সভ্যতাকে যদি আমরা প্রডাক্ট হিসাবে বিবেচনা করি, তাহা হইলে ইহার বাই-প্রডাক্টকে আমরা ফ্রাংকেনস্টাইন নামে অভিহিত করিতে পারি। আধুনিক জীবনের পুরোটাই এখন যন্ত্রনির্ভর। আর বিভিন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্র প্রতিনিয়তই তৈরি করিতেছে বিপুল পরিমাণে ই-বর্জ্য। এই ই-বর্জ্যের উত্সটা কয়েক দশক আগেও ছিল অনেকটাই সীমিত পরিসরে। ইহার মধ্যে ছিল বেতার যন্ত্র, টেলিভিশন, ফ্রিজ, ক্যাসেট প্লেয়ার ইত্যাদি। কিন্তু সেগুলিও ছিল সীমিতসংখ্যক মানুষের কাছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির বিস্ময়কর বিকাশ ঘটিবার পর কম্পিউটার, ল্যাপটপ কিংবা মোবাইল ফোন ব্যতীত আমরা একটি দিনও কল্পনা করিতে পারি না। এমনকী এই লেখাটিও কম্পোজ হইতেছে একটি কম্পিউটারের সাহায্যেই, যাহা ভবিষ্যতে পরিণত হইবে ই-বর্জ্যে। আগে একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্রের আয়ুষ্কাল অনেক বেশি থাকিত। বাজার-সংস্কৃতির এই যুগে যন্ত্রের আয়ুষ্কাল একদিকে যেমন হ্রাস করা হইতেছে, অন্যদিকে ভোক্তাবৃদ্ধির জন্য উত্পাদন করা হইতেছে কোটি কোটি সংখ্যক সেলফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটার ইত্যাদি। এই কারণে প্রতিবত্সর বিশ্বে ই-বর্জ্য বৃদ্ধি পাইতেছে প্রায় ১০ শতাংশ হারে। অন্যদিকে এই বর্জ্যের শতকরা ৫ ভাগের বেশি পুনরুদ্ধার করা যায় না।
মনে রাখিতে হইবে, ই-বর্জ্য যেকোনো সাধারণ জৈববর্জ্য হইতে বহুগুণ অধিক ক্ষতিকর। সমস্যা হইল, ই-বর্জ্যের ক্ষতির প্রভাব আপাতভাবে দৃশ্যমান নহে। ই-বর্জ্য পচনশীল না হইবার কারণে ইহার প্রভাবও হয় দীর্ঘমেয়াদি। অন্যদিকে, ইহার ফলে সৃষ্ট শারীরিক জটিলতার কারণটাও সরাসরি বুঝিতে পারা যায় না। বর্তমানে সবচাইতে বেশি ই-বর্জ্য সৃষ্টির জন্য দায়ী মোবাইল ফোনের আধিক্য। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) হিসাবে, বর্তমানে দেশে প্রায় ১৩ কোটি মোবাইল ফোনের সংযোগ চালু রহিয়াছে। একটি গবেষণায় দেখা গিয়াছে, প্রতিটি মোবাইল ফোনে গড়ে যে পরিমাণ ‘লেড’ নামক ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান থাকে, তাহা দিয়া প্রায় ৪৫ হাজার গ্যালন পানি দূষিত করা সম্ভব! ইহা ছাড়াও মোবাইল ফোনে ক্যাডমিয়াম, মার্কারি, আর্সেনিক, ক্লোরিনের মতো অত্যন্ত ক্ষতিকর উপাদান রহিয়াছে, যাহা যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে পানি বা মাটিতে মিশিয়া যাইতেছে। খাদ্যচক্রে এই বিষ প্রবেশ করিয়া ঢুকিয়া পড়িতেছে আমাদের শরীরে। অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ ই-বর্জ্য একদল অসচেতন ও অদক্ষ শ্রমিক-কর্মীর হাত ঘুরিয়া পুনর্ব্যবহার-যোগ্য করা হইতেছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের অভিমত হইল, পুনর্ব্যবহার প্রক্রিয়া যথাযথ না হইবার কারণে সেইসকল ই-বর্জ্য হইতে তৈরি হওয়া নূতন সামগ্রী স্বাস্থ্যের জন্য যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ।
ই-বর্জ্যের সমস্যা কেবল বাংলাদেশের নহে, সারা বিশ্বের। উন্নত বিশ্ব এই ব্যাপারে বহুপূর্বেই সচেতন, কিন্তু আমরা এখনো একই তিমিরে পড়িয়া রহিয়াছি। ই-বর্জ্যের ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর প্রভাবের কারণেই এখন সময় আসিয়াছে আইন করিয়া নিয়ন্ত্রিতভাবে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশ রক্ষার। এই ব্যাপারে উত্পাদক প্রতিষ্ঠানগুলির দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা জরুরি হইয়া পড়িয়াছে।
Source:
http://www.ittefaq.com.bd/print-edition/editorial/2018/05/28/279989.html