এই বিয়ে এই বিচ্ছেদ

Author Topic: এই বিয়ে এই বিচ্ছেদ  (Read 751 times)

Offline Raihana Zannat

  • Sr. Member
  • ****
  • Posts: 392
  • Test
    • View Profile
এই বিয়ে এই বিচ্ছেদ
« on: July 27, 2017, 09:40:40 AM »
বিবাহবিচ্ছেদ নতুন কোনো ঘটনা নয়। তবে আগে দেখা যেত দাম্পত্য জীবনে পরিবার, সমাজ ও পারিপার্শ্বিক চাপে অনেকেই মেনে নিতেন অনেক কিছু। সেই সময় পাল্টেছে। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, প্রেমের সম্পর্ক থেকে কিংবা সম্বন্ধ করে বিয়ে হওয়ার অল্প কিছুদিন পরই বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন স্বামী-স্ত্রী দুজন। কেন এই প্রবণতা, তা খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।

পরিচিত কয়েকজনের প্রেম, বাগদান ও বিয়ে—সবই হলো খুব ধুমধাম করে। বিয়ের ছবি, মধুচন্দ্রিমার ছবি ফেসবুকের দেয়ালের একটি বড় জায়গা দখল করে রাখল।

 তবে তা বেশি দিন স্থায়ী হলো না। অচিরেই তাঁদের ফেসবুকের স্ট্যাটাস ‘ম্যারেড’ থেকে ফিরে গেল ‘সিঙ্গেল’-এ। আবার কেউ কেউ ‘প্রাইভেসি সেটিংস’ পাল্টে ফেলেছেন। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ফেসবুকের দেয়ালে সাবেক স্বামীর একটি ছবিও পাওয়ার কোনো উপায় নেই।

সম্প্রতি বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে এমন দু-একজনের সঙ্গে কথা হয়। বিয়ে হওয়ার পর এত অল্প সময়ে বিচ্ছেদ বা ডিভোর্সের কারণটি জানতে চাইলাম। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বললেন, বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। তারপর বিয়ে। কিন্তু বিয়ের পর বুঝলাম দুজনের বেশ কিছু জায়গায় বা বিষয়ে অমিল আছে, যেগুলো নিয়ে একসঙ্গে থাকা যায় না। একসঙ্গে থাকা মানে হবে নিজেদের খিটিমিটিকে বাড়িয়ে তোলা। তাই দুজনেই সিদ্ধান্ত নিলাম আলাদা হব।

 উন্নত দেশে প্রবাসী পরিচিত একজনকে দেখলাম ফেসবুকে তালাকের কথা লিখেছেন। সেখানে কোনো রাখঢাক করেননি, স্বামীর অস্তিত্ব মুছে ফেলারও চেষ্টা করেননি।
আইনজীবী, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিদ, মনোরোগ চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তালাকের ক্ষেত্রে বর্তমানে চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন এসেছে। আগে একটা সময় ‘পাছে লোকে কিছু বলে’র ভয়ে দম্পতিরা একজন আরেকজনকে না চাইলেও বা নানা নির্যাতন সহ্য করেও দীর্ঘদিন এক ছাদের নিচে বসবাস করতেন। মেয়ের পরিবারও চাইত না ডিভোর্স হোক। এখন তাতে পরিবর্তন ঘটেছে। তাই বিয়ের স্বল্প সময়ের মধ্যেও অনেকে তালাকের মতো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিচ্ছেন।

 

কিন্তু তালাকই কি একমাত্র সমাধান?
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তথ্য বলছে, বেশ কয়েক বছর ধরেই স্ত্রী বা নারীদের কাছ থেকে তালাকের নোটিশ বেশি আসছে।

ডিসিসির ১০টি অঞ্চলে সালিস পরিষদের মাধ্যমে তালাক কার্যকর করা হচ্ছে।সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানালেন, তালাক নোটিশে স্বামীর সন্দেহবাতিক মনোভাব, পরকীয়া, যৌতুকের দাবি, দেশের বাইরে গিয়ে আর ফিরে না আসা, মাদকাসক্তি, পুরুষত্বহীনতাসহ বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করছেন নারীরা।

অনেকে পশ্চিমা বিশ্ব ও আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব এবং নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গেও বিষয়টিকে মেলানোর চেষ্টা করেছেন। নিজে থেকে তালাক দেওয়ার ক্ষেত্রে দরিদ্র নারীদের থেকে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত নারীরা এগিয়ে আছেন। বিয়েকে ‘দাসত্ব’ হিসেবে মানতে পারছেন না অনেকে।

উত্তর সিটি করপোরেশনের তথ্য বলছে, ২০১১ সালে কার্যকর হওয়া ২ হাজার ৫৬৩টি তালাকের মধ্যে নারী নোটিশ পাঠিয়েছিলেন ১ হাজার ৭৭৩টি। ২০১৫ সালে কার্যকর হওয়া ৩ হাজার ৫৩০টি তালাকের মধ্যে নারীর পাঠানো নোটিশ ছিল ২ হাজার ৭৭৪টি। প্রায় ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই তালাকের নোটিশ পাঠাচ্ছেন স্ত্রীরা।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অঞ্চল ৪-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত তালাকের নোটিশ পাওয়া গেছে ১৯৮টি। এর মধ্যে স্ত্রী নোটিশ দিয়েছেন ১৪২টি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানালেন, পারিবারিকভাবে বিয়ের পর জানতে পারেন স্বামীর সঙ্গে তাঁর এক মামির অনৈতিক সম্পর্ক আছে। তিন মাসের মাথায় তালাক দেন স্বামীকে।

