‘শেপ সাউথ এশিয়া ২০১৮ সম্মেলন’ উপলক্ষে সম্প্রতি ঢাকা এসেছিলেন ইতালির ডাটা সায়েন্স এক্সপার্ট স্টেফানো গার্সিয়ালো। বার্লিনভিত্তিক ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম রেডস্টোনের এ কর্মকর্তা ডাটা সায়েন্স ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করা স্টার্টআপ অনুসন্ধান করে থাকেন। সম্মেলনস্থলে বণিক বার্তার সঙ্গে এক আলাপচারিতায় ব্যবসায় প্রযুক্তিগত রূপান্তর এবং বাংলাদেশ বিষয়ে ভাবনার নানা দিক নিয়ে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন মাহফুজ উল্লাহ বাবু ও নাবিল সালেকীন
আপনার ক্যারিয়ার ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আমাদের জানাবেন—
আমি লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্ট্যাডিজ থেকে অর্থনীতি ও রাজনীতিতে স্নাতক পড়ে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে ফিন্যান্সিয়াল কম্পিউটিং ও ডাটা সিকিউরিটি নিয়ে উচ্চতর শিক্ষা নিই। এ বিষয়ে পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন হওয়ার পর আমি সিলিকন ভ্যালিভিত্তিক কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফিল্ডে কাজ করেছি। ডাটা সায়েন্স এক্সপার্ট হিসেবে ইতালি সরকার, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, ইউরোপীয় কমিশনের পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেছি। বর্তমানে আছি বার্লিনভিত্তিক ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম রেডস্টোনে। টেকনিক্যাল ফিল্ডে বিনিয়োগযোগ্য স্টার্টআপ খোঁজা, বিনিয়োগকারীদের জন্য সেগুলোর মূল্যায়ন করা, তাদের এগিয়ে নেয়ায় সাহায্য করার কাজগুলো আমি করি। বিভিন্ন করপোরেশনের সম্ভাব্য প্রয়োজনগুলো অ্যাড্রেস করতেও সাহায্য করি।
ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠান রেডস্টোন মূলত আমার মতো প্রোফাইলের ১৫-১৬ জন প্রফেশনালের টিম। আমাদের ব্যবস্থাপনায় এখন ৩০০ মিলিয়ন ইউরোর মতো ফান্ড রয়েছে। আমরা আড়াই লাখ থেকে ৫০ লাখ ইউরো পর্যন্ত একেকটি স্টার্টআপে বিনিয়োগ করি। প্রচলিত ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্মগুলোর সঙ্গে আমাদের বিজনেস মডেলে পার্থক্য আছে। অন্যরা যেখানে পূর্বগঠিত সামষ্টিক ফান্ড গঠন করে সেগুলো ম্যানেজ করে, আমরা তার বদলে কেস স্পেসিফিক সার্ভিস দিয়ে থাকি এবং ভেঞ্চার ক্যাপিটালে এ মডেলটি সফল প্রমাণিত হয়েছে।
উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে, প্রযুক্তিগত উত্কর্ষ নিশ্চিত করার জন্য একটি প্রতিষ্ঠানের সামনে দুটি পথ খোলা আছে— নিজেদের আরঅ্যান্ডডিতে বিনিয়োগ করা নয়তো সংশ্লিষ্ট ফিল্ডে কাজ করা স্টার্টআপে বিনিয়োগ করা। দ্বিতীয় অপশন বেছে নিলে আমরা বড় করপোরেশনগুলোর জন্য স্টার্টআপ খুঁজে বের করি। সম্ভাবনাময় ফার্মগুলোর টেকনিক্যাল ও ফিন্যান্সিয়াল মূল্যায়ন করে আমরা গ্রাহককে পরামর্শ দিই। গ্রাহক চাইলে তাদের হয়ে বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনার কাজটিও করি। আবার যোগ্য স্টার্টআপগুলোর জন্য উপযুক্ত বিনিয়োগ নিশ্চিত করতেও আমরা কাজ করি। প্রয়োজনে তারা আমাদের কাছ থেকে নার্সিং ও গাইডেন্সও পায়। বিজনেস মডেলটিকে আমরা বলি ‘ভেঞ্চার ক্যাপিটাল এজ অ্যা সার্ভিস’।
কেমন সাড়া পাচ্ছেন? এ অঞ্চলে আপনাদের ব্যবসা আছে?
