আজকাল কয়টা বাংলা নাটক/সিনেমা ১ ঘন্টা ধরে রেখে দারুণভাবে সমাপ্তি টানতে পারে? শাফায়াত মনসুর রানার বেশ প্রশংসিত নাটক "আমরা ফিরব কবে?" দেখে তাই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললাম। সমসাময়িকতার মাঝেও আধুনিক পরিচ্ছন্ন নির্মাণে বক্তব্য উপস্থাপন থাকতেই পারে, তবে সেটাকে পরিশীলিতভাবে লেখা এবং পরিবেশনাতেই যত মুনশিয়ানা।
কাহিনিঃ লম্বা একটা সাপ্তাহিক ছুটিতে বাবা ঠিক করলেন তার ৪ ছেলেমেয়েকে ডাকবেন। বহুদিন সবাই একত্র হয়না, দেখাও হবে, মজা হবে। কিন্তু যান্ত্রিক এই সময়ে সবাই নিজ নিজ পরিবার, চাকরী ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। তবু বাবার কথা ফেলতে পারেনা কেউই। চলে আসে বাগানবাড়িতে। কিন্তু এসেই বিপত্তি। হায় হায় এখানে তো ওয়াইফাই নেই। ছুটি কাটাতে এসেও ফেসবুকে চেক-ইন, ছবি আপলোড, ই-মেইল সবকিছু সানন্দে করতে না পারার কথা চিন্তাই করা যায়না। অনুযোগটা যখন বাবার কানে এল, তখন হল আরেক বিপত্তি। এবার আর রেহাই নেই।
ছেলে চরিত্রে ওমর আয়াজ অনি, সুদীপ বিশ্বাস, মেয়ে চরিত্রে অপর্ণা ঘোষ, বউ চরিত্রে স্বাগতা আর নতুন মুখ সিফাত শাহ্রিন এবং জামাই চরিত্রে জন কবীর ছিলেন উল্লেখযোগ্য। এদের নিজেদের দাম্পত্য জীবন টিপিকাল মনে হলেও মূল হাসির খোরাক এই নাটকে। বিশেষ করে, জন কবীরকে প্রথমবার সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা চরিত্র যা তার জন্য দারুণ চ্যালেঞ্জিং, কারণ এটা একজন চামার ব্যবসায়ীর চরিত্র, যে শ্বশুরের টাকায় ব্যবসা করে বলে সারাদিন শ্বশুরের পায়ে পড়ে থাকে। সহজ কোথায় ধান্দাবাজ! তার স্ত্রীর চরিত্রে অপর্ণা টিপিকাল বড় মেয়ে, একটু eccentric, তবে দারুণ মানানসই। আয়াজ অনি পরিবারের বড় ছেলে, যে দায়িত্ব আর নিজের কাজের মাঝে স্যান্ডউইচ পুরা। তার স্ত্রী স্বাগতা সাপরটিভ একজন বউ, যার ঠিক উল্টাটা ছোট ছেলে সুদীপের বউ সিফাত - স্বার্থপর ডোমিনেটিং বউদের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
এসকল চরিত্রকে ঠিকমত তৈরি করা, তাদের মধ্যকার রসায়ন দেখিয়েও সংলাপে যথাসম্ভব বাস্তবিকতা রাখা, আবার কমেডি আমেজ রাখা = বেশ কঠিন কাজ মনে হয় বাংলাদেশী নাট্যকারদের জন্য। সুখের বিষয় - কিছুটা শেকি অভিনয় হলেও চিত্রনাট্যগুণে গল্পটা ঠিকমত বলতে ৮০ ভাগ সফল হয়েছেন রানা।
যতদূর জানি, আয়াজ অনি ছাড়া এখানে কেউই মঞ্চের লোক না, তাই সংলাপ যত ভালোই হোক, ডেলিভারি শ্রুতিমধুর হবেনা সবার। বিশেষ করে জন কবীর পুরাটা সময়েই সংগ্রাম করেছেন উচ্চারণ আর ভাবভঙ্গির দিক থেকে। শুরুতে খারাপ লাগলেও গ্র্যাজুয়ালি সেটাও সয়ে যায় তার নিষ্ঠার কারণে। আমি জন ভাইর গানের বিশাল ভক্ত হলেও তার অভিনয়ের সীমাবদ্ধতা ভালমতোই জানি। তবু তার হাল না ছেড়ে এরকম চ্যালেঞ্জিং রোল অ্যাপ্রচ করাকে বাহবা না দিয়ে পারিনা। বিশেষ করে এই শাফায়াত মনসুর রানাই যেন পারেন জনের সেরাটা বের করে আনতে। এরপর আমার পছন্দের অভিনেত্রী স্বাগতা - যদিও অতটা ভরপুর রোল পাননি তিনি বাকি ২ অভিনেত্রীর মত। তবু তার উপস্থিতি আরামদায়ক। সবচেয়ে নজরকাড়া ছিলেন নবাগতা সিফাত শাহ্রিন। দেখে বারবার ইলোরা গওহরের মেয়ে মনে হচ্ছিল এত মিল চেহারায়। অভিনয় বেশ ভালো।
প্রবীণ অভিনেতা সৈয়দ হাসান ঈমাম বাবা চরিত্রে সহজাতভাবেই আদুর এবং শক্তিশালী। দিলারা জামান টিপিকাল লাভিং মা চরিত্রে শান্তিময়।
কারিগরি দিকে আবহ সংগীত, কালার গ্রেডিং, চিত্রগ্রহণ খুবই চমৎকার। যদিও প্রথম ভাগে কোন কোন জায়গায় সম্পাদনায় ২-৪টা গলদ রয়েছে - খুবই নগণ্য।
অনেকটা হোমকামিং ধাঁচের গল্প নিয়ে পারিবারিক ড্রামা ঘরানার নাটকটিতে হাস্যরসগুলাও সিচুএশানাল, কাতুকুতু টাইপ কিছু নেই। নতুনদের দিয়ে কাজ উদ্ধার সবাই পারেনা। সাথে কাহিনী, চিত্রনাট্য - ৩টা বিভাগেই প্রায় সফল রানা।
মনে রাখার মত কোন সংলাপ না থাকলেও ভালো গলপবলিয়ে, চিত্রগ্রহণ আর চরিত্রায়নের জন্য "আমরা ফিরব কবে" চমৎকার একটা নাটক হয়েই স্থান পাবে ঈদের সেরা কাজগুলার একটায়। তবে এখনও স্ক্রিপ্ট লেভেলে আরও সৃষ্টিশীলতা আশা করি।
রেটিংঃ ১০ এ ৭.২৫।
link: