রমজান মাস কল্যাণ, ক্ষমা ও মুক্তির মাস। কল্যাণের বার্তা নিয়ে মাহে রমজান এখন আমাদের মাঝে সমাগত। রমজানের চাঁদ উঁকি দেওয়ার প্রথম দিন থেকেই মুমিনদের মধ্যে শুরু হয়েছে পুণ্যের ব্যস্ততা। সাজসাজরব পড়েছে পৃথিবীর প্রচ্ছদে। নব-উচ্ছ্বাসে জেগে উঠেছে মুমিনের মনবাগিচা। রহমতের বারিধারায় সিক্ত হচ্ছে পুণ্যের লতাগুল্ম। তবে কথা হচ্ছে, পুণ্যের এ বসন্তকালে আমাদের কিছু ভুলের কারণে পুণ্যের পরিবর্তে আমরা আবার পাপ-পঙ্কিলতায় তলিয়ে যাচ্ছি না তো? এই যেমন অতিভোজন বা অপচয়ে!
আমরা অনেকেই মনে করি, ‘রমজান মাসে সাহরি ও ইফতারে যত ইচ্ছা তত খাও, আল্লাহ তাআলা এই খাওয়ার হিসাব নেবেন না। ’ যদিও ইসলামের কোথাও এমন কথা বলা হয়নি। বরং এটা করতে নিষেধ করা হয়েছে কোরআন-হাদিসের অনেক জায়গায়। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি পেট ভর্তি করে খানা খায়, তার ওই পেট একটি নিকৃষ্ট পাত্র। ’ (আহমাদ, হাদিস : ৩, পৃষ্ঠা ১৬৪)
তাই হজরত মুহাম্মদ (সা.) অতিভোজনকে পছন্দ করতেন না কখনোই। সে জন্যই তিনি মুমিনদের বলেছেন ‘পেটের তিন ভাগের এক ভাগ খাবার, এক ভাগ পানীয় দিয়ে পূরণ করতে; অন্য ভাগ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য খালি রাখতে। ’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৩৮০)
তিরমিজি শরিফের অন্য বর্ণনায় আছে, রোজার মাসে রাসুল (সা.) মাগরিবের আগে কয়েকটি ভেজা খেজুরের মাধ্যমে ইফতার করতেন। ভেজা খেজুর না থাকলে সাধারণ শুকনো খেজুর। এর ব্যতিক্রম হলে কয়েক ঢোক পানিই ছিল রাসুল (সা.)-এর ইফতার। অথচ আমরা সেই নবীর উম্মত হয়ে সাহরি ও ইফতারে হয়ে পড়ছি অসংযমী। সমাজে যারা বিত্তশালী, তাদের তো কোনো কথাই নেই। সাহরি ও ইফতারে তাদের জন্য ১০-২০ পদ খাবার চাই-ই চাই। অনেকের কাছে আবার রমজান মানে স্রেফ ইফতার পার্টির বিনোদন। রোজা রাখুক বা না রাখুক, ইফতারে তাদের ভোজনবিলাসিতার কমতি নেই। অথচ রমজান কোনো ভোজনবিলাসিতার মাস নয়। রমজান হলো আত্মশুদ্ধির মাস।
রমজানকে কেন্দ্র করে এই যে এত এত ইফতার পার্টি হচ্ছে, এত এত খাবারের আয়োজন হচ্ছে, এর সবই কি খাওয়া হচ্ছে? না, হচ্ছে না। বরং খাবারের বিরাট একটি অংশ অপচয় করা হচ্ছে। এর বৃহদংশই শেষতক ডাস্টবিনে নিক্ষিপ্ত হয়। অথচ এভাবে অপচয় জঘন্য অপরাধ। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন, ‘তোমরা খাও ও পান করো। কিন্তু কোনো অবস্থায়ই অপচয় কোরো না। আল্লাহ অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না। ’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৩১)
ভেবে দেখুন, যেখানে খাদ্যাভাবে অসংখ্য মানুষ না খেয়ে রাত্রি যাপন করছে। একমুঠো খাবারের জন্য কত জনের প্রাণ বিলীন হচ্ছে। সেখানে আমরা এত এত খাদ্য অপচয় করছি কোন যুক্তিতে? হ্যাঁ, ইফতার করানো একটি অতীব পুণ্যের কাজ। এ ব্যাপারে হাদিসেও বেশ তাগিদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই রকম ইফতার করানোর দ্বারা আসলেই কি পুণ্য হচ্ছে? পুণ্য তো তখনই হবে, যখন সামর্থ্যহীন রোজাদারদের খাওয়ানো হবে। এটাই তো রোজা বা সিয়াম সাধনার উদ্দেশ্য। অথচ বাস্তবতার দিকে তাকালে দেখা যায় এর উল্টো চিত্র। ইফতার পার্টিতে দাওয়াত করা হয় কেবল তাঁদেরই, যাঁদের খাদ্যের কোনো অভাব থাকে না। অথচ পবিত্র রমজান এ শিক্ষা দেয় না।
পবিত্র রমজান সমাজের দারিদ্র্য পীড়িত ও ক্ষুধাতুরদের অবস্থা অনুধাবন করে তাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করার শিক্ষাই দেয়।
ভুলে গেলে চলবে না যে রমজান হলো সিয়াম সাধনার মাস। আর সাধনা মানেই হচ্ছে সব পার্থিব লোভ-লালসা, ভোগ-বিলাসিতা, অপচয়-অপব্যবহার ও সব ধরনের রিপুর দমন। অথচ আমরা অভ্যস্ত অতিভোজন আর অপচয়ের মহোৎসবে।
এবার আসুন জেনে নিই কেমন ছিল স্বয়ং নবীজির সাহরি ও ইফতার। হজরত আব্দুল্লাহ বিন আবি আউফ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রোজায় আমরা রাসুল (সা.)-এর সফরসঙ্গী ছিলাম। সূর্যাস্তের সময় তিনি একজনকে ডেকে বললেন, ছাতু ও পানি মিশিয়ে ইফতার পরিবেশন করো। ’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস : ১০৯৯)
রাসুল (সা.)-এর সাহরিও ছিল এমনই সাদাসিধা। হজরত আনাস (রা.) বলেন, ‘সাহরির সময় রাসুল (সা.) বললেন, আমি রোজা রাখব, খাবার দাও। আমি রাসুল (সা.)-এর সামনে খেজুর ও পানি পরিবেশন করলাম। ’ অন্য এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘মুমিনের উত্তম সাহরি শুকনো খেজুর। ’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২৩৪৫)
দেখুন, স্বয়ং রাসুল (সা.)-এর সাহরি ও ইফতার কতই না সাদাসিধা ছিল। খেজুর, ছাতু আর পানি। এরই মধ্যে তিনি পরিতৃপ্ত ছিলেন। আমরাও কি পারি না সেই নবীর উম্মত হয়ে নবীজির এই সুন্নাত অনুসরণ করতে? পারি না অতিভোজন আর অপচয় পরিহার করে, সেখান থেকে কিছু খাবার বাঁচিয়ে অভুক্ত মানুষগুলোর মুখে তুলে দিতে?
রমজান সৌহার্দ্যের মাস। সৌহার্দ্য তাকেই বলে, যা অসহায় ও দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটায়। এটাই মাহে রমজানের শিক্ষা।
Source: ইমাম, বাইতুল মামুর জামে মসজিদ, তালুকপাড়া, কুমিল্লা