তোমার সন্তান তোমার নয়

Author Topic: তোমার সন্তান তোমার নয়  (Read 797 times)

Offline Md. Nazmul Hasan

  • Jr. Member
  • **
  • Posts: 90
  • Test
    • View Profile
তোমার সন্তান তোমার নয়
« on: March 09, 2017, 09:48:56 AM »
একটা ছড়া এ রকম—
দাদু মাকে ‘বৌমা’ ডাকে, বাবা ডাকে ‘শুনছো’
মা-ও কানে ফোনটা তুলে, সোফার পিঠে একটু হেলে
বলেন ‘মিসেস আবুল বলছি, তুমি কে বলছ?

একটা টিভি রিয়েলিটি শোতে নারীরা অংশগ্রহণ করে থাকেন। বর্তমানে তাঁরা কে কী করছেন উপস্থাপক জিজ্ঞাসা করলে তাঁদের অধিকাংশই বলেন, একসময় বাইরে কাজ করতেন কিন্তু এখন কেবলই হোম মেকার। কেবলই মিসেস অমুক। কেন? কারণের মধ্যে সন্তানের জন্ম এবং লালন-পালন অন্যতম। অনেক সাহসী নারী বলে দেন তাঁদের স্বামীরা বা শ্বশুরবাড়ির লোকজন পছন্দ করেন না। রবীন্দ্রনাথও একসময় ভেবেছিলেন, ‘ঘরেই নারীর সিংহাসন। সেখানেই তাদের রাজত্ব, প্রকৃতিদত্ত কাজের স্থান।’ নেপোলিয়ান বোনাপার্টও বলে গেছেন, ‘তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দেব।’ তাহলে শিক্ষিত মা কি কেবল সন্তানই শিক্ষিত করবেন? ধরে নিলাম জাতি গঠনে নারীশিক্ষার বিকল্প নেই। একজন শিক্ষিত মা তাঁর ছেলে ও মেয়ে দুই সন্তানকেই শিক্ষিত করার হাতেখড়ি দেবেন। ছেলেটি বড় হয়ে দেশ উদ্ধারে নিয়োজিত হবেন আর শিক্ষিত মেয়েটি আবার শিক্ষিত জাতি গঠনে শিক্ষিত মায়ের ভূমিকা পালনে নিয়োজিত হবেন। কারণ, মা যদি তাঁর ‘প্রকৃতিদত্ত কাজের স্থান’ ঘর ফেলে বাইরে কাজ করেন, তবে জাতিকে শিক্ষিত করবেন কারা? আর এই তথাকথিত জাতি কে বা কারা তা নিশ্চয় এতক্ষণে বোধগম্য না হওয়ার কারণ নেই।
ওদিকে আর্থসামাজিক উন্নয়নে শিক্ষিত নারীকে ঘরে বসিয়ে (?) রাখলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব হবে না—অর্থনীতিবিদদের সাফ তরিকা। শিক্ষিত নারীও নেপোলিয়ানের কথায় নাচতে নারাজ। শিক্ষা যে একই সঙ্গে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধের জন্ম দেয়, তা মহামতির প্রজেক্ট পরিকল্পনায় ছিল না। তাই আর্থসামাজিক উন্নয়নের আহ্বানে ব্যক্তি-পারিবারিক উন্নয়নও নারীকে উদ্বেলিত করেছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু যৌথ পরিবারের ভাঙন, নাগরিক জীবনের বাস্তবতা, অণু পরিবারের অপরিহার্যতা শ্রমজীবী-পেশাজীবী নারীর ওপর দ্বিগুণ শ্রম চাপিয়ে দিল। কেবল গৃহকর্মীর ওপর নির্ভর করে শ্রমজীবী মা নিশ্চিত হয়ে কাজে মনোযোগ দিতে পারেন না। তাঁর বেদনার কথা স্বামীর কাছে বা কর্মক্ষেত্রে আলোচনা করলে তাঁদের এককথা, ‘কাজ ছেড়ে দিলেই হয়।’
শিশুরা রাষ্ট্রেরই সম্পদ। রাষ্ট্রই তার ভবিষ্যৎ নাগরিকদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বহন করবে। রাষ্ট্রের উদ্যোগে কর্মস্থলে এবং সুবিধাজনক স্থানে পর্যাপ্ত পরিমাণে মানসম্পন্ন শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে

