ইসলাম পরিবারকে সুশৃঙ্খল ও গতিশীল করার জন্য নানা বিধিবিধান প্রবর্তন করেছে। মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবিবের মাধ্যমে এসব বিধান মানবজাতিকে জানিয়ে দিয়েছেন। নিম্নে পারিবারিক জীবনের প্রতি ইসলামের গুরুত্বারোপের উল্লেখযোগ্য কিছু দিক আলোচিত হলো—
বিয়ের প্রতি উৎসাহ
পরিবারের মূল ভিত্তি হলো বিয়ে। বিয়ের মাধ্যমেই গড়ে ওঠে পরিবার। রচিত হয় সভ্যতার ভিত্তিভূমি। তাই ইসলাম পরিবার গঠনে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বিয়ের নির্দেশ দিয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যদি আশঙ্কা করো যে এতিম মেয়েদের প্রতি সুবিচার করতে পারবে না, তাহলে বিয়ে করবে নারীদের মধ্য থেকে যাকে তোমাদের ভালো লাগে—দুই, তিন অথবা চার। আর যদি আশঙ্কা করো যে তাদের মধ্যে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না, তাহলে কেবল একজনকে বিয়ে করবে...। ’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৩)
সাধারণভাবে বিয়ে করা সুন্নাত। তবে বিয়ের হুকুম সবার ক্ষেত্রে একই রকম নয়। ব্যক্তিভেদে তা ফরজ, ওয়াজিব, মুস্তাহাব, মাকরুহ প্রভৃতি হয়ে থাকে।
বিয়ে ইসলামী শরিয়তের এক অনন্য ব্যবস্থা। এর তাৎপর্য ও উপকারিতা অপরিসীম। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো—
এক. মহান আল্লাহ মানুষকে সহজাত প্রবৃত্তি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ তার প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণের জন্য সদা উদগ্রীব থাকে। যদি সে তার মনোদৈহিক চাহিদা পূরণের অবকাশ না পায়, তাহলে হতচকিত-বিচলিত হয়ে পড়ে এবং পাপের পথে ধাবমান হয়। এ ক্ষেত্রে বিয়েই একমাত্র কার্যকর ব্যবস্থা, যা তার দেহ-মনের চাহিদা পূরণ করে তাকে আত্মিক প্রশান্তি ও অনাবিল সুখানুভূতিতে অবগাহন করিয়ে ব্যভিচারের পথ থেকে নিবৃত্ত করে। এদিকে ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর আল্লাহর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে যে তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের সঙ্গিনীদের, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। চিন্তাশীল জাতির জন্য এতে অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে। ’ (সুরা : আর রুম, আয়াত : ২১)
দুই. সন্তান জন্মদান ও বংশবিস্তার বিয়ের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য। বিয়ের মাধ্যমে এক পরিবারের সঙ্গে আরেক পরিবারের আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পানি থেকে। অতঃপর তিনি তার বংশগত ও বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করেছেন। ’ (সুরা : আল ফুরকান, আয়াত : ৫৪)
স্বামী-স্ত্রীর মিলনের মাধ্যমে সন্তান জন্ম নেওয়ার ফলে মুসলিম উম্মাহর সংখ্যাও বেড়ে যায়। ফলে মুসলিম উম্মাহ একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দণ্ডায়মান হয়। এ জন্য নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা এমন নারীদের বিয়ে করবে, যারা স্বামীদের অধিক ভালোবাসে এবং অধিক সন্তান প্রসব করতে সক্ষম। কেননা আমি (কিয়ামতের দিন) তোমাদের সংখ্যাধিক্যের কারণে (আগের উম্মতদের ওপর) গর্ববোধ করব। ’
শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভি (রহ.) লিখেছেন, ‘স্বামী ও স্ত্রীর ভালোবাসার মাধ্যমে পারিবারিক কল্যাণ পূর্ণ হয় এবং বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে সভ্যতা ও জাতির কল্যাণ পূর্ণতা লাভ করে। আর স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালোবাসা তার মেজাজের সঠিকতা ও স্বভাব-চরিত্রের দৃঢ়তা নির্দেশ করে। ...এতে তার লজ্জাস্থান ও দৃষ্টির পবিত্রতা নিশ্চিত হয়। ’
তিন. দৃষ্টি সংযতকরণ, আদর্শ জাতি ও আদর্শ সমাজ গঠন এবং পৃথিবী আবাদ করার জন্য বিয়ের প্রয়োজন।
চার. বিয়ের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম-ভালোবাসার যে ফল্গুধারা প্রবাহিত হয়, তা পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে বৃহত্তর মানবপ্রেমে মানুষকে উজ্জীবিত করে।
