে আছে। আজ মেয়েটির চোখে যে পানি দেখা যাচ্ছে সেটা অতৃপ্তির পানি না। আজ সে সম্পূর্ণা।
গল্পের এই মেয়েটি আর কেউনা, তিনি আমার মা। দীর্ঘ ২৮ বছর সময় সে নিয়েছে তার স্বপ্নের কথা আমাদের বলতে। বিশ্বাস করুন, এরকম আরো অনেক পূরন না হওয়া স্বপ্ন আমাদের চারপাশে আছে। এরকম এক গালে হাসি দেওয়া অনেক মানুষ আমাদের চারপাশে আছে। যারা কিনা সময় ও সুযোগের কারনে তাদের স্বপ্নের কথা কিংবা ইচ্ছের কথা কাউকে বলতে পারছেন না।
আপনি আমি চাইলেই কিন্তু এইসব মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারি।
তাদের একগালে লেগে থাকা হাসি বিস্তৃত করতে পারি সারা মুখে।
চাইলেই এই মানুষগুলোকে সহযোগিতা করতে পারি তাদের ইচ্ছে পূরনে
চাইলেই সব সম্ভব।
আমার মা পেরেছে।
চাইলে আপনিও পারবেন। নিজের স্বপ্নের কথা বলুন। খুঁজে বের করুন এইসব মানুষগুলোকে। চেষ্টা করুন তার স্বপ্নপূরন করতে।
দেখবেন, পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ আপনি।
স্বপ্ন দেখুন, স্বপ্ন দেখান।