নতুন গন্তব্য মিয়ানমারপ্রথম গিয়েছিলাম ২০১৩ সালের মার্চে বাংলাদেশ সিঙ্গেল কাউন্ট্রি মেলায় অংশ নিতে। শাসনক্ষমতায় তখন জান্তা সরকার। এ বছরের জুলাইয়ে দ্বিতীয়বার গিয়ে দেখে এলাম অং সান সু চির মিয়ানমার। ইয়াঙ্গুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামতেই চোখে পড়ছিল পরিবর্তনটা। ট্যাক্সিওয়েতে নানা দেশের পতাকাবাহী বেশ কিছু বিমান। পর্যটকদের পদভারে মুখর পুরো টার্মিনাল।
চার দিনের সফরে ইয়াঙ্গুন শহর এবং আশপাশে বেড়িয়ে এইটুকু স্পষ্ট—মিয়ানমার এখন পুরোপুরি পর্যটকবান্ধব। অথচ সামরিক শাসনের জালে প্রায় পাঁচ দশক প্রাকৃতিক স্বর্গীয় মিয়ানমারে পর্যটকদের যাতায়াত ছিল নিয়ন্ত্রিত। আর প্রতিবেশী হয়েও আমরা ছিলাম একপ্রকার নিষিদ্ধ।
ইয়াঙ্গুন শহরের কেন্দ্রে রয়েছে শোয়েডাগন প্যাগোডা। শুধু মিয়ানমার নয়, বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থাপত্য এটি। প্যাগোডায় ঢোকার প্রধান ফটক l ছবি: লেখক
ইয়াঙ্গুন শহরের কেন্দ্রে রয়েছে শোয়েডাগন প্যাগোডা। শুধু মিয়ানমার নয়, বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থাপত্য এটি। প্যাগোডায় ঢোকার প্রধান ফটক l ছবি: লেখক
ইন্টারনেট ঘেঁটে জানা যায়, মিয়ানমারে পর্যটক বাড়তে শুরু করে ২০১৩ সাল থেকেই। পর্যটকদের নিরাপত্তা ও সুবিধা বাড়াতে নেওয়া হয় বিলিয়ন ডলারের অবকাঠামো প্রকল্প। সহজ করা হয় ভিসা পাওয়া। বিশ্বের ৬৭টি দেশের জন্য চালু করা হয় ই-ভিসা পদ্ধতি। ২০১৩ সালেই মিয়ানমারে আসেন ২০ লাখের বেশি পর্যটক। অথচ দুই বছর আগে ২০১০ সালে এর সংখ্যা ছিল ৮০ হাজারের মতো। আর গত বছর তা এসে দাঁড়ায় ৪৭ লাখে। এ বছর ৬০ লাখের কাছাকাছি হওয়ার আশা সে দেশের পর্যটন বোর্ডের।
গণতন্ত্রের সুবাতাসে এখন পুরোপুরি চাঙা মিয়ানমারের পর্যটনশিল্প। ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আমেরিকা থেকেও পর্যটক আসছে মিয়ানমারে। আকাশপথে সরাসরি যাতায়াত, ভিসার পদ্ধতি সহজ করা আর কম খরচের কারণে বাংলাদেশি পর্যটকদের জন্যও মিয়ানমার হয়ে উঠেছে নতুন গন্তব্য।
রাখাইন রাজ্যের জাতিগত বিরোধের তেমন প্রভাব দেখা যায় না মিয়ানমারের পযর্টন এলাকাগুলোতে। রয়েছে সব ধর্মের সহাবস্থান। খোদ ইয়াঙ্গুনের ডাউন টাউনে প্যাগোডার পাশে মসজিদ দেখেছি, কাছাকাছি মন্দির, গির্জাও আছে। তবে দাঙ্গার কারণে রাখাইনে বিদেশি পর্যটকের যাতায়াত নিষিদ্ধ।
প্রায় ৬ লাখ ৭৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের মিয়ানমারের পরতে পরতে রয়েছে অনেক সৌন্দর্য। প্রাচীন ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিতে লালিত প্রকৃতির রূপ আর চমৎকার স্থাপত্যশৈলীর প্যাগোডাই বিশ্ব পর্যটকদের কাছে টানছে। ইয়াঙ্গুন, বাগান, মান্দালয়, নেপিডো, ইনলে লেক ও নেগপালি সৈকত পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয়।
