সোনালি আশ নামটা সবার কাছেই পরিচিত। হ্যাঁ বলতেছিলাম পাটের কথা। সোনা যেরকম অনেক মূল্যবান একটি বস্তু, সোনালি আঁশ ও একসময় অনেক মূল্যবান জিনিস ছিলো এদেশের মানুষের কাছে। আর থাকবে নাই বা কেনো কারন একসময় পাট ই ছিলো বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল।
বাংলাদেশের জলবায়ু পাট চাষের জন্য উপযোগি। আর বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত মানের দেশি এবং তোষা পাটের চাষ বাংলাদেশেই বেশি হতো। কয়েকশত বছর আগেও পাট বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের বিকাশে প্রধান নিয়ামক ছিলো। কিন্তু বর্তমানে সেই পাট এখন প্রায় বিলুপ্ত। যদিও বর্তমান সরকার অনেকগুলো উদ্যোগ গ্রহন করেছে পাট চাষের প্রসারের জন্য কিন্তু তা ও আগের মত সুফল নিয়ে আসবে কিনা তার নিশ্চয়তা নাই।
পাট রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করতো। একসময় পৃথিবীর মোট পাট উৎপাদনের শতকরা ৩৫ ভাগ হতো বাংলাদেশে। কিন্তু তা এখন নেই বললেই চলে।
এবার বলি আমাদের দেশের পাট নিয়ে কিছু কথা।
একসময় বাংলাদেশে যে পরিমান পাট চাষ হতো তার ৫ ভাগের ১ ভাগ ও হয় না এখন। এই দেশের পাটের বাজারকে কেন্দ্র করে ১৯৫১ সালে গড়ে উঠেছিলো দেশের সর্ববৃহৎ পাটকল ‘আদমজী জুট মিলস’। বর্তমানে এই দেশে প্রায় ১০০ এর মত পাটকল আছে যার ২৬ টি সরকারি আর বাকিগুলা বেসরকারি। প্রায় বেশির ভাগ গুলাতেই কোনো পাট উৎপাদন হয়না। আবার পাটকলগুলো পুরোনো হয়ে যাওয়ায় আশানুরূপ পাট উৎপাদন হয় না যার কারনে উৎপাদন খরচ হয়ে যায় অনেক বেশি। ফলে কল কারখানা গুলোতে লোকসান বেশি হয়। তাছাড়া পাটের উৎপাদন ও বিকাশের জন্য যেসকল ব্যাবস্থা নেয়া দরকার তা আমাদের রাষ্ট্র নিচ্ছেনা।
চীন তুলা এবং পাটের সংমিশ্রণ এ কাপড় তৈরি করছে এবং তা পুরো বিশ্বে সরবরাহ দিচ্ছে কিন্তু আমরা পারব না কেনো আমাদের সুযোগ বেশি থাকার পরেও?
