Career Development Centre (CDC) > Articles and Write up

তথ্য-প্রযুক্তির প্রান্তিক আঁধারে বিপর্যস্ত তারুণ্য-আবু তাহের খান

(1/1)

Shamim Ansary:
বাংলাদেশ প্রায় এক দশক ধরে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গড়ে সাড়ে ৬ শতাংশেরও বেশি হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এ ক্ষেত্রে যেসব বিষয়ের অবদান সবচেয়ে বেশি বলে মনে করা হয়, তন্মধ্যে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যকার একটি বড় অংশের উদ্যোক্তা হিসেবে এগিয়ে আসার বিষয়টি অন্যতম। শিল্প ও কৃষি খাতের ব্যাপক উন্নয়ন, রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া, তথ্য-প্রযুক্তি খাতের দ্রুত বিকাশ সাধন প্রভৃতি ক্ষেত্রে শিক্ষিত তরুণদের অবদান ও অংশগ্রহণ শুধু ব্যাপক ও বিস্তৃতই নয়—তাদের এই অংশগ্রহণ অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন গুণগত মাত্রা সৃষ্টিতেও সক্ষম হয়েছে। শিল্প, ব্যবসায় তথা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের বাইরে শিক্ষা, গবেষণা ও অন্যান্য সৃজনশীল বুদ্ধিবৃত্তিক কাজেও তাদের অবদান গর্ব করার মতো। খেলাধুলা বিশেষত ক্রিকেটে তাদের উদীয়মান উত্থান সবার চোখ জুড়িয়ে দিয়েছে।

এই যে উজ্জ্বল তারুণ্য, এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের দিনগুলোতে বর্ধিত সমৃদ্ধি অর্জনেরই ইঙ্গিত বহন করে। কিন্তু পাশাপাশি আবার এটিও সত্য যে উল্লিখিত এই তরুণদের একটি বড় অংশই তথ্য-প্রযুক্তি সুবিধার অপব্যবহারের মাধ্যমে নিজস্ব মেধা ও যোগ্যতার চরম অপচয়কারী হয়ে উঠছে। অথচ আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশ শুধু অর্থনৈতিকভাবেই লাভবান হয়নি, রাষ্ট্র ও সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রেও এর সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। জানা যায়, তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে সরকারের কোনো কোনো দপ্তরের কাজকর্মে দুর্নীতি, অনিয়ম ও হয়রানি অনেকটা কমে গেছে। এতদসত্ত্বেও তথ্য-প্রযুক্তি সুবিধার অপব্যবহারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের তরুণ সমাজের একটি অংশের মেধা, প্রতিভা ও সম্ভাবনা কিভাবে ক্রমান্বয়ে চরম অপচয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে, তা নিয়ে এখানে খানিকটা আলোকপাত করার চেষ্টা করা হলো।

তথ্য-প্রযুক্তি খাতের একটি নতুন অধ্যায় হচ্ছে ফেসবুক। একে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও বলা হয়। কিন্তু এই ফেসবুক-সমাজের তরুণ সদস্যরা বৃহত্তর বাস্তব সমাজ থেকে ক্রমেই অনেকটা স্বতন্ত্র ও আলাদা হয়ে পড়ছে। ফেসবুকে নিরন্তর সময় কাটিয়ে এরা পড়াশোনা, খেলাধুলা, নাটক, চলচ্চিত্র, সংগীত, সামাজিকতা সব কিছু থেকেই নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। এমনকি দৈনন্দিন অত্যাবশ্যকীয় কাজকর্মের ক্ষেত্রেও এরা পিছিয়ে পড়ছে। সকালের ক্লাসে উপস্থিত হওয়া বা আদৌ ক্লাসে না আসা, সময়মতো বাড়ির কাজ (অ্যাসাইনমেন্ট) জমা দিতে না পারা, ঘুমজড়ানো চোখে ক্লাসে মনোযোগ দিতে না পারা ইত্যাদি ঘটনায় সুনির্দিষ্ট অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসবের পেছনে রয়েছে ফেসবুক। সারা রাত ফেসবুকে কাটালে পরের দিন উল্লিখিত ঘটনাগুলো ঘটতে বাধ্য এবং সেগুলোই এখন ঘটে চলেছে বাংলাদেশের শহুরে সমাজের এমনকি বহু ক্ষেত্রে মফস্বলের তরুণ-যুবকদের ক্ষেত্রেও।