পাঁচ. বিয়ের ফলে স্ত্রী-সন্তানদের প্রতি স্বামীর যে দায়িত্ববোধ জাগ্রত হয়, তা তার কর্মচাঞ্চল্য বৃদ্ধি করে এবং তার যোগ্যতা-অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে উদ্বুদ্ধ করে। সে তাদের জন্য উপার্জনে প্রবৃত্ত হয়। ফলে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে সম্পদ ও উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। আবিষ্কৃত হতে থাকে নিত্যনতুন খনিজ সম্পদ ও অন্যান্য জিনিস।
ছয়. বিয়ের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য লাভ করা যায় ও আর্থিক সচ্ছলতা বৃদ্ধি পায়। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন, তাদের বিবাহ সম্পাদন করো এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎ তাদেরও। তারা অভাবগ্রস্ত হলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের অভাবমুক্ত করে দেবেন। আল্লাহ তো প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। ’ (সুরা : আন নূর, আয়াত : ৩২)
সাত. বিয়ের মাধ্যমে চারিত্রিক অবক্ষয় থেকে জাতি রক্ষা পায়। সমাজে জেনা-ব্যভিচার ও অশ্লীলতা হ্রাস পায়। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যার দ্বীনদারি ও নৈতিক চরিত্রে তোমরা সন্তুষ্ট, সে যদি তোমাদের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, তাহলে তার সঙ্গে (তোমাদের পাত্রীর) বিয়ে দাও। যদি তা না করো, তাহলে পৃথিবীতে ফিতনা-ফ্যাসাদ ও ব্যাপক বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়বে। ’
আট. বিয়ে মানুষকে পশুর জীবন থেকে নিষ্কৃতি দিয়ে মনুষ্যত্বের পর্যায়ে উন্নীত করে।
নয়. বিয়ে হচ্ছে মানুষের দায়িত্ব-কর্তব্যবোধের একটি প্রশিক্ষণক্ষেত্র। এখান থেকে মানুষ নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে সমাজের মানুষের প্রতিও তার যে দায়িত্ব-কর্তব্য আছে, সে ব্যাপারে সজাগ হয়।
দশ. বিয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়।
স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য
ক. মোহরানা পুরোপুরি আদায় করা : স্ত্রীর প্রতি স্বামীর প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে সন্তুষ্টচিত্তে তার মোহরানা পরিশোধ করে দেওয়া। (সুরা : আন নিসা, আয়াত : ৪)
খ. ভরণপোষণ : মহান আল্লাহ বলেন, ‘পিতার কর্তব্য যথাবিধি তাদের ভরণপোষণ করা। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৩৩)
অন্য আয়াতে এসেছে, ‘বিত্তবান নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যয় করবে এবং যার জীবনোপকরণ সীমিত, সে আল্লাহ যা দান করেছেন, তা থেকে ব্যয় করবে। ’ (সুরা : আত তালাক, আয়াত : ৬-৭)
গ. স্ত্রীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা : মহান আল্লাহ বলেন, ‘তাদের সঙ্গে সত্ভাবে জীবন যাপন করবে। ’ (সুরা : আন নিসা, আয়াত : ১৯)
স্ত্রীর দায়িত্ব ও কর্তব্য
ক. স্বামীর আনুগত্য করা : স্বামীর আনুগত্য করা স্ত্রীর অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মহিলা যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে, রমজানের রোজা রাখে, নিজের সতীত্ব রক্ষা করে এবং স্বামীর আনুগত্য করে, তাহলে তাকে (কিয়ামতের দিন) বলা হবে, যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা সে দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করো। ’
খ. স্বামীর আমানত রক্ষা করা : স্বামীর অনুপস্থিতিতে নিজেকে যাবতীয় অশ্লীলতা ও অপকর্ম থেকে হেফাজত করা এবং স্বামীর অর্থ-সম্পদের আমানত রক্ষা করা স্ত্রীর অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। মহান আল্লাহ বলেন, ‘সাধ্বী স্ত্রীরা হয় অনুগত এবং আল্লাহ যা হেফাজতযোগ্য করে দিয়েছেন, লোকচক্ষুর অন্তরালে তার হেফাজত করে। ’ (সুরা : আন নিসা, আয়াত : ৩৪)
Source:
লেখক : শিক্ষক, মাদ্রাসাতুল মদিনা