এতে তুলার আমদানি যেরকম কমে যাবে তেমনি পাটের ব্যাবহার ও বৃদ্ধি পাবে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার ও সাশ্রয় হতো।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে পাটের দাম উঠানামা করলেও বাংলাদেশের কৃষক কাংখিতভাবে লাভজনক হচ্ছে না।
আমাদের দেশে রপ্তানিকৃত পাটের প্রায় ৯২ ভাগ রপ্তানী হয় ভারত,চীন ও পাকিস্তানে। এছাড়া থাইল্যান্ড,ভিয়েতনাম, ব্রাজিল ও আইভোরিকোস্টেও বিপুল পরিমান পাট রপ্তানী হয়।
পাটের দ্রব্যের মধ্যে সবচেয়ে রপ্তানী হয় পাটের সূতা। আমাদের দেশে পাটের সূতার বেশির ভাগ রপ্তানী হয় তুরষ্কে। প্রায় ৪০ ভাগ রপ্তানী হয় তুরষ্কে।
২০১১ সালে প্রতি মণ পাট বিক্রি হতো ২৫০০-৩০০০ টাকা পর্যন্ত কিন্তু সময় যত আগালো পাটের দাম তত কমে গেলো। কৃষক রা অই দামেও পাট বিক্রি করতে পারলোনা।
পরে অবশ্য চাপে পড়ে নির্বাচনী ওয়াদা ঠিক রাখতে যেয়ে সরকার পাট শিল্পের জন্য লোক দেখানো কিছু ভাল সিদ্ধান্ত নেয়াতে পাটের বাজারটা ভাল হয়েছিল। কিন্তু তারপর যা তাই। দেশের জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাট চাষের সাথে জড়িত। কৃষক-ক্ষেতমজুর সরাসরি উৎপাদনের সাথে জড়িত। পাট বিপণন ও কাঁচা পাট ব্যবহার উপযোগী করে ‘পাট পণ্যে’ পরিণত করতে নানান স্তরে বহুলোকের প্রয়োজন হয়।
পাট ও পাট শিল্পের বিকাশের পথে বাঁধা রয়েছে অনেক।
প্রথমত, সরকারের উদাসীনতা বা অবহেলা। গত কয়েকটি সরকার ব্যক্তিখাতকে প্রাধান্য দিলেও ব্যক্তিখাতের বৃহত্তর খাত হল কৃষি। কিন্তু এদিকে নজর নেই। কারণ এখানে কমিশন কম।
দ্বিতীয়ত, বিদেশি ষড়যন্ত্র। যে বিশ্ব ব্যাংকের ব্যবস্থাপত্রের দ্বারা আদমজী পাটকল বন্ধ করা হয়েছিল, সেই বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় একই সময়ে ভারতে নতুন পাটকল স্থাপিত হয়েছিল।
লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে বন্ধ করা হয়েছিল এই বৃহৎ প্রতিষ্ঠানটি। অথচ আদমজী পাটকল বন্ধ করতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে যে টাকা খরচ করা হয়েছিল, তার থেকে অনেক কম টাকা দিয়ে পাটকলটি বিএমআরআই করালে লোকসান না হয়ে বরং লাভ হত। পাটখাত সংস্কার কর্মসূচির নামে বিভিন্ন সময় বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে পাটকলগুলি বন্ধ করে। এতে পাটচাষি ও পাটকল শ্রমিকদের স্বার্থের পরিপন্থি এবং পরিবেশের পরিপন্থি কাজ করা হয়েছে।
তৃতীয়ত, পাট ও পাট শিল্পের অন্তরায় হল পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার। নাগরিক সচেতনতা এর জন্য দায়ী।
পাটের বদলে আমরা প্রত্যহ যা ব্যবহার করছি, তা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এবং তা আমরা করছি জেনেশুনেই। বাংলাদেশের নগর জীবন থেকে শুরু করে সর্বত্র পলিথিনের যত্রতত্র ব্যবহারের কারণে পরিবেশ-প্রকৃতি মারাত্মকভাবে হুমকির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বড় বড় শহরগুলির আশ-পাশের নদীর তলদেশ পলিথিন দ্বারা ভরাট হয়ে চলছে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ছে। ফসলের মাঠে ঢুকে পড়েছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতেও পাট সম্পর্কে ভালো পড়াশুনার সুযোগ নেই কারন পর্যাপ্ত মেশিন এর অভাব।
দেশের একমাত্র টাংগাইল টেক্সটাইল কলেজে জুটের উপর কোর্স করানো হয়। যার ফলে দেশের ছাত্রছাত্রীরাই পাট নিয়া ভাবতে আগ্রহী বেশি না।
পাট চাষের প্রসার ঘটাতে কিছু সিদ্ধান্ত সরকার নিতে পারে।
-দেশে কিছু টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে যেখানে জুটের উপর সম্পূর্ন প্রশিক্ষন দেয়া হবে।
– তাছাড়া সরকার উদ্যোগ এর মাদ্যমে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে তা কাজে লাগাতে হবে।
Source- Textile BANGLA 24