ঢাকার গণপরিবহনে নিয়মের বালাই নেই

Author Topic: ঢাকার গণপরিবহনে নিয়মের বালাই নেই  (Read 700 times)

Offline Md. Rasel Hossen

  • Sr. Member
  • ****
  • Posts: 299
  • Test
    • View Profile
ঢাকায় বাস-মিনিবাসে শুধু নেই আর নেই। বাইরে সারা গায়ে দগদগে ক্ষত। ভেতরে বাড়তি আসনের কারণে যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্য নষ্ট। গুনতে হচ্ছে বাড়তি ভাড়া। চলাচলের উপযুক্ততার (ফিটনেস) সনদ, বিমা, চালকের লাইসেন্সসহ নেই কিছুই। গণপরিবহনের এই দশা বেরিয়ে এসেছে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) দীর্ঘদিন ধরে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে রাজধানী ঢাকা এবং এর আশপাশে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে। বিআরটিএর এই চলমান অভিযানের মধ্যে ঢাকার জেলা প্রশাসন ও বিআরটিএর সহায়তায় গত রোববার থেকে আদালত পরিচালনা করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ৫ মার্চ থেকে শুরু হওয়া এই অভিযান ২০ কর্মদিবস চলার কথা। এর আগে ঢাকা জেলা প্রশাসনও আদালত পরিচালনা করেছে। নির্বাহী হাকিমের নেতৃত্বে এসব আদালতে সহায়তা দিচ্ছে ঢাকা মহানগর পুলিশ।
গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার ছয়টি স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়। সরেজমিনে দেখা গেছে, এসব আদালতের সামনে যেসব বাস-মিনিবাস থামানো হয়, এর ৯০ শতাংশই মোটরযান আইনের কোনো না কোনো ধারা ভেঙে চলেছে। অধিকাংশ চালকের লাইসেন্স নেই। রংচটা বাস-মিনিবাসের বেশির ভাগেরই নেই ফিটনেস সনদ। চলাচলের অনুমতিপত্র, বিমার দলিল, আয়করের কাগজ পাওয়া যায়নি অনেক বাসে। নির্ধারিত আসনের চেয়ে ১০টি পর্যন্ত বাড়তি আসন বসানো হয়েছে। জানালা ভাঙা, শরীরের অসংখ্য জায়গা তুবড়ে গেছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের উপস্থিতি টের পেয়ে অনেক চালক পুলিশের সংকেত না মেনে গাড়ি নিয়ে পালিয়েছেন।
গতকাল বিআরটিএর তিনটি ভ্রাম্যমাণ আদালতে ১০৬টি মামলা করা হয়। এসব মামলায় পরিবহনমালিককে জরিমানা করা হয়েছে ১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে আটজন চালককে। গত রোববার আদালত পরিচালনা করে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ২০ জন চালককে কারাদণ্ড দেয়। এ সময় ফিটনেসবিহীন ১২টি বাস জব্দ করা হয়। জরিমানা আদায় করা হয় ৩ লাখ ৫১ হাজার ২৫০ টাকা। মোটরযান আইনে বাসের চালকের কাছে নিবন্ধন, ফিটনেস, বিমাসহ ছয় ধরনের দলিল থাকা বাধ্যতামূলক।
বিআরটিএর হিসাবে, ঢাকায় প্রায় ছয় হাজার বাস-মিনিবাস চলে। আর জাইকার প্রতিবেদন বলছে, ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে সোয়া দুই কোটি মানুষের যাতায়াত হয় বাসে। যান্ত্রিক যানের মধ্যে বাস-মিনিবাসের ব্যবহারকারীই অর্ধেকের বেশি।
টিকাটুলী: মিনিবাসে অতিরিক্ত ১০ আসন
সকাল সাড়ে ১০টা, টিকাটুলীর অভিসার সিনেমা হলের সামনে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম শুরু করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাসমিয়া জায়গির। একপর্যায়ে গ্রিন বাংলা পরিবহনের একটি মিনিবাস থামান পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। আদালত যাচাই করে দেখতে পান, এই বাসের চলাচলের অনুমতি (রুট পারমিট), হালনাগাদ ট্যাক্সের কাগজ ও বিমার দলিল নেই। চালকেরও নেই লাইসেন্স। ৩০ আসনের মিনিবাসে অতিরিক্ত ১০ আসন যুক্ত করা হয়েছে। ফলে যাত্রীদের ঠিকমতো বসার উপায় নেই। বাসের ভেতর-বাইরে রং চটে গেছে। সব মিলিয়ে চালক ও মালিকের বিরুদ্ধে ছয় হাজার টাকা জরিমানা করেন আদালত।
