প্রথমে জানা যাক মানুষ–খেকো গাছের ধারণাটা প্রথম আসলো কোথা থেকে।
দ্য মাদাগাস্কার ট্রি
১৮৭৪ সালে এডমন্ড স্পেনসর নামক একজন ব্যক্তি ‘নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’ পত্রিকার জন্য একটি বানোয়াট প্রবন্ধ লিখেন। সেখানে তিনি কার্ল লিঞ্চ নামক একজন জার্মান অভিযাত্রীর কাছ থেকে পাওয়া একটি চিঠির উল্লেখ করেন। চিঠিতে কার্ল আফ্রিকার মাদাগাস্কারে তার দেখা একটা মানুষখেকো গাছের বর্ণনা দেন। এই গল্প পরে আরও কিছু পত্রিকায় ছাপা হয়। চেজ ওজবোর্নের লেখা বই ‘Madagascar, Land of the Man-eating Tree’ প্রকাশিত হবার পর এই মানুষ-খেকো গাছ ব্যাপারটা বেশি পরিচিতি পায়। কিন্তু এসবই ছিল বানোয়াট গল্প। এই গল্পগুলোর কোন বিশ্বাসযোগ্য ভিত্তি পাওয়া যায়নি।
দ্য ভ্যাম্পায়ার ভাইন
বৃটিশ জার্নাল ‘রিভিউ অব রিভিউ’-এর সম্পাদক উইলিয়াম থমাস স্টেড ১৮৯১ সালে তার জার্নালে ‘দ্য ভাম্পায়ার ভাইন’ নামে একটি ছোট প্রবন্ধ লেখেন। এ প্রবন্ধে তিনি লুসিফার ম্যাগাজিনের বরাত দিয়ে বলেন, নিকারাগুয়াতে “দ্য ডেভিলস্ স্নেয়ার” নামক একটি গাছের সন্ধান পাওয়া গেছে। সে গাছের সংস্পর্শে কোন জীবিত প্রাণী গেলে গাছটি তার রক্ত চুষে তাকে মেরে ফেলে। পরে অবশ্য একটি তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, লুসিফার ম্যাগাজিনে এরকম কোন গল্প ছাপা হয়নি। তাই, রিভিউ অব রিভিউয়ে ছাপা ‘দ্য ভ্যাম্পায়ার ভাইন’ সম্পূর্ণ কল্পিত ও বানোয়াট।
মাংসাশী উদ্ভিদ
মানুষ-খেকো গাছ বলে কিছু নেই পৃথিবীতে। তবে মাংসাশী গাছ বা কার্নিভোরাস প্লান্ট (Carnivorous plants) বলে একধরণের গাছ আছে যেগুলো বৈরি পরিবেশে জন্মাবার কারণে তার বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন মূল দ্বারা শ্বসন করতে পারে না। শরীরে নাইট্রোজেনের চাহিদা পূরণ করার জন্য গাছগুলো বিভিন্ন ধরণের পোকামাকড় এমনকি ছোট ছোট ইঁদুরকে পর্যন্ত শিকারে পরিণত করে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। মাংসাশী উদ্ভিদগুলো এসব প্রাণীকে বিভিন্ন উপায়ে ফাঁদে ফেলে। প্রাণীগুলো যখন ফাঁদে আটকে মারা যায় তখন এদের দেহ থেকে খনিজ উপাদান সংগ্রহ করে টিকে থাকে গাছগুলো।
আসুন পরিচিত হওয়া যাক কয়েকটি মাংসাশী গাছের সাথে
নেপেন্থেস
