আল-আকসার কান্না

Author Topic: আল-আকসার কান্না  (Read 1213 times)

Offline Md. Monir Hossain

  • Newbie
  • *
  • Posts: 22
  • Test
    • View Profile
আল-আকসার কান্না
« on: August 09, 2017, 06:05:15 PM »


জেরুসালেম! অগণিত নবী-রাসূলের স্মৃতিধন্য পুণ্যভূমি। এই শহরেই রয়েছে মুসলমানদের প্রথম কিবলা মসজিদুল আল-আকসা। ১৬ মাস যাকে কিবলা ধরে নামাজ আদায় করা হয়েছিল। প্রিয় নবী সা:-এর পবিত্র মেরাজ বেহেশতি বাহন বোরাকে চড়ে শুরু হয়েছিল এখান থেকেই।

পবিত্র আল-কুরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাতেরবেলা ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত- যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল’ (সূরা আল ইসরা : ১)।

এখানে মসজিদে আকসার চারদিক বলতে জেরুসালেম শহরকেই বোঝানো হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আল কুদসের (জেরুসালেম) এমন কোনো জায়গা খালি নেই যেখানে একজন নবী সালাত আদায় করেননি বা কোনো ফেরেশতা দাঁড়াননি’ (তিরমিজি)। এর আগে নাম ছিল বায়তুল মোকাদ্দাস। রাসূল সা:-এর যুগ থেকেই এর নামকরণ করা হয় মসজিদুল আল-আকসা। মুসলমানদের কাছে জেরুসালেম শহরটি আল-কুদস নামেও পরিচিত।

যে তিনটি মসজিদের উদ্দেশে ইবাদতের নিয়তে সফরের অনুমতি আছে, তার মধ্যে একটি হলো আল-আকসা মসজিদ। বাকি দু’টি হলো- মসজিদে হারাম (মক্কা) ও মসজিদে নববী (মদিনা), (বুখারি ১১৮৯; মুসলিম : ১৩৯৭)।

এর গুরুত্ব সম্পর্কে মহানবী সা: বলেছেন, ‘ঘরে নামাজ পড়লে এক গুণ, মসজিদে ২৫ গুণ, মসজিদে নববী ও আকসায় ৫০ হাজার গুণ, মসজিদে হারামে এক লাখ গুণ সওয়াব’ (ইবনে মাজাহ)। মহানবী সা: মদিনায় হিজরত করার পর প্রায় ১৬ মাস মসজিদুল আকসার দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন।

হিজরি দ্বিতীয় সনের শাবান মাসে মতান্তরে রজব মাসের মাঝামাঝি মহানবী সা: কিছু সাহাবায়ে কেরামসহ মদিনার অদূরে মসজিদে বনু সালামায় জোহর মতান্তরে আসর নামাজ আদায় করেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় রাকাতের মাঝামাঝি আল্লাহর নির্দেশে মহানবী সা: ও সাহাবায়ে কেরাম চাররাকাত বিশিষ্ট নামাজের দুই রাকাত কাবা শরিফের দিকে ফিরে আদায় করেছিলেন বলে ইসলামের ইতিহাসে মসজিদটি মসজিদে কিবলাতাইন বা দুই কিবলা হিসেবে সুপরিচিত ও সমাদৃত।

অনেকে মনে করেন, হজরত সোলাইমান আ: মসজিদে আকসা তৈরি করেছেন, অথচ এটি সম্পূর্ণ ভুুল। ইব্রাহিম আ:-ই প্রথম আল-আকসা তৈরি করেন। ইব্রাহিম আ: যেমন কাবার প্রতিষ্ঠাতা নন, ঠিক তেমনি সোলাইমান আ:ও মসজিদে আকসার প্রতিষ্ঠাতা নন, বরং উভয়েই পুনঃনির্মাণকারী। কাবার মূল প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন হজরত আদম আ:। আর আল-আকসার মূল প্রতিষ্ঠাতা হলেন হজরত ইব্রাহিম আ:।

একটি হাদিস থেকে জানা যায়-
হজরত আবুজর গিফারি রা: থেকে বর্ণিত, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রশ্ন করি, জমিনে প্রথম কোন মসজিদ তৈরি হয়েছিল’? তিনি উত্তরে বলেন, ‘মসজিদে হারাম’। ‘আমি জিজ্ঞেস করি তারপর কোনটি’? তিনি বলেন, ‘মসজিদে আকসা’। আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করি, এ দুটোর মধ্যে সময়ের ব্যবধান কত’? তিনি বলেন, ‘৪০ বছর’ (বুখারি, মুসলিম)। ইব্রাহিম আ: ও সুলাইমান আ:-এর সময়ের ব্যবধান হচ্ছে এক হাজার বছর এবং উপরের সহিহ হাদিসে বলাই হয়েছে- কাবার ৪০ বছর পর আল-আকসা তৈরি হয়েছে।