একই সময় আসিয়ান পরিবহনের একটি বড় বাস পুলিশ দাঁড় করালে এক ফাঁকে চালক পালিয়ে যান। চালকের সহকারীকে আটক করে পুলিশ। আদালত দেখতে পান, ওই বাসের একেকটি আসনের উচ্চতা একেক রকম। দুই পাশের জানালার কাচ ভাঙা। পেছনের কাচ ভেঙে পড়ে গেছে। সামনের কাচটি চৌচির। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই। আদালত আট হাজার টাকা জরিমানা করেন।
বাসের যাত্রী মোতালেব মিয়া বলেন, বাসের আসন ছোট হওয়ায় পা বাঁকা করে বসতে হয়। এ ছাড়া যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা এবং দাঁড়িয়ে লোক নেওয়া হয়। এর মধ্যে স্বচ্ছন্দে চলাচল করা যায় না। বেলা দেড়টার দিকে রংধনু পরিবহনের একটি বাস থামালে আদালত দেখতে পান, ভেতরে কয়েক স্তর ধুলাবালু জমে আছে। অন্তত ১০টি আসনের কোনো না কোনো অংশ ভাঙা। দুই পাশে জানালার অধিকাংশ কাচও ভাঙা। চালকের লাইসেন্সসহ প্রয়োজনীয় অনেক দলিলই নেই। বাসটিকে সাত হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
আদালত পরিচালনাকালে এই পথে বাস চলাচল কমে যায়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের কথা শুনে অনেক চালক দ্রুত বাস চালিয়ে সটকে পড়েন। পুলিশ ও আনসার সদস্যরা শিকড়, শিখর, গ্রিন বাংলা পরিবহন ও গাবতলী-যাত্রাবাড়ী পথে চলাচলকারী (পুরোনো ৮ নম্বর রুট) অনেক বাস চেষ্টা করেও থামাতে ব্যর্থ হন।

অধিকাংশ চালকের লাইসেন্স নেই। রংচটা বাস-মিনিবাসের বেশির ভাগের নেই ফিটনেস সনদ। চলাচলের অনুমতিপত্র, বিমার দলিল, আয়করের কাগজ পাওয়া যায়নি অনেক বাসে
এ ছাড়া আদালত খাজা বাবা পরিবহনসহ কয়েকটি কোম্পানির বাস যাচাই করে প্রয়োজনীয় দলিলাদি পাননি। অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও বাড়তি আসন বসানোর অভিযোগে জরিমানা করেন আদালত। হেলমেট ছাড়া চালানোর দায়ে কয়েকজন মোটরসাইকেলচালকেরও জরিমানা হয়।
মতিঝিল: বাস ফেলে পালালেন চালক
একই সময় মতিঝিল সোনালী ব্যাংকের সামনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মামুন সরদার। দুপুরের দিকে পুলিশ নিউ ভিশন পরিবহনের একটি মিনিবাসের চালককে থামার সংকেত দিলে বাস রেখে পালিয়ে যান চালক। এই বাসের সহকারী ফিটনেস সনদ দেখাতে পারেননি আদালতকে। এ ছাড়া বাসে বাড়তি ১০টি আসন বসানো হয়েছে। পরে চার হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে কোম্পানির এক ব্যক্তি বাসটি ছাড়িয়ে নেন।
প্রায় একই সময় ঢাকা মেট্রো জ ১১-৮২২৩ নিবন্ধন নম্বরের বাসে ফিটনেস সনদ পাওয়া যায়নি। জানতে চাইলে নির্বাহী হাকিম মামুন সরদার প্রথম আলোকে বলেন, আদালত চলাকালীন ওই পথে চলাচলকারী যত বাস-মিনিবাস থামানো হয়, এর ৯০ শতাংশেরই কাগজপত্র ঠিক পাওয়া যায়নি। সব কটিতেই আসন বাড়ানো হয়েছে, যা যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্য নষ্ট করছে।
মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ: অল্পের জন্য বাঁচলেন ট্রাফিক কনস্টেবল
মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে গতকাল বিআরটিয়ের অভিযান চলাকালে ট্রাফিক পুলিশের সংকেত অমান্য করে মিনিবাস নিয়ে পালিয়ে যান এক চালক (ওপরে)  l ছবি: সাজিদ হোসেন
মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে গতকাল বিআরটিয়ের অভিযান চলাকালে ট্রাফিক পুলিশের সংকেত অমান্য করে মিনিবাস নিয়ে পালিয়ে যান এক চালক (ওপরে) l ছবি: সাজিদ হোসেন
