‘বৈশাখী উৎসবে ধর্মের সংশ্রাব !

Author Topic: ‘বৈশাখী উৎসবে ধর্মের সংশ্রাব !  (Read 1476 times)

Offline Mohammad Nazrul Islam

  • Full Member
  • ***
  • Posts: 184
  • Test
    • View Profile
‘বৈশাখী উৎসবের ঐতিহাসিক ধারা বিবেচনায় রেখে অপরিপক্ক জ্ঞান ও অসম্পূর্ণ মন-ভাবনায় কয়েক দিন আগে ‘অন্তরে বৈশাখের ইতিবৃত্ত’ নামে একটি লেখা দাঁড়া করাতে চেষ্টা করেছিলাম। লেখাটি আলোচনা-সমালোচনার দোষে দুষ্ট ছিল। এ ব্যাপারে আমার শ্রদ্ধাভাজন সুহৃদ, প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব জনাব মোশারফ হোসেন সাহেব ‘বৈশাখী উৎসবে ধর্মের সংশ্রাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন’ যা সত্যিই ভাবনার বিষয়।‘বিনা পাকালে গড়িয়ে কাচিঁ, করছি নাঁচা-নাঁচির মতই- এ ব্যপারে আরো দুই-চারটি কথা জনাবের পদতলে সবিনয়ে নিবেদন করলাম।

আগেই বলা হয়েছে বৈশাখ বাঙ্গালী জাতির সার্বজনীন সাংস্কৃতিক উৎসব। সংস্কৃতি সর্ম্পকে বলা যায়, কোন স্থানের মানুষের ভাষা আচার-ব্যবহার জীবিকা, সঙ্গীত, নৃত্য, সাহিত্য, সামাজিক সম্পর্কীত শিক্ষা-দীক্ষা, ও ধর্মীয় রীতি-নীতির মাধ্যমে যে, অভিব্যক্তি প্রকাশ করা হয় তাই সংস্কৃতি। তাই, সংস্কৃতিকে way of life বলা হয়। জাতি ও জাতীয়তার সাথে সংস্কৃতির সম্পর্ক নিরবিচ্ছিন্ন । একই সংস্কৃতির পরিমন্ডলে বিভিন্ন ধর্মের লোক থাকতে পারে, কিন্তু ঐক্যব্দ্ধ জাতি গঠনে একটি অভিন্ন সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। পুস্তকের ভাষায়, একই সংস্কৃতির সহজাত স্রোত-ধারায় বহু-ধর্মীয় সংমিশ্রনে, একটি অভিন্ন জাতীয়তা তৈরী হয় যা চিরাচরিৎ ধর্মীয় ধারনাকে বহুলাংশে মানবিক করে তুলে।

আর ধর্মীয় সজ্ঞায় বলা হয়েছে- শতানের উপর জয়যুক্ত হওয়া এবং আত্মায় সত্যের আসন প্রতিষ্ঠা করাই ধর্ম। নিয়ম পালেন সাথে, জীবনের কদর্যতা সম্পর্কে সচেতন হওয়া প্রত্যেকটি মানুষের পবিত্র দায়িত্ব। সংস্কৃতিতে কদর্যতা থাকলেও বিবর্তন-যুগধারায় তা মানবিক পথে ধাবমান। তাই, জ্ঞানীরা বলেন, ধর্ম জীবন হলো মৌলিক আর সংস্কৃতি তার দর্শন। দর্শনহীন ধর্ম অসম্পূর্ণ।

বৈশাখের সাথে ইসলাম ধর্মের সংশ্রাব অর্থহীন। মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থের কোথাও বৈশাখী উৎসব পালনের কথা উল্লেখ নাই। তবে বাঙ্গালী জাতির সংস্কৃতি ‘বৈশাখী উৎসব’ আংশিক ভাবে হলেও ভারতবর্ষে মুসলাম শাসকদের ‘শাসন ব্যবস্থাকে দীর্ঘায়িত ও সুসংহত করেছে এ কথা সকলেরই মানতে হবে। বিশেষ করে বিনদেশী শাসক সম্রাট আকবরের অভিনব ‘‘তারিখ ই-ইলাহি ’ আয়োজনে, অর্থনৈতিক বা সংস্কৃতির অন্তরালে ধর্মীয় সহিষ্ণু ভাবনায় ভাবতবর্ষে মুঘল শাসন/ ইসলামী শাসন সু-প্রতিষ্ঠা করার সুদুর প্রসারী রাজনৈতিক কূট-কৌশল ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।

ইতিহাস ধারাপদ থেকে জানা যায়, মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে বাংলা -উড়িষ্যায় ইলাহি সন, মৌসুমি বা ফসলি সন ও বিলায়েতি সনের চালু ছিল। ঘরে ঘরে ফসল তোলার সাথে খাজনা আদায়ের ব্যাপক প্রচলন ছিল। এজন্য সম্রাট আকবর জ্যোতিষশাস্ত্রবিদ আমির ফতেউল্লাহ সিরাজিকে দিয়ে হিজরি সনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে ‘তারিখ ই-ইলাহি উদ্ভাবন ও এর প্রচলন করেন যা পরবর্তীতে ‘বৈশাখী উৎসব’ হিসাবে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপক-প্রচার ও প্রতিষ্ঠা পায়।