ইবনুল জাওজি রহ: বলেন, এই হাদিসে মসজিদে আকসার প্রথম ভিত্তির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। ইব্রাহিম আ:-এর পর তার ছেলে ইসমাইল আ: ও ইসহাক আ:, তারপরে ইসহাক আ:-এর ছেলে ইয়াকুব আ:। যার উপাধি ছিল ইসরাইল। তার বংশধরদের বনু ইসরাইল বলা হয়। তারপর ইয়াকুব আ:-এর ছেলে ইউসুফ আ:, তারপর মূসা আ:, তারপর ইউশা বিন নূন আ:, তারপর দাউদ আ: এবং তারপর দাউদ আ:-এর ছেলে সোলাইমান আ: দুনিয়াতে আগমন করেন। তিনিই মসজিদে আকসা পুনঃনির্মাণ করেন। এই মসজিদ নির্মাণে ৩০ হাজার শ্রমিকের সাত বছর সময় লেগেছিল।

ইবনে তাইমিয়া রহ: বলেন, ‘হজরত ইব্রাহিম আ:-এর যুগেই মসজিদে আল-আকসা তৈরি হয়েছিল। হজরত সোলাইমান আ: তা বড় ও মজবুত করে তৈরি করেন’ (মাজমুউল ফাতাওয়া ১৭ খণ্ড, ৩৫১ পৃ.)।

মসজিদে আকসা থেকে ৫০০ মিটার দক্ষিণে অবস্থিত কুব্বাতুস সাখরা, যা ৬৯১ সালে উমাইয়া খলিফা আবদুুল মালিক কাবা শরিফের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মহানবী সা: যে জায়গা থেকে মেরাজে গমন করেছিলেন (বায়তুল মোকাদ্দাস সংলগ্ন), সে জায়গা তৈরি করেছেন এবং মুসলমাদেরকে আগামী বছর থেকে কাবার পরিবর্তে এখানে হজ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ৬৯২ সালে খলিফা আবদুুল মালিকের প্রাদেশিক শাসক হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে আরাফাতের যুদ্ধে তৎকালীন মক্কা-মদিনার শাসক আবদুল্লাহ বিন জোবায়ের পরাজিত ও নিহত হওয়ায় মক্কা-মদিনা আবদুুল মালিকের অধীনে চলে যায়। তাই এখানে হজ করার আদেশটি বহাল রাখার প্রয়োজন হয়নি। কুব্বাতুস সাখরা চুনাপাথরে নির্মিত ইমারত। বাইরের দিক অষ্টভুজবিশিষ্ট।

কিন্তু অভ্যন্তরে চতুর্দিক বৃত্তাকার করে সাজানো স্তম্ভের সমষ্টি। এতে স্তম্ভের সংখ্যা ১৬টি। বাইরের অষ্টভুজের এক দেয়ালের দৈর্ঘ্য ৬৭.৫ ফুট, উচ্চতা ২৯.৫ ফুট, প্রত্যেক দেয়ালে সাতটি করে জানালা আছে মনে হয়, কিন্তু জানালা পাঁচটি; আর বাকি দু’টি বন্ধ প্যানেল। গম্বুজের পিপার নিম্নাশ থেকে একটি ঢালু ছাদ বাইরে অষ্টভুজ দেয়ালের ওপর মিলিত হয়েছে। কুব্বাতুস সাখরার চারদিকে চারটি তোরণ আছে। এর অলঙ্করণ অপরূপ, তবে একাদশ শতাব্দী থেকে ফাতেমিয়, মামলুক, উসমানিয় তুর্কি, ব্রিটিশ এবং আরব শাসকেরা বিভিন্ন সময়ে সংস্কারের কারণে প্রাচীন অলঙ্করণ খুব কমই আজ বিদ্যমান।

অনেকেই এই কুব্বাতুস সাখরাকেই আল-আকসা মসজিদ বলে ভুল করে থাকেন। বাস্তবে এ দুটির অবস্থান ও গুরুত্ব আলাদা। ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে হজরত ওমর রা:-এর শাসনামলে আবু উবায়দা ইবনে জাররাহ রা:-এর নেতৃত্বে মুসলমানরা আল কুদস তথা জেরুসালেম জয় করেন।

