শিক্ষাই শক্তির উৎস

Author Topic: শিক্ষাই শক্তির উৎস  (Read 1766 times)

Offline Mrs.Anjuara Khanom

  • Sr. Member
  • ****
  • Posts: 478
  • Test
    • View Profile
শিক্ষাই শক্তির উৎস
« on: May 31, 2018, 12:59:11 PM »
অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ইত্যাদি মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে শিক্ষার অবস্থান বিশেষভাগে গুরুত্বপূর্ণ। অশিক্ষিত ব্যক্তি সমাজের জন্য বোঝাস্বরূপ। এর সঙ্গত কারণও আছে। এমনকি, শিক্ষা ছাড়া একটি জাতির উন্নতি কল্পনাও করা যায় না। একটি জাতিকে উন্নতির ক্রমবর্ধমান পথে ধাবিত হতে গেলে শিক্ষা ছাড়া গত্যন্তর নেই। সমাজে শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন করতে হলে প্রথমে সেই দেশ ও জাতিকে সুশিক্ষায় শিক্ষত করা আবশ্যক। এক্ষেত্রে শিক্ষা ও সামাজিক পরিবেশ উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা আছে। ইংরেজ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকন বলেছিলেন, ‘শিক্ষাই সব শক্তির মূল।’ এই বাক্যটি চারশো বছরের আগের হলেও বাক্যটির নিহিতার্থ আধুনিক বিশ্বে অবহেলা করার অবকাশ নেই। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে শিক্ষা কোন ধরনের ভূমিকা পালন করে, তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই।
আমাদের প্রচলিত শিক্ষার মাপকাঠি দার্শনিকদের ব্যাখ্যা করা শিক্ষার সঙ্গে খাপ খায় কি না, এ-নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করতে চাই। ‘শিক্ষা’ মানুষের আচরণের কাক্সিক্ষত, বাঞ্ছিত এবং ইতিবাচক পরিবর্তনকেই সাধারণ অর্থে শিক্ষা বলা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বর্তমানে প্রজন্ম পড়াশুনার অর্থ বলতে কী বোঝে? শিক্ষার্থীদের কি বুঝানো হয় সুশিক্ষার অর্থ? বর্তমান আমাদের দেশে কিংবা বিশ্বের অন্যান্য দেশে হোক দিন দিন শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু অবাক করার মতো ঘটনা হল বাস্তবে শিক্ষিত বিবেকের অভাব কমই পরিলক্ষিত হয়। সামাজিক প্রেক্ষাপট অবলম্বনে অনায়াসে কথাটাকে ফেলে দেওয়া যায় না। বর্তমানে পড়াশুনার সঙ্গে জড়িত থাকা শিক্ষার্থীর মনে নৈতিকতা শিখন যে শিক্ষার মূল উপপাদ্য তা ভুলে সর্বাধিক আলোচ্য হয়, পড়াশুনার শেষে সরকারি চাকরি পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে অভিভাবকদের মনেও একই অভিপ্রায়। বাংলাদেশের মতো জনসংখ্যাবহুল দেশে সকল শিক্ষিত লোককে সরকার কর্তৃক চাকরি প্রদান করা কস্মিনকালেও সম্ভবপর নয়। শিক্ষার যে মূল উদ্দেশ্য জ্ঞান লাভ করা সেই ব্যাপারটাতে হোঁচট খেতে হয় এখানে। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের মনের ভিতরে থাকা সুপ্ত চেতনা জাগ্রত করানো হয় যাতে করে তারা ন্যায় অন্যায়ের ফারাক বুঝতে সক্ষম হয়। শিক্ষা লাভের পর চাকরি মুখ্য বস্তু নয়। কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, বিভিন্ন ব্যক্তিগত খন্ডকালীন প্রতিষ্ঠানে ব্যবসার ভিত্তিতে একশো শতাংশ চাকরির প্রলোভন দিয়ে শিক্ষার পাঠ্যক্রম নির্ধারণ করা হয়েছে। আমাদের মনে হয়, এসব প্রতিষ্ঠানে লাখ লাখ টাকা করচ করে পড়াশোনা ব্যতিরেকে ওই সীমিত পুঁজির সদ্ব্যবহার করে একজন লোক অনায়াসে স্বনির্ভর কর্মক্ষেত্র গড়ে তুলতে পারবে। জীবনে সবাই বড় হওয়ার আকাক্সক্ষা পুষে মনে, অবশ্যই তা মন্দ নয়। তাই বলে নিজের চিন্তা-চেতনা ও সৃজনশীলতাকে বিসর্জন দিয়ে চাকরিগত গন্তব্যে পৌঁছার লক্ষ্যে পড়াশুনার পরিমাপ নির্ধারণ করা মনুষ্যত্বের অবমূল্যায়ন বললে অত্যুক্তি হবে না। শিক্ষাকে শুধুমাত্র চাকরির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের শিক্ষার মূল প্রতিপাদ্য থেকে আদর্শ্য বিচুত পথের পথিক বলা যেতে পারে।
