বাজারের স্বার্থে বাংলাদেশ ফান্ড ও এসএমএসএফ গঠন প্রয়োজন
২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকে দেশের শেয়ারবাজারে ভয়াবহ দরপতনের ঘটনা ঘটে। এ বছরের শুরুতেও চলে এই দরপতনের ঘটনা। আর এই দরপতন ঠেকাতে পুঁজিবাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের তত্পরতাও চোখে পড়ে এই দীর্ঘ সময়জুড়ে। দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এর মধ্যে কিছু কিছু পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলেও অনেক পদক্ষেপই এখনো আলোর মুখ দেখেনি। এই পদক্ষেপগুলোর মধ্যে ছিল দুটি তহবিল গঠন। কিন্তু বাংলাদেশ ফান্ড নামে একটি তহবিল গঠনের কার্যক্রম চললেও ‘স্টক মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড’ বা শেয়ারবাজার স্থিতিশীলকরণ তহবিলের কোনো কার্যক্রমই চোখে পড়ছে না।
বাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আলোচিত বিভিন্ন পদক্ষেপে বিনিয়োগকারীরা আশায় বুক বাঁধেন। তবে পরে তাঁরা এ ব্যাপারে আশাহত হন।
এদিকে, বিভিন্ন পক্ষের নেওয়া পদক্ষেপগুলোর সফল বাস্তবায়ন চান বিনিয়োগকারীরা। তাঁরা বলছেন, এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সঞ্চার হবে, যা বাজারের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে।
শেয়ারবাজারে অব্যাহত দরপতন মোকাবিলায় দুটি তহবিল গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ‘বাংলাদেশ ফান্ড’ নামে পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠনের ঘোষণা দেয়। তহবিলটি গঠনে আইসিবির পাশাপাশি যোগ দেয় রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক সোনালী, রূপালী, অগ্রণী ও জনতা। এর পাশাপাশি ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত বিমাপ্রতিষ্ঠান জীবন বীমা করপোরেশন, সাধারণ বীমা করপোরেশন ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল)। এরই মধ্যে তহবিলটির উদ্যোক্তারা নিজেদের অংশ সংগ্রহ সম্পন্ন করেছেন। বাংলাদেশ ফান্ডের ইউনিট বিক্রির মাধ্যমে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহের কাজও এগিয়ে চলেছে। একই সঙ্গে ওই ফান্ড থেকে বাজারে বিনিয়োগ অব্যাহত রয়েছে বলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে ফান্ডটির মূল উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফায়েকুজ্জামান প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ফান্ডের উদ্যোক্তা অংশের অর্থ সংগ্রহ সম্পন্ন করেছি। ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ফান্ডের ইউনিট বিক্রির মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা হচ্ছে। বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা যাতে এই ফান্ডে সহজে বিনিয়োগ করতে পারেন, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’ এই ফান্ড বাজারের ক্রান্তিকালে বড় ধরনের সহায়তা করবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
এদিকে গত বছরের ২৩ অক্টোবর শেয়ারবাজারের জন্য বিশেষ তহবিল গঠনের ঘোষণা দেয় ব্যাংক মালিকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস’ (বিএবি)। শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে ‘স্টক মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড’ (এসএমএসএফ) নামে তহবিলটি গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
প্রাথমিকভাবে এক হাজার কোটি টাকা দিয়ে এই তহবিলের কার্যক্রম শুরু করা হবে। পরবর্তী সময়ে এর আকার পাঁচ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলেও ওই দিন জানানো হয়। রাজধানীর গুলশানে বিএবির নিজস্ব কার্যালয়ে এক সভা শেষে এই ঘোষণা দেওয়া হয়।
জানা যায়, এটি একটি মিউচুয়াল ফান্ড হওয়ার কথা। এখন ফান্ডে প্রতিটি ব্যাংক ২০ কোটি টাকা দেবে। তবে চাইলে এর বেশিও দিতে পারে। এ ছাড়া পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানি সর্বনিম্ন ১০ কোটি টাকা দিয়ে তহবিলে যুক্ত হতে পারে। এক সপ্তাহের মধ্যে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় তহবিলের উদ্যোক্তার বিষয়টি চূড়ান্ত হবে বলেও সেদিন জানানো হয়।
এ ছাড়া, তহবিলটি গঠনের জন্য একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠনের কথা জানিয়েছিলেন বিএবির সভাপতি ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার।
এর আগে ৩ অক্টোবর বাজার স্থিতিশীলকরণ তহবিল নিয়ে এসইসির চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজের (বিএপিএলসি) তত্কালীন সভাপতি সালমান এফ রহমান, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ বণিক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি (এফবিসিসিআই) এ কে আজাদ ও বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) সভাপতি শেখ কবির হোসেন।
ওই দিন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ বলেছিলেন, ‘আমরা বাজার স্থিতিশীলকরণ তহবিলের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এসইসির সঙ্গে আলোচনা করেছি। এসইসি এ-সংক্রান্ত কাগজপত্র জমা দিতে বলেছে।’
বাজার স্থিতিশীলকরণ তহবিল গঠনের ঘোষণা দেওয়ার পর ছয় মাস পার হলেও তহবিলটি গঠনের কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি আজও। বিষয়টি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএপিএলসির সাবেক সভাপতি সালমান এফ রহমান জানান, এ বিষয়ে মূল উদ্যোক্তা বিএবির সভাপতিই ভালো বলতে পারবেন। তিনি আরও বলেন, ‘আমার জানামতে, তহবিলটি গঠনের কাজ চলছে।’ তবে কত দূর এগিয়েছে, সে ব্যাপারে কিছুই বলতে পারেননি তিনি।
এ ব্যাপারে বিএবির সভাপতি নজরুল ইসলাম মজুমদারের সঙ্গে তাঁর মুঠোফোনে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান-উর-রশিদ চৌধুরী প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, ‘আইসিবি ও বিএবির পক্ষ থেকে দুটি ফান্ড গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও ফান্ড দুটির কার্যক্রম দেখছি না। বাজারের স্বার্থে এই দুটি ফান্ড গঠন করা প্রয়োজন।’ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি), আইসিবি ও বিএবিকে এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মোহাম্মাদ মুসা প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, ‘তহবিলটি গঠন করা হলে ভালো হতো। বাজারের ক্রান্তিলগ্নে একটা সাপোর্ট দেওয়া যেত। তবে যেহেতু এর কার্যক্রম চোখে পড়ছে না, তাই এর ইতিবাচক বা নেতিবাচক দিক নিয়ে বলা যাচ্ছে না।
আর বাংলাদেশ ফান্ড নিয়ে তিনি বলেন, উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ফান্ডের ব্যাপারে বারবার বলা হলেও ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। আর তাই তহবিলটির অর্থ সংগ্রহে বেশ ভাটা পড়েছে বলেও মনে করছেন তিনি। তবে এই দুটি তহবিল পুরোপুরি গঠন সম্পন্ন হলে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করেন তিনি।