১০৯৯ সালের ১৫ জুলাই খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা নামধারী মুসলিম শাসকদের সহায়তায় সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করে। এরপর তারা ১০৯৯ সালের ৭ জুন বাইতুল মোকাদ্দাস অবরোধ করে এবং ১৫ জুলাই মসজিদের ভেতর প্রবেশ করে ব্যাপক পরিবর্তন করে একে গির্জায় পরিণত করে। ক্রুসেডাররা চালায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, মুসলমানের রক্তে প্লাবিত হয়েছিল পবিত্র আল-কুদস। এভাবেই কুদসে ৪৬২ বছরের মুসলিম শাসনের পতন ঘটে।

এরপর দীর্ঘ প্রতীক্ষা, গোলামির জিঞ্জির ভেঙে, জিল্লতির জীবন ছেড়ে মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য মুসলিম মিল্লাত অপেক্ষা করছিল একজন মুক্তিদূতের। ১১৬৯ সালের ২৩ মার্চ। ফাতেমি খিলাফতের কেন্দ্রীয় খলিফার নির্দেশে সালাহউদ্দিন আইয়ুবি রহ: গভর্নর ও সেনাপ্রধান হয়ে মিসরে আগমন করেন। এরপর ১১৮৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর হিত্তিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলিম বীর সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি রহ: জেরুসালেম শহর মুসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন। তারপর ১১৮৭ সালের ২ অক্টোবর শুক্রবার সালাহউদ্দিন আইয়ুবি রহ: বিজয়ীর বেশে বাইতুল মোকাদ্দাসে প্রবেশ করেন।

বাইতুল মোকাদ্দাস মুক্ত হওয়ায় সেখানকার মুসলিমরা প্রায় ৯০ বছর পর ক্রুসেডারদের অত্যাচার থেকে রেহাই পেয়েছিল। আল-আকসায় উড়ল কালেমাখচিত হিলালি নিশান।

১৯৪৮ সালে বিশ্ব মোড়লদের চক্রান্তে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া অভিশপ্ত ইসরাইল নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ১৯৬৭ সালে জুন মাসে মাত্র ছয় দিনের যুদ্ধে মিসর, সিরিয়া, জর্ডান ও ইরাক এই চারটি আরব রাজ্যের প্রতিরোধ ব্যূহ ধ্বংস করে ইসরাইল পূর্ব আল-কুদস, পশ্চিমতীর, গাজা ও গোলান মালভূমি দখল করে নেয়। দীর্ঘ ৭৮০ বছর পর আবারো পবিত্র আল-আকসা থেকে হিলালি নিশান খসে পড়ে। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি রহ:-এর আমানত হাতছাড়া হয়।

তারপর থেকে বিগত অর্ধশতাব্দী ধরে আল-আকসা কাঁদছে আর বিলাপ করে বলছে, ‘আমি আল-আকসা! মুসলমানদের প্রথম কিবলা। মিল্লাতের পিতা ইব্রাহিমের সুনিপুণ হাতে বানানো ইবাদতগৃহ। জায়নবাদীদের হাতে বন্দী হয়ে একজন সালাহউদ্দিন আইয়ুবির জন্য বিগত ৫০ বছর ধরে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছি, কিন্তু মুসলমানদের নেতৃত্ব আজ ঘুণেধরা। ক্ষমতালিপ্সা, অর্থের লোভ আর নারীর অন্ধ মোহে বুঁদ হয়ে আছে তার বড় একটি অংশ। মিল্লাতের পিতা ইব্রাহিম! তোমার সন্তানেরা সংখ্যায় বিপুল, ১৫০ কোটির উপরে। কিন্তু তারা আজ অথর্ব, মেরুদণ্ডহীন। কেননা তারা ভুলে গেছে দ্বীনের জন্য তোমার ত্যাগের শিক্ষা, শুধু আনুষ্ঠানিকতাকেই তারা ইবাদত মনে করে। কয়েক লাখ ইহুদির দখল থেকে মুক্ত করতে পারছে না পবিত্র আল-আকসা। এ জাতির উত্তরণে আবারো একজন গাজী সালাহউদ্দিন আইয়ুবির প্রয়োজন, যিনি চারিত্রিক মাধুর্য, অসীম সাহসীকতা, দূরদৃষ্টি ও বাঘের ক্ষিপ্রতা দিয়ে অভিশপ্ত ইহুদিদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনবেন পবিত্র আল-আকসা, সূচিত হবে ইসলামের বিজয়। কে হবে সেই মুক্তিদূত?’

Source : http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/241159