গত কয়েক বছরে ইউরোপে আমরা চমত্কার সাড়া পেয়েছি। ইউরোপের সবচেয়ে বড় লজিস্টিকস কোম্পানিটি আমাদের গ্রাহক। তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর স্বচালিত গাড়ির প্রযুক্তি আত্মস্থ করে এগিয়ে থাকতে চায়। তাদের টেকনিক্যাল চাহিদাগুলোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ স্টার্টআপ কোম্পানিতে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বিনিয়োগে সাহায্য করেছি আমরা। ইউরোপজুড়ে ইন্টারব্যাংক অ্যাকাউন্ট সংযুক্তি করেছে যে স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানটি তার নাম ফিগো, আমরা তাদের ভেঞ্চার ক্যাপিটাল সেবাদাতা। এর বাইরে অনেক ছোট ছোট সাফল্যের উদাহরণ রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর ইউরোপে রেডস্টোনের কার্যক্রম জোরদার করছি আমরা। এ অঞ্চলে এখনো আমাদের কোনো ব্যবসা নেই। তবে একদিন নিশ্চয়ই হবে। আমি সম্ভাবনা দেখার জন্য এরই মধ্যে চীন গিয়েছি। আপনাদের দেশে এলাম। আরো কয়েকটি দেশে যাওয়ার ইচ্ছা আছে।
বাংলাদেশকে কেমন দেখছেন? এখানে আপনার ফিল্ডে সম্ভাবনা কতটা?
আমি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এসেছি। ঢাকার মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে এক কথায় বলতে পারি, চমত্কার দেশ, চমত্কার মানুষ। সম্মেলনে গ্লোবাল শেপারদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হচ্ছে। স্থানীয় অনেক বিজনেস লিডারের সঙ্গেও কথা হচ্ছে। বাংলাদেশের ম্যাক্রো ডাটা ও বিজনেস সিনারি সম্পর্কে আমি সফরের অনেক আগেও পড়েছি। আমার চোখে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একটি পয়েন্ট হলো, পশ্চিমে বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রগুলোয় আমি প্রযুক্তি বিষয়ে বাংলাদেশী যে স্কলারদের দেখেছি, তারা খুবই মেধাবী। তারা দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, মানবসম্পদ, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সবকিছু নিয়ে অনেক ভাবেন।
এখন সারা পৃথিবীতেই ডাটা সায়েন্স ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ নিয়ে ফিনটেক, নানা ধরনের সেবা, ম্যানুফ্যাকচারিং সব ইন্ডাস্ট্রির লিডাররাই ভাবছে। রেগুলেটরি বডিগুলোও বাদ যাচ্ছে না। বাংলাদেশে আর্থিক সেবা খাতে অটোমেশনের ট্রেন্ড খুব জোরালো। তৈরি পোশাক খাতে রোবটিক্সের মতো বিষয়গুলো প্রয়োগ করার সুযোগ অনেক।
এখানকার স্টার্টআপ উদ্যোক্তাদের বিষয়ে কী জেনেছেন? আপনারা বাংলাদেশে কার্যক্রম চালাতে চান?
যতটুকু জেনেছি, বাংলাদেশে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড রয়েছে। স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন অনেক মেধাবী তরুণ। আমার ফিল্ডে এখানে কারো সঙ্গে এখনো দেখা হয়নি। তরুণদের বেশির ভাগই সফটওয়্যার নিয়ে বেশি সক্রিয়। ই-কমার্সেও কেউ কেউ ভালো করছেন বলে শুনেছি।
আমি বলব, স্টার্টআপ থেকে যুগান্তকারী আইডিয়া বা প্রযুক্তি পেতে হলে তাদের উৎসাহিত করার একটি সংস্কৃতি জোরদার করতে হয়। শিক্ষা ব্যবস্থা, ইন্ডাস্ট্রির প্র্যাকটিস সবকিছুতেই এমন ফিউচার লিডার তৈরির মতো করে সাজাতে হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ কতটা করছে, সেটি আপনারা ভালো জানবেন।
আমরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার মতো স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানের খোঁজে থাকব। ব্যক্তিগতভাবে কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে আমার। এছাড়া বাংলাদেশী যেসব করপোরেশন আগামীর জন্য উদ্ভাবনকে প্রাধান্য দিতে চায়, তাদের জন্যও আমরা উপযুক্ত ভেঞ্চার শনাক্ত করার কাজ করতে চাই। সেটি সবসময় বাংলাদেশেই খুঁজতে হবে, তেমন নয়। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে মেধা খুঁজে নিতে তারা আমাদের সাহায্য নিতে পারবে।
আপনি ডাটা সায়েন্স এক্সপার্ট। রাজনীতি ও গভর্ন্যান্স নিয়েও পড়াশোনা করেছেন। কিছুক্ষণ আগে বলছিলেন, ডাটা সায়েন্স রেগুলেটরদেরও সাহায্য করছে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত বলবেন?