জানা গেছে, এই তরুণদের একটি বড় অংশই তথ্য-প্রযুক্তি সুবিধার অপব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের শুধু অলস, কর্মবিমুখ, সময় অপচয়কারী ও আড়ষ্টতাপূর্ণ স্বপ্নহীন প্রজন্মের দিকেই ঠেলে দিচ্ছে না, এ প্রক্রিয়ায় চিন্তার বন্ধ্যত্বে পড়ে কখনো কখনো এদের মধ্যকার একটি বড় অংশ মাদক সেবন ও অন্যান্য অপরাধের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছে। হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের ‘ঘুমহীনতার কারণ অনুসন্ধান’ বিষয়ক এক গবেষণায় সেখানকার হাসপাতালে ভর্তি থাকা এক হাজার ৮০০ তরুণের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, তাদের প্রত্যেকেরই ফেসবুক ও টুইটার অ্যাকাউন্ট রয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে অত্যন্ত যুক্তিসংগতভাবেই একটি অভিযোগ চলে আসছে যে খেলার মাঠ বা খোলা জায়গার অভাবে শহরের শিশু-কিশোরদের যথাযথ শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটছে না। অভিযোগটি শুধু যথার্থই নয়—গুরুতরও। কিন্তু তার সঙ্গে নতুন যে অনুষঙ্গ যুক্ত হয়েছে, তা আরো ভয়ংকর! শহরের বেশির ভাগ (এমনকি গ্রাম বা মফস্বলেরও একটি বড় অংশ) শিশু-কিশোর এখন ফেসবুক বা মোবাইলের মধ্যে নিজেদের আটকে রেখে ঘর থেকেই বের হয় না বা হতে চায় না। ফলে তাদের জন্য খেলার মাঠ থাকা বা না থাকা দুটিই এখন অপ্রাসঙ্গিক। এ অবস্থায় এ শিশু-কিশোররা শারীরিক ও মানসিক উভয় ক্ষেত্রেই চরম বৈকল্যের শিকার হয়ে পড়ছে।

মাদকাসক্তি, খুনখারাবি, পর্নোগ্রাফি ও অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিস্তারেও মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুক ইত্যাদির গুরুতর রকমের ভূমিকা রয়েছে। এমনকি সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির কল্যাণে দেশের তরুণদের একটি অংশ এখন নানা আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্রের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছে। দেশে জঙ্গিবাদ বিস্তারের পেছনেও তথ্য-প্রযুক্তির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে অপরাধসংক্রান্ত কর্মকাণ্ডগুলো ক্রমেই একধরনের আন্তর্জাতিক চরিত্র ও মাত্রা পেয়ে যাচ্ছে। সমাজে মিথ্যাচারিতা, প্রতারণা ও ধূর্ততার প্রসারেও তথ্য-প্রযুক্তি এখন একধরনের আগ্রাসী ভূমিকা রাখছে। নিরুপায় হয়ে ফেসবুকভিত্তিক সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সরকার সম্প্রতি ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকে বসারও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।

শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে পাঠাভ্যাস গড়ে না ওঠার পেছনে ফেসবুকে মাত্রাতিরিক্ত সময় কাটানো যে একটি বড় কারণ, তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। অথচ তথ্য-প্রযুক্তি হয়ে উঠতে পারত তাদের অধিকতর পাঠমুখী হয়ে ওঠার অন্যতম সহায়ক হাতিয়ার। তথ্য-প্রযুক্তির নানা মাধ্যম হতে পারত অধিকতর তথ্য, জ্ঞান ও ধারণা দিয়ে নিজেদের অধিকতর  সমৃদ্ধরূপে গড়ে তোলার একটি চমৎকার লাগসই উপায়। কিন্তু সেসব তো হচ্ছেই না, উল্টো তথ্য-প্রযুক্তি সুবিধার সুযোগ ও সহজলভ্যতার অপব্যবহার ঘটিয়ে নিজেদের তারা স্বপ্নবিমুখ অন্ধকারের গহ্বরে সঁপে দিচ্ছে।