নেপেন্থেস এক ধরণের “পিচার প্লান্ট বা কলস গাছ”। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় এ প্রজাতির উদ্ভিদ দেখতে পাওয়া যায়। এ উদ্ভিদ যে পদ্ধতিতে শিকার করে তাকে “পিটফল ট্রাপ” বলে। এ উদ্ভিদের পাতাগুলো জন্মানোর সময় সাধারণ পাতার মতো দেখা গেলেও যখন এরা বড় হতে থাকে তখন পাতাগুলো কুন্ডলী পাকিয়ে কলসের আকৃতি ধারণ করে। এর প্রবেশপথ পাতার ডগা দিয়ে এমনভাবে ঢাকা থাকে যে এটা ঢাকনার কাজ করে। এই কলসের আকৃতির পাতার মধ্যে একধরণের জারক রস থাকে। এ জাতীয় উদ্ভিদ তার উজ্জল ফুল ও পাতা এবং মধু দ্বারা পোকামাকড়দের আকৃষ্ট করে। একবার যদি কোন পোকা এই ফাঁদে পা দিয়ে কলসের মধ্যে পরে যায়, তাহলে আর সেখান থেকে উঠতে পারে না। কারণ এই কলসির আকৃতির পাতাগুলোর ভেতরের দিকে মোমের মত পাতলা, পিচ্ছিল একটা আবরণ থাকে যা পোকাগুলোকে উপরে উঠতে বাধা দেয়। ভিতরের জারক রসের মধ্যে পরে গেলে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই পোকাগুলো সেখানে দ্রবীভূত হয়ে যায় এবং গাছের খাদ্যে পরিণত হয়।
ড্রোসেরা
ড্রোসেরা জাতীয় উদ্ভিদের শিকারের পদ্ধতিকে সক্রিয় ‘ফ্লাইপেপার ট্রাপ’ বলে। এ পদ্ধতিতে উদ্ভিদগুলো নিজেদের শরীরের চিটচিটে আঠালো একধরণের পদার্থের সাহায্যে পোকামাকড়কে ফাঁদে ফেলে। ড্রোসেরার সরু উপাঙ্গের ন্যায় পাতায় ডগায় একধরণের আঠালো লালাগ্রন্থি শিশিরবিন্দুর ন্যায় জমে থাকে। এর আশেপাশে কোন পোকামাকড় এলে এর পাতাগুলো সেই দিকে খুব দ্রুত প্রসারিত হয় এবং পোকাগুলোকে লালাগ্রন্থির সাথে আটকে ফেলে। একবার পোকাগুলোকে ফাঁদে আটকে ফেলতে পারলে খুব সহজেই খাবারে পরিণত করে। এ উদ্ভিদের আদি বাস দক্ষিণ আফ্রিকায়। এর প্রায় ২০০ টি প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।
ভেনাস ফ্লাইট্রাপ
ভেনাস ফ্লাইট্রাপ “স্নাপ ট্রাপ” পদ্ধতিতে শিকারকে ফাঁদে ফেলে। অর্থাৎ এ ধরণের উদ্ভিদের পাতার সংবেদনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে শিকারকে আটকে ফেলে এবং খাদ্যে পরিণত করে। এর পাতার দুইভাগের মাঝখানে যে শিরা থাকে তার সাহায্যে পাতাগুলো দ্রুত খুলতে ও বন্ধ হতে পারে। পাতার ভিতরের দিকের পৃষ্ঠে এবং প্রান্ত জুড়ে ছোট ছোট কাঁটার মতো সংবেদনশীল লোম থাকে। পোকামাকড় বা এই জাতীয় কোনো শিকার এসব লোমের সংস্পর্শে আসা মাত্র অতি দ্রুততার সাথে শিকারসহ পাতার মুখ বন্ধ হয়ে যায়। পোকাগুলো পাতার মধ্যে আটকে গেলে এর ভেতরের জারক রস ধীরে ধীরে পোকার নরম অংশগুলোকে গলিয়ে খাদ্যে পরিণত করে।
পাতাগুলোর মধ্যে যদি খুব ছোট পোকা আটকে তবে পাতার মুখ বন্ধ হয় না। কারণ সেগুলো পর্যাপ্ত খাবারের যোগান দিতে পারে না। আবার পোকা ছাড়া অন্যকিছু, যেমন- ছোট পাথর বা অন্য কিছু তবে বার ঘন্টার মধ্যে ট্রাপটি পুনরায় খুলে যায় এবং সেটাকে বের করে দেয়।
ভেনাস ফ্লাইট্রাপের অনন্য সৌন্দর্যের কারণে এ উদ্ভিদ অনেকে বাড়ির টবেও চাষ করে।