ওয়েরস্টেডের পর্যবেক্ষণ প্রকাশের মাস দুয়েকের মাথায় ফরাসি গণিতবিদ অঁদ্রে-মারি অ্যাম্পিয়ার এ নিয়ে আরো বড় পরিসরে একটি পরীক্ষা পরিচালনা করেন। তিনি দুটো বৈদ্যুতিক তারকে খুব কাছাকাছি রাখলেন। এরপর দুটো পরিবাহীর মধ্য দিয়েই তড়িৎ প্রবাহিত করলেন। বিদ্যুৎ যখন একই দিকে পরিবাহিত হচ্ছিল, তখন তার দুটো পরস্পরকে বিকর্ষণ করতে লাগলো। কিন্তু বিদ্যুৎ যখন বিপরীত দিকে পরিবাহিত হচ্ছিল তখন তার দুটো পরস্পরকে আকর্ষণ করতে শুরু করে।
অ্যাম্পিয়ার এ পরীক্ষা থেকে সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, তার দুটো দিয়ে যখন বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয় তখন এর ফলে এর চারদিকে চুম্বকক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। আর এই চুম্বকীয় বলের কারণেই বিদ্যুৎ পরিবাহিগুলো এ পারস্পারিক আকর্ষণ-বিকর্ষণের আচরণ করে। তিনি দাবি করেন যে, ওয়েরস্টেডের কম্পাসের ক্ষেত্রেও একই বিষয় ঘটেছে।
অ্যাম্পিয়ার এখানে থেমে থাকেননি। তিনি তুখোড় গণিতবিদ ছিলেন, পদার্থবিদ্যায়ও দখল অসামান্য। তিনি তার গবেষণালব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ ও চুম্বকের জটিল সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করার জন্য প্রথম গাণিতিক মডেল দাঁড় করলেন। ভুল প্রমাণিত করলেন চুম্বকত্বের জনক উইলিয়াম গিলবার্টকে। প্রমাণ করলেন চুম্বকত্ব ও তড়িৎ সম্পূর্ণ পৃথক বিষয় নয়। অ্যাম্পিয়ারের এ গবেষণা ছাড়াও সেসময় আরো কিছু পরীক্ষা তড়িৎ-চুম্বকের সম্পর্ককে আরো মজবুত করে। এর মধ্যে তড়িৎচুম্বক উদ্ভাবনের ঘটনাটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।
১৮২৫ সালে ইংরেজ পদার্থবিদ উইলিয়াম স্টারজোন এটি উদ্ভাবন করেন। তিনি কাঁচা লোহার একটি ছোটখাট দন্ড নিয়ে একে বৈদ্যুতিক তার দিয়ে সম্পূর্ণ পেঁচিয়ে নেন। এরপর তিনি লোহাটিকে বাঁকিয়ে অনেকটা ঘোড়ার খুরের আকৃতি দেন। যখন ঐ তারের মধ্য দিয়ে তিনি বিদ্যুৎ প্রবাহ পরিচালনা করেন, লোহাটি তখন চুম্বকের ন্যায় আচরণ করতে শুরু করে। এর দুটি বিপরীত মাথা চুম্বকের দু’মেরুর মতো আচরণ করে। কিন্তু যখনই বিদ্যুৎ প্রবাহ বন্ধ করে দেয়া হয়, এর চুম্বকত্ব বিলোপ হয়ে যায়।
স্টারজোনের এ উদ্ভাবনটি একদমই সহজ। আপনি নিজের বাসায়ও এটি চেষ্টা করে দেখতে পারেন। একখন্ড রড, কপার তার আর একটি ব্যাটারি দিয়ে খুব সহজেই বানিয়ে নিতে পারেন ইলেকট্রোম্যাগনেট বা তড়িৎচুম্বক। তবে সেসময়ের বিজ্ঞানীরা তড়িৎচুম্বককে স্বীকার করে নিলেও এটিকে সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করতে পারতেন না। ব্যাখ্যা করতে না পারলেও এর মাধ্যমে অনেক গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন হয়েছিল।
তড়িৎচুম্বককে অনন্য পর্যায়ে নিয়েছিলেন এর পরবর্তীতে দৃশ্যপটে হাজির হওয়া দুজন গ্র্যান্ডমাস্টার, ফ্যারাডে ও ম্যাক্সওয়েল। বর্তমানে তড়িৎচুম্বক বা বিদ্যুৎ বিষয়ে আমাদের যে জ্ঞান, যে অর্জন, তার জন্য ফ্যারাডে ও ম্যাক্সওয়েলের অবদান অপরিসীম। তবে তাদের কাজের ভিত কিন্তু গড়ে দিয়েছিলেন গিলবার্ট, ওয়েরস্টেড, অ্যাম্পিয়াররা। তাদের কাজের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে আজকের এ বৈদ্যুতিক সভ্যতা।