আরেকজন জানালেন, ছেলে লন্ডনে থাকে। ভালো পাত্র। তাই পরিবার বিয়ে দেয়। ছেলেপক্ষ বিয়ের সময় হিরার আংটিসহ ভারী গয়না দেয়। ধুমধাম করে বিয়ে হয়। কিন্তু এ বিয়ে সপ্তাহখানেকও টেকেনি। ছেলের বিরুদ্ধে মেয়ে পুরুষত্বহীনতার অভিযোগ আনেন। তারপর মেয়ের পরিবার দেখতে পায় হিরের আংটিসহ বিয়েতে দেওয়া সব গয়নাই ছিল নকল।

ছেলের কাছেও তালাকের পক্ষে নানান কারণ থাকে। একজন জানালেন, বিয়ের পর মনে হয়েছে বউয়ের ‘হাঁটা’ ভালো না। তাই ছেলেপক্ষ ১ লাখ টাকা দিয়ে মেয়েকে তালাক দিয়েছে। মেয়ের দরিদ্র পরিবার তা মেনে নিয়েছে। যৌতুক না পেয়ে তালাক দেওয়ার ঘটনা ঘটছে অহরহ। স্ত্রীর বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কসহ নানা অভিযোগও থাকে অনেকের ক্ষেত্রে।

সমাজবিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাদেকা হালিম তালাককে নারীর ক্ষমতায়ন হিসেবে না দেখে দেখছেন নারীর আইনি অধিকার হিসেবে। নারী স্বাবলম্বী এবং সচেতন হয়েছেন বলেই এই অধিকারকে কাজে লাগাতে পারছেন। আর বিয়ের পর দ্রুত সময়ে তালাকের সিদ্ধান্তে আসার প্রবণতা বিষয়ে সাদেকা হালিম বলেন, ‘এখন শহুরে, বিশেষ করে উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা বিয়ের আগে থেকেই একজন আরেকজনের সঙ্গে মেলামেশা করছে। তবে বিয়ের আগে সেভাবে কোনো দায়িত্ববোধ থাকে না। বিয়েটা হয়ে যাচ্ছে। বিয়ের পর দাম্পত্য সম্পর্কে যখন দায়িত্ববোধের বিষয় আসে, তখন হয়তো আশাভঙ্গ হয়।’

ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিকভাবে বিয়ে একটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে। সেই মূল্যবোধ ছাড়িয়ে ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে এখন অনেক বেশি। অনেকে নির্যাতন বা দ্বন্দ্বকে টিকিয়ে রাখতে চাইছেন না বলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এতে সন্তান থাকলে তার জন্য এবং নিজের জন্যও ভালো হচ্ছে। কেননা, জীবন তো একটাই। সাদেকা হালিম বর্তমানে এই পরিস্থিতিকে একটি ‘ট্রানজিশন ফেজ’ বলে উল্লেখ করেন।

ছেলে বা মেয়ে যে পক্ষই তালাক দিক, তালাকের হার বাড়ছে তা নিয়ে সবাই একমত। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৩-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা হেমায়েত হোসেন বলেন, চলতি বছরের ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৪৮০টি তালাক কার্যকর হয়েছে। যেখানে ২০১১ সালে এই অঞ্চলে মোট তালাক কার্যকর হয় ৪২১টি।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আইন কর্মকর্তা উপসচিব এস এম মাসুদুল হক বললেন, তালাকের হার বাড়ছে। বাড়ার কারণ নিয়ে গবেষণা না থাকলেও সামাজিক জটিলতা এবং ব্যক্তিত্বের সংঘাত-সমস্যার কারণে সংখ্যাটি বাড়ছে বলেই মনে হচ্ছে। ছেলে মাদকাসক্ত এবং প্রতারণা করে বিয়ে করার কারণে একটি মামলায় স্ত্রী বিয়ের ২০ দিনের মাথায় তালাকের নোটিশ পাঠান। এই কর্মকর্তার মতে, এ ধরনের পরিস্থিতিতে সন্তান হওয়ার আগে জটিলতা কম থাকতেই তালাক একটি সমাধান হিসেবে কাজ করছে। বলা যায়, তালাকটা জরুরি।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে তালাকের নোটিশ পাঠানোর পর তা আপসও হচ্ছে। তবে আপসের সংখ্যাটা কম এমনটা জানা গেল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অঞ্চল ৪-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আতাউর রহমানের কাছ থেকে।

দ্রুত তালাকের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা নিয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক তাজুল ইসলাম বলেলন, তালাকের আগে দুই পরিবার, আত্মীয়, সমাজের লোকজন সবাই চাপ দিতে থাকে এবং কাউন্সেলিং শুরু করে, যা ঠিক নয়। এ ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানী, মনোচিকিৎসকদের কাছ থেকে যিনি তালাক দেবেন, তিনি পরামর্শ নিলে তালাকের হার কমানো সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে পরিবারের সহায়তাও খুব প্রয়োজন। তিনি জানান, তালাক-সংক্রান্ত কারণে বিষণ্নতাসহ বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

যখন কেউ তালাক দিতে চান, তখন কেউ নিজের অবস্থানের বাইরে যেতে চান না। প্রায় ক্ষেত্রেই একজন আরেকজনকে বলেন, অনেক চেষ্টা করেও তাকে পাল্টাতে পারলাম না। একজন আরেকজনকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে থাকেন। এখানে অন্যজনকে পাল্টানো বা নিয়ন্ত্রণ করার কিছু নেই। তাজুল ইসলাম বলেন, ‘মনে রাখতে হবে, একজন মানুষের মধ্যে যেমন কিছু খারাপ দিক থাকে, আবার কিছু ভালো দিকও থাকে। তালাকই একমাত্র সমাধান নয়, সেটি ভাবতে হবে।’

(collected)
Raihana Zannat
Senior Lecturer
Dept. of Software Engineering
Daffodil International University
Dhaka, Bangladesh