সকালে এখানে আদালত পরিচালনা করেন বিআরটিএর হাকিম মুহাম্মদ আবদুস সালাম। শুরুতেই সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশা দাঁড় করিয়ে প্রয়োজনীয় দলিলাদি যাচাই করা হয়। সবকিছু ঠিকঠাক থাকায় জরিমানা না করেই ছেড়ে দেন আদালত। গাবতলী-যাত্রাবাড়ী পথের একটি রংচটা মিনিবাস দাঁড় করান পুলিশ সদস্যরা। হালনাগাদ কাগজপত্র থাকলেও বাসে ভাড়ার তালিকা টাঙানো ছিল না। বাড়তি আসন বসানো হয়েছে। এ জন্য এক হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
বেলা পৌনে ১১টা থেকে দুপুর পৌনে ১২টা পর্যন্ত এই আদালতের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, মোটরসাইকেলে চালকের পাশাপাশি আরোহীর হেলমেট না থাকা, পিকআপ ভ্যানের চালকের হালনাগাদ লাইসেন্স না থাকা, অনুমোদনের চেয়ে বাসে অতিরিক্ত আসন তৈরি করাসহ বিভিন্ন অপরাধে ১৭টি মামলা হয়। জরিমানা করা হয় ১১ হাজার ৮০০ টাকা।
পুলিশ সদস্যরা মেশকাত ও নিউ ভিশন পরিবহনের দুটি বাসের চালককে থামার নির্দেশ দিলে তাঁরা তা অমান্য করে দ্রুতগতিতে চলে যান। গাবতলী-যাত্রাবাড়ী পথের এমন একটি বাসের চাপা থেকে ট্রাফিক পুলিশের কনস্টেবল মোশাররফ অল্পের জন্য বেঁচে যান।
শাহবাগে ইউটার্ন
ঢাকা ক্লাবের পাশে বসা আরেকটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন হাকিম সুজিত হাওলাদার। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে দেখা যায়, মৎস্য ভবন থেকে শাহবাগে আসার সড়কে তীব্র যানজট। কিন্তু ভ্রাম্যমাণ আদালত থাকা প্রান্তে অর্থাৎ শাহবাগ থেকে মৎস্য ভবন যাওয়ার সড়ক প্রায় ফাঁকা। কিছু বাসের চালক আদালতের উপস্থিতি বুঝতে পেরে শিশুপার্কের সামনে ইউটার্ন নিয়ে আবার শাহবাগের দিকে চলে যান।
সাড়ে ১২টার দিকে মিরপুর-গুলিস্তান পথে চলাচলকারী নিউ ভিশন পরিবহনের একটি বাস থামালে ফিটনেস ও বিমার কাগজ পাওয়া যায়নি। চালকেরও লাইসেন্স নেই। সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রমাণ পাওয়া যায়। জরিমানা করতে গেলে সানোয়ার হোসেন নামে এক ব্যক্তি নিজেকে বাসের মালিক পরিচয় দেন এবং উত্তেজিত হয়ে যান। এ সময় নির্বাহী হাকিম সানোয়ারকে আটকের নির্দেশ দেন। পরে সানোয়ার হোসেনকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। বেলা একটায় মেশকাত পরিবহনের বাসচালকের লাইসেন্স না থাকায় ১৫ দিনের কারাদণ্ড দেন আদালত।
আদালতের কার্যক্রম চলাকালে বহু যাত্রী দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হন। তাঁদের মধ্যে সোহেল রানা বলেন, কারওয়ান বাজার থেকে তিনি বাসে উঠেছেন। যাবেন মতিঝিল। ইতিমধ্যে ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন। শাহবাগে আদালতের নির্দেশে বাস আটকানো হয়েছে। এখন হয় অন্য বাসে যেতে হবে নতুবা হেঁটে গন্তব্যে যেতে হবে। কিন্তু ভাড়া ফেরত পাওয়া যাবে না।
লক্কড়-ঝক্কড় বাসের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানের কার্যকারিতা সম্পর্কে জানতে চাইলে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সমস্যা যতটা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে, তা কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ আদালত দিয়ে পুরোপুরি সমাধান করা যাবে না। কারণ, ভ্রাম্যমাণ আদালত দুপুরেই শেষ হয়ে যায়। এরপর ফিটনেসবিহীন যানবাহন দেদার চলতে থাকে। ফলে তিনি মনে করেন, এই অভিযান কার্যকর করতে ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ ও শাস্তির ব্যবস্থার পাশাপাশি আইনটা কঠোর করতে হবে।
Md. Rasel Hossen
Senior Lecturer in Physics
Department of Natural Sciences
Daffodil International University,
Sukrabad, Dhanmondi, Dhaka-1207, Bangladesh