এখানে একটি কথা উল্লেখ করা সঙ্গত মনে করি, শিক্ষা অর্জন করে চাকরি করা দোষের নয় তবে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য সরকারি চাকরিতে নিহিত নয়। কেরিয়ার ভিত্তিক পড়াশুনায় জীবনে চলার পথে কিছু প্রলোভন মানুষকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরে যেখানে থেকে ছাড় পাবার কোনো উপায় থাকে না। আর সেই জাগতিক মোহ-মায়া বা ঐশ্বর্যের প্রলোভন যখন নিজে থেকে একজনের কাছে এসে ধরা দেয় তখন তাকে দূরে ঠেলে দেওয়ার মতো সাধ্য খুব কম মানুষেরই থাকে। প্রতিযোগিতার মোহে নিজেকে আবিষ্কার করার অবকাশ কেরিয়ার ভিত্তিক পড়াশুনা ব্যক্তিটিকে স্বতন্ত্র আকাশে বিচরণ করতে বাধা দিচ্ছে।
ইতিহাস সাক্ষী রেখে দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলা যায়, মাত্র তিন কিংবা চার দশক আগে অভিভাবকরা সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করে শিক্ষককে বলে আসতেন, সন্তান যেন মানুষ হয়। তখন শিক্ষার উদ্দেশ্য হিসাবে মানুষের মতো মানুষ হওয়াকেই বুঝানো হতো। এখন যুগের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে অভিভাবকদের প্রথম টার্গেট থাকে নম্বরের নিরিখে ভালো ফলাফল। ছাত্রছাত্রীর অভ্যন্তরীণ বিকাশ যাই হোক না-কেন, জিপি এ-৫ এর আশাই থাকে অভিভাবকদের মাথায়। অবশ্যই এটা ভালো কথা, তবে ভালো রেজাল্ট করতে গিয়ে শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্য, ভালো মানুষ হওয়া যে পিছিয়ে পড়ছে, তা আর কারো মনে থাকছে না। শিক্ষার উদ্ভবই হয়েছে জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের জন্য, কেবলমাত্র চাকরি পেয়ে মোটা টাকা উপার্জন করার জন্য নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থায় একটা পরিবর্তন আবশ্যকীয় হয়ে ওঠে। দেশে মেধাবী শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়ছে নাকি কেবল পাশের হার বাড়ছে, তা নিয়ে প্রতিনিয়ত আলোচনা হয়। আলোচনা হওয়ারও যথেষ্ট কারণও রয়েছে। যেমন, শিক্ষিত হয়ে চাকরি পাওয়াটা যতটা না গুরুত্বপূর্ণ, তার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ একজন প্রকৃত মানুষ হয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। আজকাল শিক্ষার উদ্দেশ্য ভালো রেজাল্টের সার্টিফিকেট সংগ্রহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে, যা আমাদের জন্য এক অশনিসংকেত বলা যেতে পারে।
বর্তমানে বেশির ভাগ বৃত্তিমূলক প্রতিষ্ঠার শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে উদাসীন। যে শিক্ষা মানুষের জীবনবোধ তৈরি করে, চিন্তা ও মননে জীবনকে বিকশিত করে, মানুষকে শুধু পার্থিব নয় অপার্থিব ও চিরন্তর সুখের পথ দেখায়; সে শিক্ষা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বেসরকারি বৃত্তিমূলক পাঠ্যসূচিতে গুরুত্ব পায় না। দেশের ইতিহাস-সাহিত্য-সংস্কৃতি তেমন শেখানোর সুযোগ নেই। বৃত্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা বলতে গেলে শিক্ষার্থীদের রুটি ও রোজগারের শিক্ষা দিয়ে থাকে। অর্থ উপার্জনই এই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। বৃত্তিমূলক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের তৈরি করে যন্ত্রের মতো। যন্ত্র ব্যবহার হয় উৎপাদনের জন্য। পণ্য ব্যবহার হয় ভোগের জন্য। এজন্য অনেকে শিক্ষালাভ করেও প্রকৃত মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে পারে না।