ডাটা সায়েন্স মনিটরিং অ্যান্ড কন্ট্রোলকে অনেক কার্যকর ও দক্ষ করে। সংখ্যা আর অংকের বাইরে গিয়ে শব্দ, বাক্য, ইমেজের মধ্য থেকেও ডাটা তুলে আনতে পারে ডাটা সায়েন্স। ডাটা সায়েন্স খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমাদের যোগাযোগের অন্তত ৯৫ শতাংশ হয় নন-নিউম্যারিক ভাষায়।
মনিটরিং ও কন্ট্রোল কীভাবে জোরদার হয় তার দুটি উদাহরণ দিই। ইতালি সরকারের জন্য আমি দুটি কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। একটি স্থানীয় সরকারের প্রকল্প টেন্ডারিং নিয়ে, অন্যটি মানি লন্ডারিং সম্পর্কিত। প্রথমটিতে সব দরপত্র এবং দরদাতা ও সংশ্লিষ্ট এজেন্সির কর্মকর্তাদের মধ্যকার যোগাযোগের টেক্সটগুলো ডাটা সায়েন্সের পূর্বনির্ধারিত প্যাটার্নের মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে বিশ্লেষণ করা হয়। সন্দেহজনক প্যাটার্ন শনাক্ত করে সেগুলো তদন্ত করে দুর্নীতির ঘটনাও বের করে আনতে সক্ষম হয় ডাটা সায়েন্স। সে অপরাধীদের বিচারও হয়। দ্বিতীয়টিতে ইতালি থেকে আফ্রিকা মহাদেশে অবৈধভাবে পাচার হওয়া অর্থ ট্র্যাক করা হয়। ডাটা সায়েন্স সন্দেহজনক লেনদেন শনাক্তকরণে সেখানেও ভালো সাফল্য দেখিয়েছে। নীতিনির্ধারকরা আন্তরিকভাবে চাইলে সারা পৃথিবীতেই এসব সাফল্য অর্জন সম্ভব। আমি জেনেছি, বাংলাদেশ সরকারও অনেক কার্যক্রম জিডিটাল পদ্ধতিতে করছে। আপনাদের দেশে ডাটা সায়েন্সের প্রয়োগ জোরদার করার সুযোগ আছে।
দেখুন, সবাই সহযোগিতা করলে কেন্দ্রীয় সেলে কয়েকটি ভালো কম্পিউটারই বড় বড় মনিটরিংয়ের জন্য যথেষ্ট। আশা করি, আপনারা বুঝতে পারছেন, রেডস্টোন কীভাবে ছোট একটি টিম নিয়ে ৩০০ মিলিয়ন ইউরোর পোর্টফোলিও নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
আমি বলছি না, ডাটা সায়েন্স ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে আগামী ১০-১২ বছরেই পৃথিবীতে বিপ্লব ঘটে যাবে। তবে সাফল্যের উদাহরণগুলো আমাদের উৎসাহ বাড়াচ্ছে। তরুণরা আগামীতে এ বিষয়গুলোকে ক্রমেই শক্তিশালী করে তুলবে।
Source:
http://bonikbarta.net/bangla/news/2018-05-03/156456/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A7%87-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A7%8B%E0%A6%97%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AE%E0%A6%A4%E0%A7%8B-%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%86%E0%A6%AA%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%96%E0%A7%8B%E0%A6%81%E0%A6%9C%E0%A7%87-%E0%A6%A5%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%AC/