হে পিতা, তুমি আমাকে জন্ম দিয়েছো, হে মাতা তুমি আমাকে ১০ মাস গর্ভে ধারন করেছে - কতো কষ্ট করে আমাদের মানুষ করেছো । ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিক্ষক, পাইলট, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী ইত্যাদি বানিয়েছো - আমরা কি পেরেছি তোমাদের বুকে ধরে রাখতে।
বাবা কোটিপতি। সন্তানদের করেছেন প্রতিষ্ঠিত। লিখে দিয়েছেন তাদের নামে বাড়ি--গাড়ি। তারপর একটা সময় বুঝতে পারেন বাবা, সন্তানদের ঘরে তিনি জঞ্জাল হয়ে উঠেছেন। সন্তানরাই তাকে বাসা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। এক পর্যায়ে ধুঁকে ধুঁকে সেই বাবা মারা যান আর সন্তানেরা তার লাশ দাফন করতে অনাগ্রহী হয়ে ওঠেন।
আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া এমন অসংখ্য ঘটনার একটি সত্য গল্প সবার সঙ্গে শেয়ার করেছেন রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ। সোমবার রাত ১০টায় তিনি তার ফেসবুকে এমনই এক মর্মান্তিক ঘটনা ’একটি সত্য ঘটনা’ সবাইকে পড়ার অনুরোধ রইলো শিরোনামে লিখেন।
লোকটির নাম হামিদ সরকার। তিনি সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। গ্রামের বাড়ি জামালপুরে। আমার সাথে তার পরিচয় সূত্রটা পরেই বলছি।
আমি যখন উত্তরায় রিজেন্ট হাসপাতালের প্রথম শাখা উদ্বোধন করি, তখন উত্তরা পশ্চিম থানার তৎকালীন ওসি এবং মসজিদের ইমাম সাহেব আমার কাছে আসেন।তারা বললেন যে, একজন লোক অনেকদিন ধরে মসজিদের বাইরে পড়ে আছে। অনেকে ভিক্ষুক ভেবে তাকে দু - চার টাকা ভিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন।
ইমাম সাহেব তার জন্য প্রেরিত খাবার থেকে কিছু অংশ লোকটিকে দিয়ে আসছেন প্রতিদিন। হঠাৎ লোকটি অসুস্থ হয়ে পড়ায় তারা আমার সরনাপন্ন হয়েছেন। এমতাবস্থায় আমি লোকটিকে আমার হাসপাতালে নিয়ে এসে চিকিৎসার ব্যবস্থা করি এবং দায়িত্বরত ডাক্তার ও অন্যান্য সকল কর্মকর্তা/কর্মচারীকে অবগত করি যে, এই লোকটির চিকিৎসার সকল দায়ভার আমার ও এর চিকিৎসায় যেন কোন ত্রুটি না হয়।
হামিদ সরকার নামক লোকটির সর্ম্পকে খোঁজ নিয়ে আমি রীতিমত অবাক হলাম। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত জোনাল সেটেলম্যান্ট অফিসার। তার তিন ছেলের মধ্যে তিন জনই বিত্তশালী। উত্তরা তিন নম্বর সেক্টরে তার নিজস্ব বাড়ি আছে যা ছেলেদের নামে দিয়েছেন।তার বড় ছেলে ডাক্তার।নিজস্ব ফø্যাটে স্ত্রী, শালী এবং শাশুড়ী নিয়ে থাকেন অথচ বৃদ্ধ বাবার জায়গা নেই।
মেঝ ছেলে ব্যবসায়ী, তারও নিজস্ব বিশাল ফ্ল্যাট আছে। সেখানে প্রায়ই বাইরের ব্যবসায়ীক অতিথীদের নিয়ে পার্টি হয়। অথচ বাবা না খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে। ছোট ছেলেও অবস্থাসমাপন্ন। কিন্তু স্ত্রীর সন্তুষ্টির জন্য বাবাকে নিজস্ব ফ্ল্যাটে রাখতে পারে না । সকল সন্তান সাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও বাবার স্থান হয়েছে শেষে মসজিদের বারান্দায়। সেখান থেকে আমার হাসপাতালে।
প্রসঙ্গত, আমার হাসপাতালে আগত রোগীর ক্ষেত্রে রক্তের প্রয়োজন হলে আমি রক্ত দেবার চেষ্টা করি। সেদিন ও হামিদ সরকার নামক লোকটিকে আমি রক্ত দিয়েছিলাম। অবাক করা বিষয় হলো, তিনি দিন ১৫ আমার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন, অথচ কোন একটা ছেলে ১৫ মিনিটের জন্যও তার খোঁজ নেয়নি।
আরও দুঃখজনক হলো, সর্বোচ্চ চেস্টার পরেও অবশেষে আরো একটা কার্ডিয়াক অ্যাটাকে হামিদ সাহেব মারা যান।তার মৃত্যুও পওে আমি তার বড় ছেলেকে ফোন করি। তিনি আমাকে প্রতি উত্তরে জানান যে, তিনি জরুরি মিটিংয়ে আছেন এবং লাশটি যেন আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম এ দিয়ে দেওয়া হয়।পরে কোন আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে আমি নিজ উদ্যোগে স্থানীয়ভাবে তার লাশ যথাযথ মর্যাদায় দাফন করি।
লেখাটি আমি কোন প্রকার বাহবা নেওয়ার জন্য লিখিনি। আজ আমি নিজেও একজন বাবা। সন্তানের একটু সুখের জন্য দিনরাত একাকার করছি। সেই সন্তান যদি কোনদিন এধরনের আচরন কওে তখন আমার কেমন লাগবে। শুধু এই অনুভ’তি থেকে লেখা।
আমার মনে একটা প্রশ্ন, আমরা যারা বাবা-মাকে অসম্মান, অবহেলা করি তারা কি একবারও ভেবে দেখি যে, একদিন ওই জায়গাটাতে আমরা নিজেরা গিয়ে দাড়াবো।
আজ আমি আমার বাবা মায়ের সাথে যে আচরন করছি, তা যদি সেদিন আমার সন্তান আমার সাথে করে তবে? আজ আমাদের বাবা-মায়েরা সহ্য করছে।