ঐতিহাসিক নগর ইয়াঙ্গুন। একসময় মিয়ানমারের রাজধানী থাকলেও এখন শুধু প্রধান বাণিজ্যিক ও বন্দরনগর। ২০০৬ সালে মিয়ানমারের নতুন রাজধানী হয় নেপিডো। রেঙ্গুন হিসেবে বিশ্বখ্যাত শহরটিতে মিয়ানমারের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অনেক কিছুই আছে। আমাদের চট্টগ্রামের সঙ্গেও এই শহরের যেন আত্মার বাঁধন। একসময় চট্টগ্রাম থেকে ব্যবসার জন্য রেঙ্গুন (এখন ইয়াঙ্গুন) যেতেন ব্যবসায়ীরা। ভালোবাসায় বাঁধা পড়ে অনেকে সংসারও পেতেছেন। এ নিয়ে রয়েছে অনেক কিংবদন্তি।
এবার ইয়াঙ্গুনের বয়ান। শহরের কেন্দ্রে রয়েছে শোয়েডাগন প্যাগোডা। শুধু মিয়ানমার নয়, বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থাপত্য এটি। সোনালি এই প্যাগোডা দেখতে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছাড়াও বিশ্বের হাজারো পর্যটক ছুটে আসেন। সোনার পাতে মোড়ানো মন্দিরটির উচ্চতা ৯৯ মিটার। গৌতম বুদ্ধের একগাছি চুল ও বৌদ্ধ ধর্মের বহু অমূল্য পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে এখানে। তাই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র জায়গা এটি। প্যাগোডার আশপাশে রয়েছে বুদ্ধের নানা ভঙ্গিমার অনেক মূর্তি। প্যাগোডাটি আড়াই হাজার বছর আগে তৈরি বলে দাবি করা হয়। এ ছাড়া ডাউন টাউনের সুলে প্যাগোডা আর নদী পাড়ের বুটাটাঙ্গ প্যাগোডা, সুয়ে-তা-মায়াত-পায়া (যেখানে গৌতম বুদ্ধের দাঁত সংরক্ষিত রয়েছে) ইয়াঙ্গুনের অন্যতম বৌদ্ধ নিদর্শন।
শোয়েডাগন প্যাগোডার পূর্বদিকে রাজপরিবারের বিশাল হ্রদ কানুজিও আকর্ষণীয় একটি স্থান। এর প্রধান আকর্ষণ হ্রদে ভাসমান রেস্তোরাঁ ‘রয়েল কারাউইক হল’। ১৯৭৪ সালে চালু হওয়া জাহাজ শৈলীতে কাঠ দিয়ে বানানো জোড়া ড্রাগনমুখের এই রেস্তোরাঁয় স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী খাবারের পাশাপাশি ভারতীয় ও ইউরোপিয়ান খাবারের আয়োজন থাকে প্রতি রাতে। খাবার খেতে খেতে পর্যটকেরা উপভোগ করেন মিয়ানমারের ঐতিহ্যবাহী গান ও নাচ। হ্রদের উত্তর পাশে আংসান পার্কটিও দেখার মতো।
শহরের দাগান এলাকার জাগাওয়ার স্ট্রিটের পাশেই শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের সমাধি। সিপাহি বিপ্লবের পর ক্ষমতাচ্যুত বাহাদুর শাহকে ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশরা রেঙ্গুনে নির্বাসনে পাঠায়। ১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর ৮৯ বছর বয়সে এখানেই তিনি মারা যান। আম ও কড়ইগাছে ঘেরা গেরুয়া রঙের সমাধি কমপ্লেক্সে ভেতরে বাহাদুর শাহ জাফরের স্ত্রী জিনাত মহল এবং দুই ছেলে মির্জা জওয়ান বখত ও মির্জা শাহ আব্বাসেরও কবর রয়েছে। আছে শেষ সম্রাটের অনেক দুর্লভ ছবি, তাঁর হাতের ক্যালিগ্রাফি।