তথ্য-প্রযুক্তির প্রান্তিক পর্যায়ের অপব্যবহারের দীর্ঘমেয়াদি কুফল নিয়ে উপস্থাপিত আলোচনাকে কারো কারো কাছে নেতিবাচক বলেও মনে হতে পারে। আমাদের বহু তরুণ যে দেশ-বিদেশের নানা ক্ষেত্রে বিশ্বমানের সাফল্য ও দক্ষতা দেখাতে সক্ষম হচ্ছে, সেসবকে উদ্ধৃত করে কেউ কেউ ওপরের আলোচনাকে অযথার্থ বলে আখ্যায়িত করতেও প্রয়াসী হতে পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে তরুণদের উল্লিখিত নানা সাফল্যের কথা মনে রেখেও বলা প্রয়োজন যে আমাদের উদীয়মান তরুণ সমাজের বিশাল আকৃতির তুলনায় উল্লিখিত সাফল্যের হার মোটেও পর্যাপ্ত নয়।

এ অবস্থায় তাহলে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের উপায় কী? অথবা সে উপায় আদৌ আছে কি না? অবশ্যই আছে। একচেটিয়া মুনাফালোভী গোষ্ঠীর বলয় থেকে বেরিয়ে এসে তথ্য-প্রযুক্তিসংক্রান্ত রাষ্ট্রের নীতি কাঠামোকে ঢেলে সাজাতে পারলে এ সমস্যা অনেকাংশেই কমে আসতে বাধ্য। মোবাইল অপারেটররা সারা রাত ধরে হ্রাসকৃত বা নামমাত্র মূল্যে সেবা গ্রহণের জন্য বিজ্ঞাপন দিয়ে তরুণদের উৎসাহিত ও আকৃষ্ট করছেন। আর রাজস্ব লাভের অজুহাত দেখিয়ে সরকারও তা হৃষ্টচিত্তে মেনে নিচ্ছে। আর এই সুবাদে দেশব্যাপী গড়ে উঠেছে অন্ধকারাচ্ছন্ন এক নৈশসমাজ, যা শেষ পর্যন্ত এ বৃহত্তর সমাজকে কোথায় নিয়ে ঠেকাবে আমরা কেউই জানি না।

কিছুদিন আগে ফোনের সিমকার্ড নিয়ন্ত্রণের একটি সীমিত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল সিম নিবন্ধন বাধ্যতামূলককরণের মধ্য দিয়ে। কিন্তু নিয়ম-নীতির নানা ফাঁকফোকর গলিয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর-কিশোরীরা কিংবা খুনি মাস্তান বা ছিনতাইকারী সবার হাতেই এখন আবার আগের মতোই সিমকার্ডের যথেচ্ছ বিচরণ। আর অপ্রাপ্তবয়স্ক বহু তরুণের কাছে নিত্য-নিয়ত সিমকার্ড বদলানো এখন সিগারেটের শলাকা পরিবর্তনের মতোই সহজ ব্যাপার।

তথ্য-প্রযুক্তির গতিশীল ও যুক্তিসংগত বিকাশ ও ব্যবহারকে আমাদের অবশ্যই উৎসাহিত ও সহায়তা করতে হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সে উৎসাহ যেন কোনোভাবেই আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজকে দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকির মুখে ফেলে না দেয়। এক দশক ধরে গড়ে সাড়ে ৬ শতাংশ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পেছনে আমাদের তরুণ উদ্যোক্তা ও তথ্য-প্রযুক্তি খাতের যে অনন্য ভূমিকা রয়েছে, তথ্য-প্রযুক্তির প্রান্তিক পর্যায়ের অপব্যবহারের কারণে সে তরুণদেরই একটি বড় অংশ ক্রমান্বয়ে বিপথগামী ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে—সেটা কিছুতেই এবং কারোরই কাম্য হতে পারে না। আমরা আমাদের তারুণ্যের মেধা ও শক্তির বিকাশকে উৎসাহিত করি। কিন্তু একই সঙ্গে উদ্বিগ্ন বোধ করি তথ্য-প্রযুক্তির প্রান্তিক আঁধারে নিমগ্ন তাদের অবক্ষয়েরও।


লেখক : প্রকল্প পরিচালক. ইনোভেশন অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার (আইআইসি), ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি


http://www.ekalerkantho.com/home/displaypage/news_2017-03-22_14_18_b
http://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2017/03/22/477415

bipasha:
thanks for the post

SSH Shamma:
Thanks

Navigation

[0] Message Index

Go to full version