ড. কুদরাত- ই- খুদা বাবু | প্রকাশ : ২৭ আগস্ট, ২০১৭[/b]
বাংলাদেশ কি ‘ধর্ষণের দেশ’ হতে চলেছে?
সংবাদপত্রের পাতা খুললে প্রায় প্রতিদিনই চোখে পড়ে ধর্ষণ সংক্রান্ত খবর। এসব খবর পড়তে পড়তে মানুষ যেন আজ রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠেছেন। এ দেশে ধর্ষণের হাত থেকে প্রাপ্তবয়স্ক নারী, গৃহবধূ, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থেকে শুরু করে পাঁচ বছরের কোমলমতি মেয়েশিশু পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করার ঘটনা তো সমাজে অহরহই ঘটে চলেছে। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে সমাজ ও মান-সম্মানের ভয়ে তা কাউকে জানান না। তখন বিষয়টি লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়। আবার অনেক সময় এও দেখা যায়, ধর্ষণের ঘটনা ধর্ষক বা তার সহযোগী কর্তৃক ভিডিও আকারে ধারণ করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে কিংবা ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়ার ভয়-ভীতি দেখিয়ে ওই মেয়েকে পুনরায় ধর্ষণ করা হচ্ছে অথবা তার কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নেয়া হচ্ছে। কোনো নারী যখন ধর্ষণের শিকার হন, তখন তার মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে, তা কি সবার ভেবে দেখা উচিত নয়? পাশাপাশি ওই মেয়েটিকে বা ওই মেয়েটির পরিবারকে আমাদের ‘সমাজ’-ই বা কোন চোখে দেখে থাকে, তা কি আমরা ভেবে দেখি? আমরা কি ভেবে দেখেছি, একজন মেয়ে যখন ধর্ষণের শিকার হন, তখন তার সারা জীবনের লালিত স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ধর্ষণের ওই ঘটনা তাকে সারাক্ষণ তাড়া করে বেড়ানোর ফলে তার মানসিক শান্তি থাকে না। থাকে না ভালোভাবে বাঁচার স্বপ্ন এবং শেষ পর্যন্ত তার আত্মবিশ্বাসটুকুও দিনে দিনে লোপ পেতে থাকে। সর্বোপরি ধর্ষণের শিকার মেয়েটি মানসিকভাবে এমন অশান্তি এবং যন্ত্রণাময় জীবন অতিবাহিত করেন যে, তিনি যেন জীবিত থেকেও মৃত। আবার অনেক সময় অনেক মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে বাধ্য হন। অনেক সময় দেখা যায়, ধর্ষণের মতো ফৌজদারি অপরাধ, ন্যক্কারজনক ও জঘন্য ঘটনা ঘটলেও ধর্ষিতা কিংবা তার পরিবার ন্যায়বিচারটুকু পর্যন্ত পাচ্ছেন না। একটি স্বাধীন, সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে এর চেয়ে বড় লজ্জার, দুঃখের ও আশ্চর্যের বিষয় আর কী হতে পারে? গত ৮ জানুয়ারি বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে গত বছর (২০১৬) এক হাজারেরও বেশি নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে তিনশ’র বেশি শিশু। আর ধর্ষণের এই সংখ্যা যে চলতি বছরে অনেক বেশি হবে, তা বলাইবাহুল্য। ধর্ষণের ধারাবাহিক ঘটনা নিঃসন্দেহে দেশের সবার জন্যই উদ্বেগজনক একটি বিষয় এবং তা সবার সামনে একটি দুর্বল আইন ও সমাজব্যবস্থারই প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। ধর্ষণের ঘটনার ফলশ্রুতিতে বিশ্ব দরবারেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে মারাত্মকভাবে। দেশে প্রতিদিন যেভাবে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চলেছে তাতে স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশ কি ‘ধর্ষণের দেশ’ হতে চলেছে? বলার অপেক্ষা রাখে না, যে কোনো সমাজে ধর্ষণ বিস্তৃত হলে এবং ধর্ষকদের সাজার ব্যবস্থা করা না হলে সেই সমাজে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বলে কিছুই থাকে না। এ ধরনের ঘটনা সমগ্র সমাজ, দেশ ও জাতিকে বিশৃঙ্খলা ও পাপাচারের দিকে ধাবিত করে- যা কখনই ভালো কোনো বিষয় হতে পারে না।
যেভাবেই ধর্ষণ সংঘটিত হোক না কেন, তা এক প্রকার যৌন অত্যাচার এবং এটি একটি গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ বটে। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারা মোতাবেক, যদি কোনো ব্যক্তি নিন্মোক্ত পাঁচ প্রকারের যে কোনো অবস্থায় কোনো নারীর সঙ্গে যৌন সহবাস করে, তবে উক্ত ব্যক্তি ধর্ষণ করেছে বলে গণ্য হবে। প্রথমত, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে; দ্বিতীয়ত, তার সম্মতি ব্যতিরেকে; তৃতীয়ত, তার সম্মতিক্রমে, যে ক্ষেত্রে তাকে মৃত্যু বা আঘাতের ভয় প্রদর্শন করে তার সম্মতি আদায় করা হয়; চতুর্থত, তার সম্মতিক্রমে, যে ক্ষেত্রে লোকটি জানে যে, সে তার স্বামী নয় এবং নারীটি এ বিশ্বাসে সম্মতিদান করে যে, পুরুষটির সঙ্গে সে আইনানুগভাবে বিবাহিত অথবা সে নিজেকে আইনানুগভাবে বিবাহিত বলে বিশ্বাস করে এবং পঞ্চমত, তার সম্মতিক্রমে বা ব্যতিরেকে, যে ক্ষেত্রে সে ১৪ বছরের কম বয়স্ক হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯ ধারা অনুযায়ী, ধর্ষণের অপরাধে যেসব শাস্তির বিধান রয়েছে, তা হল- ধর্ষণের ফলে কোনো নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে ধর্ষণকারীর জন্য রয়েছে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত কমপক্ষে এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড। একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে ধর্ষণকালে বা ধর্ষণের পর যদি তার মৃত্যু ঘটে, তবে উক্ত দলের সবার জন্যই এ শাস্তি প্রযোজ্য হবে। ধর্ষণের চেষ্টা করলে ধর্ষণকারীর সর্বোচ্চ দশ বছর এবং সর্বনিন্ম পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেরও বিধান রয়েছে। কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানো বা আহত করার চেষ্টা করলে ধর্ষণকারী যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। বিচারক সাধারণত শাস্তির পরিমাণ নির্ধারণ করেন অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে। মামলার বিষয়বস্তু (ধর্ষণের শিকার নারীর জবানবন্দি, ডাক্তারি পরীক্ষার ফলাফল এবং অন্যান্য সাক্ষ্য) পর্যালোচনা করে নিজস্ব বিচার-বিবেচনার ভিত্তিতে বিচারক রায় দেন এবং অপরাধীর শাস্তি নির্ধারণ করেন। তবে ধর্ষণের ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার নারীর উচিত হবে ঘটনাটি দ্রুত কাছের কাউকে জানানো। ধর্ষণ প্রমাণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ধর্ষণের শিকার নারীর শরীর। এ জন্য ধর্ষণের ঘটনার পর যে অবস্থায় আছে, তেমনি থাকা প্রয়োজন। নিজেকে পরিষ্কার বা গোসল করা এ ক্ষেত্রে কোনোভাবেই ঠিক হবে না। ডাক্তারি পরীক্ষার দ্বারা নারীর শরীর থেকে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য-প্রমাণাদি এবং আলামত সংগ্রহ করা যায়, যা ধর্ষণের ঘটনাকে প্রমাণ ও ধর্ষণকারীকে চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। ঘটনার সময় যে কাপড় শরীরে ছিল, তা অবশ্যই সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। মামলায় এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে কাজ করে। আর এ ক্ষেত্রে দ্রুত থানায় অভিযোগ দায়ের কিংবা আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে। যত দ্রুত অভিযোগ দায়ের করা যায়, ততই মঙ্গল। কারণ ধর্ষণের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ডাক্তারি পরীক্ষা না করালে এর প্রমাণ তেমন একটা পাওয়া যায় না। তবে থানায় অভিযোগ দায়ের করে কিংবা আদালতে মামলা করে বিচার পাওয়ার চেয়ে সমাজে যেন ধর্ষণের ঘটনা না ঘটে, সে ব্যবস্থা করা অধিকতর মঙ্গলজনক। কারণ Prevention is better than cure (প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম)। সমাজে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সম্মিলিত কণ্ঠে প্রতিবাদ হওয়াটা খুবই জরুরি। ধর্ষকরা অনেক সময় শাস্তি পায় না বলে পরবর্তীকালে স্পর্ধা পেয়ে যায় এবং বীরদর্পে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটায়। এটা দেখে অন্যরাও একই কাণ্ড করতে উৎসাহিত হয়। এভাবে সমাজ, দেশ ও জাতি কলুষিত হয়। প্রতিটি পরিবার থেকে প্রতিটি শিশুকে ছোটবেলা থেকেই নৈতিক শিক্ষা প্রদান করা প্রয়োজন। কারণ পরিবারই শিশুর আচরণ, মূল্যবোধ, নৈতিকতা ইত্যাদির ভিত্তি তৈরি করে দেয়। এর পাশাপাশি ধর্ষণ রোধে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজসহ সবার একযোগে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। প্রয়োজন ধর্ষণকে যে কোনো মূল্যে প্রতিহত করা। এ ক্ষেত্রে সবাইকে মনে রাখতে হবে, আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্ষণ যেমন একটি বড় ধরনের ফৌজদারি অপরাধ, তেমনি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও তা বড় ধরনের পাপ। আবার সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেও ধর্ষণকে অত্যন্ত ঘৃণ্য, নিন্দনীয় ও খারাপ প্রকৃতির কাজ হিসেবে দেখা হয়। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, যে সমাজে নারীরা বেশি মাত্রায় ধর্ষণের শিকার হন, সেই সমাজের নারীরা দেশ-জাতির উন্নয়নে স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন না। অথচ নারীদের পশ্চাতে রেখে একটি দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি সম্ভব নয়। তাই সমাজ, দেশ ও জাতির উন্নয়ন, অগ্রগতিসহ সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে এবং একটি সুখী, সুন্দর দেশ ও জাতি গঠনে ধর্ষণকে কঠোর হস্তে দমন করা অপরিহার্য।
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক; বর্তমানে ফিলিপাইনের লাইসিয়াম অব দ্য ফিলিপাইন্স ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কর্মরত
kekbabu@yahoo.com
http://www.jugantor.com/window/2017/08/27/151374/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6-%E0%A6%95%E0%A6%BF-%E2%80%98%E0%A6%A7%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%A3%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E2%80%99-%E0%A6%B9%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%9A%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%9B%E0%A7%87?