চাঁদপুরের নীলকমল ওছমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে শিশু-শিক্ষার্থীদের পিঠের ওপর জুতা পরে হেঁটে যাওয়ার ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। শনিবার একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে দুই সদস্যের উচ্চপর্যায়ের কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও অভিযুক্ত উপজেলা চেয়ারম্যান গা-ঢাকা দেয়ায় তাদের বক্তব্য নিতে পারেননি কমিটির সদস্যরা। তবে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী, অভিভাবক, অন্য শিক্ষক এবং এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে তারা কথা বলেছেন। তদন্ত কমিটি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কমিটির প্রধান অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) মো. আবদুল্লাহ আল হাসান চৌধুরী শনিবার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা ঘটনার সত্যতা পেয়েছি। সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছি। তিন কার্যদিবসের মধ্যেই আমরা প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেব।’ এর বেশি কিছু বলতে তিনি রাজি হননি।
৩০ জানুয়ারি ওই স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার শেষ ইভেন্ট ছিল ছাত্রদের তৈরি ‘মানব পদ্মা সেতু’। স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নূর হোসেন পাটওয়ারী এ প্রতীকী পদ্মা সেতু তথা শিক্ষার্থীদের শরীরের ওপর দিয়ে জুতা পায়ে হেঁটে যান। এ ঘটনার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে নিন্দার ঝড় ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২ ফেব্রুয়ারি একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে এক সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। পরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) উপপরিচালক একেএম মোস্তফা কামালকে কো-অপ্ট করেন। তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। সেই হিসেবে মঙ্গলবার কমিটির মেয়াদ শেষ হবে।
তদন্ত কমিটির একজন সদস্য নামপ্রকাশ না করে যুগান্তরকে বলেন, ‘ছাত্ররা যেমন খুশি তেমন সাজো’র অংশ হিসেবে প্রতীকী মানব পদ্মা সেতু তৈরি করে। সেটা নিঃসন্দেহে হাঁটার জন্য নয়। কিন্তু উপজেলা চেয়ারম্যান অবিবেচকের মতো ছাত্রদের শরীরের ওপর দিয়ে হেঁটে যান। ন্যক্কারজনক হচ্ছে, উপজেলা চেয়ারম্যানের পায়ে তখন জুতা ছিল। এ ঘটনাকে তদন্ত কমিটির সদস্যরা বিপজ্জনক, ভয়ংকর এবং আতংকজনক মনে করছে। ওই সদস্য বলেন, একটি শিশুর কাঁধের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার অনেক বিপদ আছে। আমি ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের মতে, হাঁটার সময়ে কোনো শিশুর মেরুদণ্ড ভেঙে যেতে পারত। কাঁধের হাঁড় নেমে যেতে পারত। এর চেয়ে বড় দুর্ঘটনাও ঘটতে পারত। কোনো সভ্য সমাজ এমন অবিবেচনাপ্রসূত ঘটনা মেনে নিতে পারে না। ছাত্ররা যদি উপজেলা চেয়ারম্যানকে হাঁটার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েও থাকেন, একজন সিনিয়র মানুষ হিসেবে তাতে তার সাড়া দেয়া অন্যায় হয়েছে।
কমিটির ওই সদস্য আরও বলেন, যেসব ছাত্র সেতু হয়েছিল, আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। পাশাপাশি স্কুলের আরও কিছু শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের বক্তব্য নিয়েছি। মামলার বাদীর বক্তব্য নিয়েছি। কিন্তু উপজেলা চেয়ারম্যান ও প্রধান শিক্ষক আত্মগোপন করেছেন। তাদের বক্তব্য পাইনি। তবে ঘটনার ভিডিও রেকর্ড আছে। সবার সামনে ঘটেছে। প্রভাবশালী হওয়ায় উপজেলা চেয়ারম্যানের ব্যাপারে কেউ কেউ মুখ খুলতে রাজি হয়নি। যত মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি, কেউই বলেননি যে কাঁধের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার ঘটনা সঠিক হয়েছে। বরং ঘটনাকে তারা বিপজ্জনক ও ভয়াবহ বলেছেন। এটা সভ্য আচরণ ছিল না। সঠিক ছিল না বলেও কোনো কোনো শিক্ষক উল্লেখ করেছেন। সবমিলিয়ে আমাদের তদন্ত হয়ে গেছে। কমিটির এ সদস্য বলেন, আমরা পুলিশের সঙ্গেও কথা বলেছি। মামলার এজাহার নিয়েছি। তদন্তে তা কাজে লাগবে।
এ তদন্ত কমিটিকে চাঁদপুর ও জামালপুর ছাড়া অন্য কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে কিনা তা খতিয়ে দেখার দায়িত্বও দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার মাহমুদপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের জমিদাতা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা দিলদার হোসেন ওরফে প্রিন্সের বিরুদ্ধে কোমলমতি শিশু ছাত্রদের কাঁধে চড়ে হাঁটার অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া মনোহরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শহিদ উল্লাহের বিরুদ্ধেও একই ধরনের একটি অভিযোগ উঠেছে। গত বছরের পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে মনোহরদী ডিগ্রি কলেজ মাঠে ৩ দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা হয়। তাতে তৈরিকৃত মানব সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে সালাম গ্রহণ করেন এ ইউএনও। পরে তিনি সেতু দিয়ে হেঁটে নিচে নামেন। এ ছবি বুধবার রাতে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
এ প্রসঙ্গে তদন্ত কমিটির প্রধান জানান, চাঁদপুরের তদন্ত আমাদের শেষ হয়েছে। মেলান্দহের ঘটনাও তদন্ত করা হবে। এছাড়া এ ধরনের অন্য কোনো ঘটনা থাকলে তাও তদন্তের অধীনে আনা হবে।
এদিকে নরসিংদী প্রতিনিধি জানান, মনোহরদীতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মানব সেতুতে হেঁটে যাওয়ার ছবি ও সংবাদ নিয়ে জেলাজুড়ে তুমুল সমালোচনার ঝড় উঠেছে। এ নিয়ে মনোহরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শহিদ উল্লাহ আজ তার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন বলে জানা গেছে।