চিকুনগুনিয়া সংকট: বর্ষার আগে ভরসা কতটা?
[/b]
বাংলাদেশে ২০১৭ সালে যেভাবে চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ দেখা গিয়েছিল তা রীতিমত আতঙ্কিত করে তুলেছিল নগরবাসীকে। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই একে আখ্যা দিয়েছিলেন 'মহামারী' হিসেবে। যদিও সরকারিভাবে একে মহামারী ঘোষণা করা হয়নি, কিন্তু সেসময় মশা-বাহিত এই রোগটিতে কোনও না কোন সদস্য আক্রান্ত হয়নি - ঢাকা শহরে এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া কঠিন।
রোগতত্ত্ব ও রোগনিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের দেয়া সর্বশেষ হিসেবে, গতবছর মে মাস থেকে মাত্র সাড়ে চার মাসে ঢাকায় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকুনগুনিয়া সংক্রান্ত চিকিৎসা নিয়েছে ১৩ হাজার আটশোর বেশি মানুষ।
এর বাইরে দুই সিটি কর্পোরেশনে চিকিৎসা সেবা নিয়েছে অনেকে। তবে এমন বহু মানুষ আছে যারা চিকিৎসা নেই জেনে হাসপাতাল বা চিকিৎসকের দ্বারস্থ হয়নি, বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এমন প্রেক্ষাপটে বর্ষা মৌসুমকে সামনে রেখে চিকুনগুনিয়ার বিস্তার ঠেকাতে কতটা প্রস্তুতি রয়েছে?
সম্প্রতি ঢাকার দক্ষিণ অংশের বিভিন্ন বাড়িতে অভিযান চালায় ঢাকা সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ। যে আঠারোটি বাড়িতে তারা গিয়েছিল তার মধ্যে এগারোটি বাড়িতেই এডিস মশার লার্ভা পেয়েছে। এই লার্ভা থেকেই চিকুনগুনিয়া এবং ডেঙ্গুর রোগ-বহনকারী মশার জন্ম হয়।
গত বছর চিকুনগুনিয়া রোগটি নানা বয়সের মানুষের মাঝে যেভাবে ছড়িয়ে পড়ে তা রীতিমত আতঙ্কজনক এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। একই পরিবারে একাধিক মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়।
এমনই একজন ঢাকার শাহনাজ পারভিন । তিনি বলেন, "আমি হাঁটতে পারছিলাম না বসতে পারছিলাম নামাজও পড়তে পারছিলাম না। হাতে, আঙ্গুলে, পায়ে, পায়ের তলা, গাঁটে গাঁটে প্রচণ্ড ব্যথা। দাঁড়ালে বসতে পারিনা, বসলে শুতে পারি না এমন অবস্থা।"
"এমনকি প্রস্রাব-পায়খানা করতে কমোডে বা প্যানে বসতেও কষ্ট হচ্ছিল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম ভাবলাম আমি কি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গেলাম?"
পঞ্চাশোর্ধ এই নারী বলছিলেন, চিকুনগুনিয়ার পর সেরে উঠলেও প্রচণ্ড ব্যথা ছিল তার বহুদিন।
"সুস্থ হওয়ার পর যখন রান্না করতে গেলে দেখলাম হাত থেতে হাতা-খুন্তি পড়ে যাচ্ছে।"
উত্তরা এলাকার একজন বাসিন্দা বলছিলেন তার মাকে একমাস আইসিইউতে রাখতে হয়েছিল। আরেকজন পুরুষ বলছিলেন ছয়মাসও পরও তার পায়ে ব্যথার কারণে ওষুধ খেতে হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, চিকুনগুনিয়া রোগের প্রথমদিন থেকেই রোগীর অনেক বেশি তাপমাত্রায় জ্বর ওঠে। একই সাথে প্রচণ্ড মাথা ব্যথা, শরীর ব্যথা, বিশেষ করে হাড়ের জয়েন্টে ব্যথা হয়। কারো কারো শরীরে র্যাশ ওঠে।
জ্বর ভালো হলেও রোগটি অনেকদিন ধরে রোগীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ফলে চিকুনগুনিয়া কর্মক্ষম অনেক মানুষকে দিনের পর দিন বাধ্য করেছিল গৃহবন্দী জীবন কাটাতে। শিশু থেকে বৃদ্ধ কেউ এর কবল থেকে বাদ পড়েননি।
চিকিৎসক এবং নগর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, গত বছরের মে, জুন ও জুলাই মাসের দিক থেকে চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ তীব্র হয়ে ওঠে । খোদ নগর কর্তৃপক্ষই বলছে, গেল বছর ঢাকার কোনও এলাকা বাদ নেই যেখানে চিকুনগুনিয়া দেখা যায়নি।
তাই এবছরও বর্ষা মৌসুম এগিয়ে আসার সাথে সাথে বিভিন্ন বাড়িতে এডিস মশার লার্ভার পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষও।
কিভাবে ছড়ায় এই চিকুনগুনিয়া? এবং কখন?
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ পরিচালক অধ্যাপক সানিয়া তাহমিনা বলছিলেন, " এডিস মশা বদ্ধ পরিষ্কার পানিতে সাধারণত ডিম পাড়ে। ফ্লটিং ওয়াটারে অর্থাৎ পুকুরে বা নদীর পানিতে হবেনা।আশেপাশে পরিত্যক্ত টায়ার, কন্টেনাইর, পাস্টিক, টবের পানি, এসির বা ফ্রিজের জমে তাকা পানি, বাসা-বাড়িতে ফ্লাওয়ার ভাসে যদি পানি থাকে সেখানে এই মশা ডিম পাড়তে পারে।"
রোগ নিয়ন্ত্রণ ও রোগ তত্ত্ব আইইডিসিআরের ওয়েবসাইটের সর্বশেষ হিসেব অনুসারে, ঢাকা শহরে অবস্থিত বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসা নেয়া চিকুনগুনিয়া ও চিকুনগুনিয়া পরবর্তী আর্থ্রালজিয়া রোগীর সংখ্যা ১২ই মে ২০১৭ থেকে ১৮শে সেপ্টেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত ১৩ হাজার ৮১৪ জন। ওই সময় পর্যন্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের বাইরের বিভিন্ন জেলার সিভিল সার্জন ও মেডিকেল কলেজ থেকে ১৭টি জেলা থেকে ১৮৫ জনের তথ্য পাঠানো হয়।
তবে বাস্তবতা হল চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত বহু মানুষ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হননি।
ফলে ঠিক কত সংখ্যক মানুষ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই, যেমনটা বলছিলেন অধ্যাপক সানিয়া তাহমিনা।
"আসলে চিকুনগুনিয়া নিয়ে এত ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালানো হেয়ছে এটার ভ্যাপারে উপসর্গগুলি রোগীরা নিজেরাই ভালো বুঝে গেছিলেন। ফলে পরের দিকে কিন্তু আর আমাদের কাছে রোগী আসেনি। আইইডিসিআরের পরিসংখ্যান অনুসারে ১৩ হাজারের বেশি নিশ্চিতভাবে চিকুনগুনিয়ার চিকিৎসা নিয়েছেন।কিন্তু এর বাইরে আরও অনেক রোগী রয়ে গেছেন সেটা কিন্তু আমরা জানি।কারণ সেবছর প্রচুর রোগ হয়েছিল।"
রোগ নিয়ন্ত্রণ ও রোগ তত্ত্ব কর্তৃপক্ষ বলছে, হঠাৎ ভারী বর্ষণ এবং আসন্ন বর্ষা মৌসুমে এডিস মশার বংশ বিস্তারের কারণে এডিস মশা-বাহিত ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগের প্রকোপ বাড়তে পারে।
অধ্যাপক সানিয়া তাহমিনা বলছিলেন, কোন কোন এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ তা জানতে এবছর জানুয়ারি এবং চলতি মে মাসে তারা দুটি জরিপ করা হয়েছে। এ অবস্থায় এই রোগের বিষয়ে আগাম সতর্কতা ও এডিস মশা নির্মূলে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি বলে পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
গতবছরের অভিজ্ঞতায় এবছর সতর্কতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে দুই সিটি কর্পোরেশনও।
ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, গতবারের মত পরিস্থিতি যাতে না ঘটে সেজন্য তারা এবার বাড়তি সতর্কতায় কি ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন তারা।
সাইদ খোকন বলেন, "গতবছরের অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা এবছর একটু আগামভাবেই সতর্ক ইতোমধ্যে মশার প্রজনন-ক্ষেত্র চিহ্নিত করে লার্ভা পাওয়া গেছে। সেকারণে আমরা কিছুটা হলেও চিন্তিত।" এমন প্রেক্ষাপটে সামাজিকভাবে সচেতনতা কার্যক্রম চালানোর কথা জানান মেয়র খোকন।
"আগামী সপ্তাহ ৫৭টি ওয়ার্ডে কমিটি করা হয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে কমপক্ষে ১০০টি বাড়িতে ইন্সপেকশন করা হবে। এছাড়া বিভিন্ন টিভিতে বিজ্ঞাপন দেয়া, মাইকিং করা হবে, জুমার নামাজের খুৎবায় ইমামদের মুসুল্লিদের কাছে এর বিস্তারিত তুলে ধরার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমেও এলাকার বাসিন্দাদের সচেতন করা হচ্ছে" জানান মি খোকন।
রাজধানীর গুলশান বনানীর মত সেসব এলাকাতে রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ যে পরীক্ষা চালিয়েছে কিছুদিন আগে সেখানে সবচেয়ে মশক প্রবণ বা চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর মধ্যে উঠে এসেছে এসব এলাকার নামও। ফলে উদ্বেগ রয়েছে বিভিন্ন এলাকার মানুষের মাঝে ।
"মশা মারার লোক কয়দিন আসে তারপর আর দেখিনা। এবারও বর্ষা আসছে। আবারও চিকুনগুনিয়া হয় কিনা ভয় লাগতেছে"। আরেকজন বলেন, - "একজন লোক দেখি আসে। মাঝে মাঝে ধোঁয়া দিয়ে যায় যেইটা দিয়ে মশা মারে"।
"আগের চেয়ে মশা কম। আমাদের এলাকায় তো মশারি ছাড়াই ঘুমাই।" "আমার গতবার চিকুনগুনিয়া হয়েছিল। এখনো ব্যথা। সরকার কি কিছু করছে? করলে তো ভালো। এবার যাতে মানুষের আর কষ্ট না হয়"।
উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা এমনটাই বলছিলেন।
কিন্তু মশার বিস্তার ঠেকাতে আসলে কি করছে ঢাকা উত্তরের কর্তাব্যক্তিরা?
ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জাকির হাসান বলছিলেন, প্রাক-বর্ষা মৌসুমে যেহেতু চিকুনগুনিয়ার বিস্তার দেখা যায় তাই মে মাসের শুরু থেকেই মশা নিধন কাজ শুরু করেছেন অতিরিক্ত জনবল নিয়োগের মাধ্যমে।
"আইইডিসিআর বছরের প্রথমদিকে একটি সার্ভে করে কিছু কিছু এলাকা শনাক্ত করেছিল। যেমন বলা হয়েছিল বনানীতে এডিসের প্রকোপটা বেশি। কিন্তু তার মানে কি এই যে আমার গুলশানে হবে না, মিরপুরে হবেনা? সবগুলো এলাকাকেই কিন্তু গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা হচ্ছে। আমরা ৩৬টা ওয়ার্ডের সবগুলোতেই কিন্তু কাজ শুরু করেছি। অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ করে কার্যক্রম চলছে।"
গতবছরের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ৬ই মে থেকে তারা সচেতনতা বাড়ানোর কাজ শুরু করেছেন বলে জানান প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বিভিন্ন বাড়ির মালিকদেরও চিঠি দেয়া হয়েছে পরিচ্ছন্নতার জন্য।
কিন্তু মশা মারার পর্যাপ্ত কর্মকাণ্ডের অভাব রয়েছে বলে অনেক বাসিন্দাই যে অভিযোগ করে থাকেন সে প্রসঙ্গে প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মি. হাসান বলছিলেন, প্রতিদিন একটি জায়গায় মশা মারবার মতো কোনও ব্যবস্থা তাদের নেই।
"যে ওষুধ দেয়া হয় সেটি তিনদিন/চারদিন কাজ করে।তারা হয়তো ভাবে সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব তারা এসে প্রতিদিন মশা মেরে যাবে। কিন্তু একটি জায়গায় কিন্তু আমাদের পক্ষে সপ্তাহে দুইদিন কিংবা সবোর্চ্চ তিনদিন ওষুধ ধেয়া হয় তার বেশি সম্ভব না।"
তিনি জানান, কারো অভিযোগ যদি তাকে সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলের কাচে যদি জানায় তাহলে কিন্তু একটা ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।
আবার ফিরে যাওয়া যাক ঢাকার দক্ষিণে।
নানারকম প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে। কিন্তু মশার বিস্তার বা মশা-বাহিত রোগের প্রকোপ কেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না?
মেয়র সাইদ খোকনের কাছে। শহরের বাসিন্দাদের সচেতনতার অভাবকে এখানে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেন।
"মানুষকে সচেতন করে তোলা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। টিভি পত্র পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া, মসজিদে খুৎবায় বলা, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনকে বলা হচ্ছে। সাধারণ মানুষ সচেতন হলে ৭০%-৮০% কাজ হয়ে যায়।"
যেসমস্ত বাড়িতে মশার লার্ভা বা প্রজনন ক্ষেত্র পাওয়া গেছে সেসব বাড়ি চিহ্নিত করা হবে এবং পরবর্তীতে সেখানে আবার অভিযান চালানো হবে। পুনরায় মশার প্রজনন ক্ষেত্র পেলে প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেয়া হবে, জানান মেয়র সাঈদ খোকন।
চিকিৎসকরা বলছেন, চিকুনগুনিয়ার প্রতিষেধক নেই , তাই সচেতনতাই এই ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের প্রধান উপায়। মশা থেকে সতর্কতা, যেমন মশারি বা ওষুধ ব্যবহার করা এ থেকে রক্ষার সবচেয়ে ভালো উপায়। বৃষ্টির পর যাতে পানি জমে থাকতে না পারে, যেখানে মশা ডিম পাড়তে পারে, সেদিকেও নজর দিতে তারা পরামর্শ দিচ্ছেন।
তবে ঢাকাকে ঘিরে নানারকম প্রস্তুতি এবং সতর্কতামূলক কর্মকাণ্ড নজরে এলেও ঢাকার বাইরে সর্তকতা ও প্রস্তুতির বিষয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা। ঢাকার বাইরে গতবছর চিকুনগুনিয়া প্রকটভাবে দেখা নো গেলেও এবার তা বড় আকারে দেখা যেতে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে- জানান প্রফেসর সানিয়া তাহমিনা।
Source:
https://www.bbc.com/bengali/news-44165339