বৈশাখী উৎসব আজ বাংলা ভাষা-ভাষী বাঙ্গালীদের প্রাণের উৎসব। বৈশাখ শব্দটির উৎপত্তিতেই সনাতন ধর্মের হৃদয়ত্বতা রয়েছে। বাংলা ভাষার প্রাণকোষ বাংলা-ব্যাকরণে বৈশাখ শব্দটির উল্লেখ পওয়া যায় এ ভাবে- বৈশাখ+ষ্ণ, অস্তার্থে।২। মন্থণ দন্ড।বিশাখা+ষ্ণ।বি;পু।বিশাখা নক্ষত্রযুক্ত পুর্ণিমা।

ইতিহাস বিদূত, বাংলাদেশের আদি জনগোষ্ঠিরা বহুকাল আগে থেকেই বৈশাখী উৎসব পালন করে আসছে। মূলতঃ আদি জাতি-গোষ্ঠীরা বৈশাখী উৎসবকে ‘বৈসাবি’ উৎবস হিসাবে পালন করত। বর্ণ বেদে তারা আলাদা আলাদা ভাবে, আলাদা আলাদা নামে এই উৎসব পালন করত। যেমন মারমা -রা সাংগ্রাই, ত্রিপুরা-রা বৈসু, তঞ্চঙ্গ্যা-রা বিষু এবং চাকমা-রা বিজু’ উৎসব হিসাবে পালন করত। এই সকল উৎসবকে সম্মিলিত ভাবে বৈসাবি বলা হয় যা আজও তাদের সমাজে ‘চেতনা-ধর্মী’ উৎবস হিসাবে বহমান রয়েছে।

যুগ-যুগান্তরের ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়, বৈশাখ বা বৈসবী উৎসব পালনের সাথে বৈদিক জাতি-গোষ্ঠির পুরাণ, বেদ কিম্বা সনাতন ধর্মের সংশ্রাব রয়েছে। হিন্দুরা বহুকাল আগ থেকেই বৈশাখী উৎসবকে তাদের ধর্মীয় উৎসব হিসাবে পালন করে।

হিন্দু চান্দ্র পঞ্জিকায় ১২টি মাস রয়েছে -চৈত্র, বৈশাখ, জৈষ্ট, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিণ, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পোষ, মাঘ ফাল্গুন। এই মাস গুলি নাম খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রত্যেকটি মাসের নাম এসেছে সেই মাসের পূর্ণিমার দিনে চলমান নক্ষত্রের নাম থেকে।

পৌরানিক উপাখ্যানে উল্লেখ পাওয়া যায়, চন্দ্র দেবতা হলেন স্বর্গের দেব মণ্ডলীর অন্যতম । চন্দ্র দেবের পিতার নাম অত্রি মুনি এবং মাতার নাম অনুসূরযা । হরিবংশ পুরান অনুযায়ী, চন্দ্র দেবতার বিয়ে হয়েছিল প্রজাপতি দক্ষ রাজার ২৭ কন্যার সাথে । প্রজাপতি দক্ষ ২৭ কন্যার নাম ছিল– অশ্বিনী , ভরণী , কৃত্তিকা , রোহিনী , মৃগশিরা , আদ্রা , পুনর্বসু , পুষ্যা , অশ্লেষা , মঘা , উত্তরফাল্গুনী , পূর্বফাল্গুনী , হস্তা , চিত্রা , স্বাতী , বিশাখা , অনুরাধা , জ্যেষ্ঠা , মূলা , পূর্বাষাঢ়া, উত্তরাষাঢ়া , শ্রবনা , যনিষ্ঠা , শতভিষা , পূর্বভাদ্রপদ , উত্তরভাদ্রপদ , রেবতী । ২৭ কন্যাই চন্দ্র দেবকে খুব ভালোবাসতেন।

কিন্তু চন্দ্রদেব কেবল রোহিনী কেই ভালোবাসতেন । বাকী ছাব্বিশ কন্যা মনের দুঃখে পিতা দক্ষের কাছে নালিশ জানান । এতে দক্ষ ,ক্ষিপ্ত হয়ে চন্দ্রদেবতাকে ক্ষয় রোগে আক্রান্তের অভিশাপ দেন । চন্দ্রদেবতা রোগে জর্জরিত হলে ব্রহ্মা , বিষ্ণু, দেবগণের কথা মতো সাগর তটে শিবলিঙ্গ নির্মাণ করে মহাদেবের তপস্যা আরম্ভ করলেন । মহাদেব সন্তুষ্ট হয়ে চন্দ্রদেবের সম্মুখ উপস্থিত হন। ফলে চন্দ্র দেব আংশিক ভাবে শাপ মুক্ত হন ।

তৎপর তিনি চন্দ্রকে বর দেন, পূর্ণিমার পরদিন থেকে কৃষ্ণ পক্ষের প্রতিপদ থেকে চতুর্দশী পর্যন্ত চন্দ্রদেব ক্ষয় হতে থাকবেন , অমাবস্যার দিন সম্পূর্ণ ক্ষয় হবেন । আবার অমাবস্যার পরদিন থেকে শুক্ল পক্ষের প্রতিপদ থেকে চতুর্দশী পর্যন্ত একটু একটু করে বাড়তে থাকবেন , পূর্ণিমা তে পূর্ণ রূপ হবেন । এর পর চন্দ্র দেবতাকে মহাদেব শিরে ধারন করলেন । (পর্ব-১) চলবে—-