এ তো হলো মধ্যবিত্তের কড়চা। পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমশক্তির বিরাট অংশ নারী, তাঁদের সন্তানদের দেখাশোনার অভাবে গ্রামের বাড়িতে মা-শাশুড়ি বা নিকটাত্মীয়ের কাছে রেখে আসেন। মা বছরে দুই ঈদে দুবার তাদের দেখে আসতে পারেন। বলা বাহুল্য, পোশাকশিল্প কারখানায় যেসব নারী কাজ করেন, তাঁদের মধ্যে অবিবাহিত এবং একক মায়ের সংখ্যা স্বামী আছেন এমন নারীর তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। একক মায়ের সন্তানেরা, বিশেষ করে মেয়েশিশুরা গ্রামের বাড়িতে কতখানি নিরাপদে থাকে, তা আলাদা গবেষণার দাবি রাখে। এ ছাড়া বাসাবাড়িতে কাজ করা, স্বল্প মজুরির চাকরি বা দিনমজুর নারীর সন্তানদের বড় হয়ে ওঠার চিত্রও একই। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ বা কোনো অপরাধে জড়িয়ে পড়া থেকে সন্তানদের রক্ষা করার জন্য সমাজবিজ্ঞানীরা পারিবারিক বন্ধনের ওপর জোর দেন। এই যে লাখ লাখ নারী তাঁদের যে সন্তানকে আপন ছত্রচ্ছায়ায় মানুষ করতে পারছেন না, সেসব সন্তান বিপথগামী হলে এর দায়ভার কার?
শিরিন বলছিলেন নিজের কথা। তিনি শ্রমজীবী নন। নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিলেন বলে পরপর দুটো বাচ্চা মানুষ করতে গেলে শ্বশুর বা বাবার বাড়ির কেউ তাঁকে সাহায্য করেনি। বিয়ের পর স্বামী অন্য মানুষ। সামর্থ্যও কম। গৃহকর্মী রাখতে পারেননি। শিরিন সেলাইয়ের কাজ জানলেও তাঁর কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না। বাসার কাছেই একটা প্রশিক্ষণকেন্দ্র ছিল। ১৫ দিনের একটা প্রশিক্ষণ পেলেই তিনি জীবনটাকে অন্যভাবে শুরু করতে পারতেন। কিন্তু সাড়ে তিন ও দেড় বছরের সন্তান দুটোকে কোথায় কার কাছে রেখে যাবেন? কয়েক দিনের জন্য এক ঘণ্টা করে একটু ছুটি তাঁকে কেউ দেয়নি। পরে সন্তানেরা বড় হলে ওদের স্কুলে পাঠিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাতে কাজের চাপ আরও বেড়েছে। একটু অবসরের জন্য তিনি অস্থির হয়ে উঠছেন।
রেজা ইমতিয়ার একক পিতা। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর দুটো সন্তান নিয়ে নাজেহাল। বড়টিকে স্কুলে দিয়েছেন কিন্তু ছোটটিকে কোথায় রেখে কাজে যাবেন? কিছুদিন মা, কিছুদিন বোন, কিছুদিন পাশের বাসা এভাবে চালাচ্ছিলেন। উপায়ান্তর না দেখে বিয়েও করেছিলেন আবার কিন্তু টেকেনি। বাসার কাছেপিঠে বা তার কর্মক্ষেত্রে একটা শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র থাকলে তার এহেন দশা হয় না বলছিলেন।
নারীদের অনেক কারণেই চাকরি ছাড়তে হয়। স্বামীর অমত, বদলি, সহকর্মীদের অসহযোগিতা, কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব, ঈর্ষা, আচরণে বৈষম্য, যৌন হয়রানি, বেতন বৈষম্য ইত্যাদি। কিন্তু সবচেয়ে বড় কারণ শিশু দিবাযত্নকেন্দ্রের অভাব। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, দেশে শিক্ষিত নারীর সংখ্যা বাড়ছে, একক পরিবারের সংখ্যাও বাড়ছে। সন্তান কোথায় বা কার কাছে থাকবে, এ চিন্তায় অনেক শিক্ষিত ও যোগ্য নারী চাকরিতে টিকে থাকতে পারছেন না।
দেশে সরকারি, বেসরকারি, পোশাকশিল্পসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে নারী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। অথচ সরকারি হিসাবে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ঢাকা ও অন্যান্য জেলা শহরে মাত্র ৪৮টি শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র রয়েছে। আর বেসরকারিভাবে যে কটি আছে তা মধ্যবিত্তের সামর্থ্যের বাইরে।
উন্নত দেশে ব্যক্তি বা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পর্যাপ্ত শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র রয়েছে। এ ছাড়া যাঁরা বাইরে কাজ করেন না, তাঁরা প্রতিবেশীদের সন্তানদের পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ‘বেবি সিটিং’ করেন। আমরাও পাড়ায়-মহল্লায় এ ধরনের প্রচারণা চালিয়ে শ্রমজীবী নারীদের সাহায্য করতে পারি। এতে করে ঘরে অবস্থান করা নারীরাও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারেন। এ ছাড়া নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা থাকলে তঁারা নিজেরা শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিতে পারেন। এতে একদিকে যেমন উদ্যোক্তা হিসেবে নারীর নতুন ব্যবসায়ের দিগন্ত উন্মোচিত হবে, তেমনি শ্রমজীবী মায়েরাও সন্তানদের নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে আর কাজ ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাববেন না।
শিশুরা মা-বাবা-অভিভাবকের হলেও শেষ পর্যন্ত শিশুরা রাষ্ট্রেরই সম্পদ। রাষ্ট্রই তার ভবিষ্যৎ নাগরিকদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বহন করবে। রাষ্ট্রের উদ্যোগে কর্মস্থলে এবং সুবিধাজনক স্থানে পর্যাপ্ত পরিমাণে মানসম্পন্ন শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। নারীর স্বস্তি ও সৃজনশীলতাকে মানবসম্পদ উন্নয়নের সহায়কশক্তি হিসেবে গণ্য করতে হবে। কবি-দার্শনিক কাহলিল জিবরানও তাঁর দর্শনতত্ত্বানুযায়ী সন্তানকে দেখেছেন এভাবে—
‘তোমার সন্তানরা তোমার সন্তান নয়।
তারা তোমাদের মাধ্যমে আসে, তোমাদের থেকে নয়।
এবং যদিও তারা থাকে তোমাদের সঙ্গে, কিন্তু তাদের মালিক তোমরা নও’।


 8)উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক।
muslima.umme@gmail.com