ব্যাংক হিসাব তলবের ক্ষমতা পাচ্ছে এসইসি
পুঁজিবাজারে কারসাজি বা অনৈতিক কর্মকান্ড তদন্তের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব তলবের ক্ষমতা পাচ্ছে সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)।
শেয়ার লেনদেনে ব্যবহৃত অর্থের উৎস জানার জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা বীমা কোম্পানির কাছ থেকে সরাসরি আর্থিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে এসইসি। ১৯৬৯ সালের সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশের সংশ্লিষ্ট ধারা সংশোধন করে কমিশনকে এই ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে।
অধ্যাদেশ সংশোধনের লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ একটি খসড়া তৈরি করেছে। এসইসির মাধ্যমে বাজার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের মতামত গ্রহণের পর চূড়ান্ত প্রস্তাব তৈরি করে জাতীয় সংসদে উত্থাপনের জন্য পাঠানো হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এসইসির ক্ষমতা বৃদ্ধির এই উদ্যোগ সম্পর্কে মতামত জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবং এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারে বিধি বহির্ভুত তৎপরতা রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হলে এসইসিকে অবশ্যই ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সরাসরি তথ্য সংগ্রহের ক্ষমতা দিতে হবে। এই ক্ষমতা না থাকায় বর্তমানে কমিশনের তদন্ত কার্যক্রমে দূর্বলতা থেকে যায়। ব্যাংক লেনদেনের তথ্য প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে তা সংগ্রহ করতে হয়। প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে তদন্তকারীরা এভাবে তথ্য সংগ্রহে উৎসাহিত নাও হতে পারেন। সরাসরি সংগ্রহের ক্ষমতা দেয়া হলে তদন্ত কাজের জন্য যখন যে তথ্য প্রয়োজন তা সংগ্রহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘কর ফাঁকি বা আর্থিক বিষয়াদি তদন্তের প্রয়োজনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যদি সরাসরি ব্যাংক হিসাব তলব করতে পারে, তাহলে এসইসিকে কেন সেই ক্ষমতা দেয়া হবে না? আমি মনে করে, এসইসিকে কার্যকর নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে ব্যাংক হিসাবের তথ্য তলবের ক্ষমতা দিতে হবে।’
সূত্র জানায়, ব্যাংক হিসাব তলবের ক্ষমতা ছাড়াও কারসাজি বা অনৈতিক কর্মকা- প্রমাণিত হলে অভিযুক্তদের কাছ আদায়কৃত জরিমানার অর্থ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে প্রদানের ব্যবস্থা রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া জরিমানা সংক্রান্ত বিষয়ে এসইসির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে আপিল করতে হলে নির্ধারিত পরিমান অর্থ জমা রাখার বিধান করা হচ্ছে। পাশাপাশি তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা বা অন্য কোনও কারণে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার লেনদেন স্থগিত রাখার সময়সীমা বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতে ভবিষ্যতে পুঁজিবাজারে কারসাজি ও অনৈতিক তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পুঁজিবাজার তদন্ত কমিটির সুপারিশ ছাড়াই সরকারের নিজস্ব পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বিদ্যমান আইনের সংশোধন এবং প্রয়োজনে নতুন বিধি প্রণয়ন করা হবে। বিনিয়োগকারীদের পুঁজির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এসইসির ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রতি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
সূত্র জানায়, সংস্কার কার্যক্রমের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে পুঁজিবাজার সবচেয়ে মৌলিক আইন হিসেবে পরিচিত সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ, ১৯৬৯ এবং সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইন, ১৯৯৩ সংশোধন করে এসইসির ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে। ইতোমধ্যেই ১৯৬৯ সালের অধ্যাদেশের সংশোধনের লক্ষ্যে একটি খসড়া প্রণয়ন করে এসইসিতে পাঠানো হয়েছে। এসইসি ওই খসড়ার উপর বাজার সংশ্লিষ্টদের মতামত গ্রহণের পর প্রয়োজনীয় সুপারিশসহ অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। এর ভিত্তিতে সংশোধনী চূড়ান্ত করে জাতীয় সংসদে পাঠানো হবে।
ব্যাংক হিসাব তলবের ক্ষমতা