অবশ্য ক্যারিয়ারভিত্তিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করছি না, তবে শিক্ষাজীবনের শুরুতে প্রাথমিক স্তর থেকে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের তাত্তি¡ক শিক্ষার পাশাপাশি ব্যবহারিক তথা হাতে-কলমে শিক্ষা পদ্ধতিতে গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন। শিক্ষাব্যবস্থা চালু এমনভাবে করতে হবে, যা শিশুদের ভবিষ্যৎ কর্মজীবনে স্বনির্ভর হতে সহায়তা করে। জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে সেই শিক্ষা যেন কাজে লাগে। বর্তমানে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের যা শেখানো হচ্ছে তা এক ধরনের গৎবাঁধা তাত্তি¡ক শিক্ষা ছাড়া আর কিছু নয়। শুধু পুঁথিগত বিদ্যায় প্রাণের স্পন্দন জাগে না। শিক্ষাকে আনন্দময় করে তুলতে ব্যবহারিক ও তাত্তি¡ক বিশ্লেষণ-ধর্মী দুটি দিক সুনিশ্চিত করতে হবে। কর্মমুখী ও ব্যবহারিক শিক্ষার শক্তিই হচ্ছে উন্নয়ন ও জাতি গঠনের আসল শিক্ষা। প্রফেসর ওসমান গনি বলেছেন, ‘শিক্ষার লক্ষ্য হল দেহ, মন ও আত্মার সর্বশ্রেষ্ঠ গুণাবলীর সুসামঞ্জস্য বিকাশ সাধন।’ সুতরাং মুখস্থের ঘেরাটোপে শিক্ষার প্রকৃত নিহিতার্থ ব্যক্ত হয় না। এতে নৈতিকতাবিহীন শিক্ষা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তোতা কাহিনীর রূপ ধারণ করে। ইংরেজ কবি জন মিলটন শিক্ষাকে- Education is the harmonious development of body, mind and soul, বলে আখ্যায়িত করেছেন। এখানে তত্তগত শিক্ষা মুখস্থ করে মানসিক চাপ বাড়ানোর চেয়ে হাতে-কলমে বুঝা উচিত শিক্ষার্থীদের। মধ্যযুগীয় সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামিক বিজ্ঞান ও গণিত সমৃদ্ধ হয়েছিল ইসলামিক খলিফার অধীনে, যা পশ্চিম সাইবেরিয়ান উপদ্বীপ থেকে পূর্বে সিন্ধু পর্যন্ত এবং দক্ষিণে আলমোরাভিড রাজবংশ ও মালির সাম্রাজ্য পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক সময় পর্যন্ত অনেক সংস্কার সাধিত হয়েছে। এসব বিষয়ে শিক্ষার্থীদের শেখানো উচিত।
শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব ইতিবাচক দিক নির্দেশনা প্রদানের পাশাপাশি নেতিবাচকতার প্রাধ্যন্য কখনও অবহেলার নয়। নম্বরের ভিত্তিতে শিক্ষার মানদন্ডের মূল্যায়ন হতে পারে না। একজন ব্যক্তি সারাবছর পড়াশুনা করে পরীক্ষার সময়ে শারীরিক বা অন্য কোনো অসুবিধা হলে সারা বছরের পরিশ্রম মাঝরাস্তায় এসে খাদে পড়ে। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন প্রতিদিন ক্লাসরুমে হওয়া উচিৎ এবং তা কমবেশি সর্বত্রই হয়। আমাদের দেশে ছেলেমেয়েরা যে-কোনো বিভাগে পড়াশুনা করুক না-কেন, যুগে যুগে বিশ্বের বুকে জন্ম লাভ করা মহাপুরুষদের জীবনী জানুক, তাঁদের আদর্শের বাস্তব প্রতিফলন শিক্ষার আঙিনায় হোক। তবেই আগামী প্রজন্ম যে কোনো পেশায় প্রতিষ্টিত হোক না-কেন, মানবীয় গুণে গুনাম্বিত হয়ে দেশের সুনাম বাড়াবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Mrs, Anjuara Khanom
Library Assistant Officer,
Daffodil International University
DSC Campus
02224441833/34