শহরের মাঝখানে ইনায়া লেকের লেকের মেরি গো রাউন্ডটিতে চড়ে পুরো শহরটাকে এক নজর দেখা যায়। লেকের পাশেই অং সান সু চির বাসাটি দেখতে যান অনেক পর্যটক।
ইয়াঙ্গুনে রয়েছে কয়েকটি জাদুঘরও। ‘ডিফেন্স সার্ভিস হিস্টোরিক মিউজিয়ামে’ গেলে দেখতে পাবেন মিয়ানমারে সব সমরাস্ত্র। এখানে প্রাচীন যুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। মিয়ানমারের খনিজ সম্পদ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় ‘জেম মিউজিয়াম অ্যান্ড জেমস মার্টে’। এখানকার জেমস মার্টে রয়েছে হীরা, মুক্তা, পান্নাসহ হরেক রকমের পাথর ও অলংকার। আর ‘ন্যাশনাল মিউজিয়ামে’ উপস্থাপন করা হয়েছে মিয়ানমারের প্রাচীন থেকে আধুনিক যুগের কৃষ্টি ও সভ্যতা। বর্ণমালা ও ক্যালিগ্রাফির বিশাল প্রদর্শনী আছে এখানে।
ইয়াঙ্গুন বাইরে মিয়ানমারের শেষ রাজকীয় রাজধানী মান্দাল, প্যাগোডার শহর খ্যাত প্রথম রাজবংশের রাজধানী বাগান, নতুন রাজধানী নেপিডো, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এক হাজার মিটার উঁচুতে অবস্থিত পাঁচ কিলোমিটার লম্বা শান রাজ্যের ইনলে লেক, সাদা বালু আর বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশির নগেপালি সমুদ্রসৈকত, প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য শহর ম্রাউক উ, আগ্নেয়গিরির মুখে অবস্থিত তুয়াং কালাত বিহার পর্যটন বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণ।
পর্যটকদের জন্য ইয়াঙ্গুনসহ প্রতিটি শহরেই রয়েছে বিলাসী হোটেল ও রিসোর্ট। আমাদের মতোই মাছ-ভাত বার্মিজদের প্রধান খাবার। রুই-কাতলার সঙ্গে মিয়ানমারের বিখ্যাত সোনালি চিংড়ির লোভনীয় পদ পাবেন সব রেস্তোরাঁয়। আছে চায়নিজ, ইউরোপিয়ান খাবারের অনেক হোটেল।
কেনাকাটার জন্য স্কর্ট মার্কেট বা বজিঅক অংসান মার্কেটে এবং এর আশপাশের বিপণিবিতান ও কাছাকাছি চায়না টাউন সবচেয়ে ভালো জায়গা।
জেনে নিন
মিয়ানমার বেড়ানোর সবচেয়ে ভালো সময় অক্টোবর থেকে জানুয়ারি। তবে সারা বছরই বেড়ানো যায়। চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি ফ্লাইট নেই। যেতে হবে কানেকটিং ফ্লাইটে ঢাকা হয়ে বাংলাদেশ বিমান কিংবা নোভো এয়ারে। দুই সংস্থারই সপ্তাহে তিনটি করে ফ্লাইট চলাচল করে ইয়াঙ্গুন রুটে। এর মধ্যে নোভো এয়ারের ট্রানজিট সময় অনেক কম। বিস্তারিত জানা যাবে মুঠোফোন (০১৭৩০০০৬৫৭৪) নম্বরে।
ভিসার জন্য
www.myanmar-visa.org ওয়েবসাইট আবেদন করতে পারেন সরাসরি। ২৮ দিন মেয়াদের পর্যটন ভিসার ফি
৫০ ডলার