১৯৬৯ সালের অধ্যাদেশের ২১(২) ধারা অনুযায়ী বর্তমানে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট যে কোনও বিষয়ে তদন্ত পরিচালনার স্বার্থে এসইসি স্টক এক্সচেঞ্জের যে কোন সদস্য এবং ইস্যুয়ার কোম্পানির পরিচালক, ব্যবস্থাপক বা অন্য কর্মকর্তার কাছ থেকে যে কোন তথ্য সংগ্রহের ক্ষমতা রাখে। এর ফলে তদন্তকারী কর্মকর্তা শুধু অভিযুক্ত ব্যক্তির বিও হিসাবের মাধ্যমে শেয়ার লেনদেন বা শেয়ারের মূল্য পরিশোধের তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। কিন্তু শেয়ার লেনদেনে ব্যবহৃত অর্থের উৎস কিংবা শেয়ার বিক্রি করে অর্জিত অর্থ হস্তান্তরের তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। এর ফলে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বেনামে শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে কারসাজিতে লিপ্ত হলে তা চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
এ কারণে অধ্যাদেশের সংশ্লিষ্ট ধারা সংশোধন করে এসইসির তদন্তকারী কর্মকর্তাকে যে কোন বাণিজ্যিক ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বীমা কোম্পানি বা অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে লেনদেনের সম্পর্ক থাকতে পারে এমন যে কোন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সরাসরি আর্থিক লেনদেনের তথ্য তলবের ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে শেয়ারবাজারে সব ধরনের আর্থিক কারসাজি চিহ্নিত করা সম্ভব হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
জরিমানার টাকায় ক্ষতিপূরণ
অর্থ মন্ত্রনালয় প্রণীত খসড়ায় তদন্তের মধ্য দিয়ে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পর অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আদায়কৃত জরিমানা থেকে সংশ্লিষ্ট ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। খসড়ায় এ সংক্রান্ত একটি ধারা সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত ওই ধারা অনুযায়ী, বিধি বহির্ভুত কর্মকা- প্রমাণের পর এসইসি কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করলে ওই অর্থ থেকে সর্বপ্রথম তদন্ত কাজের সামগ্রিক ব্যয় নির্বাহ করা হবে। দ্বিতীয়ত, বিধি বহির্ভুত কর্মকা-ের ফলে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে প্রমাণিত হলে জরিমানার অর্থ থেকে তাদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হবে। এক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির অভিযোগের ভিত্তিতে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সময়কালে শেয়ারের বাজার মূল্যের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে।
তবে কমিশনের বিবেচনায় সংঘটিত অপরাধটি শুধুমাত্র প্রশাসনিক বা বিধিগত হলে কিংবা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের চিহ্নিত করা অসম্ভব হলে ক্ষতিপূরণ প্রদান থেকে বিরত থাকতে পারবে। এক্ষেত্রে আদায়কৃত জরিমানার অর্থ স্টক এক্সচেঞ্জের ‘বিনিয়োগকারী সুরক্ষা তহবিল (ইনভেস্টরস প্রটেকশন ফান্ড)’ অথবা এসইসির বিনিয়োগকারী প্রশিক্ষণ তহবিলে (ইনভেস্টরস এডুকেশন ফান্ড)’ প্রদান করতে পারবে।
আপিলের আগে জামানত
খসড়া সংশোধনীতে এসইসির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে আপিল করার ক্ষেত্রে শর্ত আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে এসইসির পক্ষ থেকে জরিমানা আরোপের পর অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান চাইলে আদালতে আপিল করতে পারে। সংশোধনীতে আপিলের সুযোগ বহাল রাখা হলেও তার আগে ধার্য্যকৃত জরিমানার কমপক্ষে ২৫ শতাংশ অর্থ আদালতে জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে এসইসির পক্ষে জরিমানা আদায় করা সহজ হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
লেনদেন স্থগিতের সময় বাড়ছে
১৯৬৯ সালের অধ্যাদেশের ৯(৮) ধারা অনুযায়ী পুঁজিবাজার বা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে এসইসি বা স্টক এক্সচেঞ্জ তালিকাভুক্ত যে কোন কোম্পানির শেয়ার লেনদেন ১৪ দিনের জন্য স্থগিত রাখতে পারে। একই কারণে এই স্থগিতাদেশ শুধুমাত্র একবারের জন্য আরও ১৪ দিন বাড়ানো যায়। অধ্যাদেশের এই ধারাটি সংশোধন করে লেনদেন স্থগিত রাখার ক্ষমতা প্রথমে ৪৫ দিন এবং পরবর্তীতে আরও ৪৫ দিন পর্যন্ত বৃদ্ধি করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
Source :
http://www.sharenews24.com/index.php?page=details&nc=02&nc=02&news_id=403